সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হিসেবে বাংলার শহরে, গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় অবস্থিত মসজিদ, মাদরাসা কিংবা দ্বীনদরদী মুসলিম ভাইদের উদ্যোগে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন- বেশ পরিচিত একটি চিত্র। এমন দৃশ্য বিশ্বের অন্য কোনো মুসলিম দেশে সাধারণত দেখা যায় না।
আয়োজিত এসব ওয়াজ মাহফিলে প্রাজ্ঞ আলেম, পীর-মাশায়েখ ও বুজুর্গরা সাধারণ মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় নানা বিষয় নিয়ে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়ে থাকেন। দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে, সাইকেল বা বিভিন্ন যানবাহনের মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এ সব ওয়াজ মাহফিলে অংশগ্রহণ করে থাকেন এবং সারারাত জেগে, গভীর আগ্রহ সহকারে কোরআন-হাদিসের আলোচনা শোনেন। পর্দার আড়ালের মা-বোনেরাও নিজ বাসা বাড়িতে বা আত্মীয়ের বাড়িতে এসে ওয়াজ শোনে থাকেন। বাংলাদেশের মানুষ যে ধর্মপ্রাণ- এসব ওয়াজ মাহফিলের উপস্থিতি দেখে তা অনুমান করা যায়।
মানুষের ধর্ম সম্পর্কে জানার ইচ্ছা থেকেই প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে এসব মাহফিলে অংশ নিয়ে থাকেন। আর ধর্ম সম্পর্কে মানুষকে জানানো আলেম-উলামাদের নৈতিক দায়িত্ব। এ সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘(আমার ইন্তেকালের পর) লোকেরা তোমাদের অনুসারী হবে। বিভিন্ন দিক হতে তারা তোমাদের নিকট দ্বীনি জ্ঞান লাভ করার উদ্দেশ্যে আগমন করবে। অতএব, তারা যখন তোমাদের নিকট আসবে তখন তোমরা তাদেরকে সদুপদেশ দেবে। ’ -তিরমিজি/ ২৬৫০
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরেক হাদিসে আরও ইরশাদ করেন, ‘মুমিন ব্যক্তি কখনও উত্তম কথা শ্রবণে তৃপ্তি লাভ করতে পারে না; যে পর্যন্ত না তার শেষ পরিণামে জান্নাত হয়। ’ –তিরমিজি/ ২৬৪৮
আসলে মুমিন বান্দা যতই দ্বীনি ইলম অর্জন করবে বা তার আলোচনা শোনবে ততই তার আকাঙ্খা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ফলে তার এই আগ্রহ মৃত্যু অবধি শেষ হয় না। বরং সে আমরণ সে শোনতেই থাকবে; অবশেষে এটাই তাকে বেহেশতে পৌঁছে দিবে। অর্থাৎ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সে জান্নাতে পৌঁছে যায়।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অায়োজিত এসব ওয়াজ মাহফিলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্য এলাকার নামকরা মসজিদের ইমাম-খতিব, মুহাদ্দিস ও মুফাসসিররা ওয়াজ করে থাকেন। ওয়াজে তারা মানুষকে সৎ উপদেশ ও ইসলামের সঠিক পথের দিশা দিয়ে থাকেন। এভাবে মানুষকে ইসলামের পথে আহবান করা প্রচুর সওয়াবের কাজ।
এ সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা কি বলতে পারো দানের দিক দিয়ে সর্বাপেক্ষা বড় দাতা কে? সাহাবিরা জবাব দিলেন আল্লাহ ও তার রাসূলই অধিক ভালো জানেন। তখন হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দানের দিক দিয়ে আল্লাহই সব চেয়ে বড় দাতা। তার আদম সন্তানদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে বড় দাতা। আর আমার পরে বড় দাতা ওই ব্যক্তি যে ইলম শিক্ষা করে এবং তা বিস্তার (প্রচার-প্রসার) করে। কিয়ামতের দিন সে একাই একজন আমির হিসেবে উত্থিত হবে। -মিশকাত/২৪১, শোয়াবুল ঈমান/১৬৩২
বস্তুত দেশের সাধারণ মানুষের ধর্মের প্রতি হৃদয়ের টান সত্যিই প্রসংশনীয়। ধর্মের প্রতি মানুষের এমন আকর্ষণ অব্যাহত থাকুক। এই কামনা করে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই-
অনেক সময় দেখা যায়, রাতব্যাপী ওয়াজ মাহফিলের কারণে অনেকেরই ফজরের নামাজ আদায়ে বেগ পেতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে রাতব্যাপী মাইকের আওয়াজের দরুন ঘুমের ব্যাঘাত ঘটার পাশাপশি অনেকের নামাজেরও সমস্যা হয়। বিশেষ করে মা-বোনদের। অনেক সময় এটাও দেখা যাচ্ছে যে, ওয়াজ শেষে ফিরার পথে অনেক বক্তা ডাকাতের হাতে আক্রান্ত হচ্ছে, অনেক সময় ঘন কুয়াশার কারণে সড়ক দূর্ঘটনাও ঘটছে।
চলমান বাস্তবতা বিবেচনা করে তাই এসব ওয়াজ মাহফিল দিনে কিংবা মধ্যরাত পর্যন্ত হলে সার্বিক বিবেচনায় উত্তম মনে হয়। এতে মানুষের যেমন আমলের কোনো ব্যাঘাত হবে না, তেমনি আমন্ত্রিত আলেমদেরও কষ্ট হবে না।
ওয়াজ মাহফিলের আয়োজকদের কাছে আরও প্রত্যাশা থাকবে, ওয়াজ মাহফিলে কোরআন-হাদিসভিত্তিক আলোচনার জন্য বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ আলেম নির্বাচন করবেন। তাহলে জাতি আরও বেশি উপকৃত হবে এবং ওয়াজ মাহফিলের উদ্দেশ্য হাসিল হবে। বস্তুত এমন ওয়াজের মাধ্যমে পরকালে নাজাতের আশা করা যায়।
দেখুন, এক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতো সুন্দর করে বলেছেন, নিশ্চয়ই এ ইলম হচ্ছে দ্বীন। সুতরাং লক্ষ করো যে, তোমাদের এ দ্বীন কার নিকট থেকে গ্রহণ করছ। -মুসলিম শরিফ: ১/১৪
এ হাদিসের অালোকে বলা যায়, সত্যিকারের দ্বীন শিখতে হলে আমলদার, বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ আলেমের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: প্রিন্সিপাল ও মুহাদ্দিস, জামিআ রশীদিয়া এনায়েতুল উলুম, দক্ষিণখান, ঢাকা
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৬, ২০১৬
এমএ/