ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

ইজতেমা ময়দানে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল মুসল্লিরা

মো. রাজীব সরকার, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৬
ইজতেমা ময়দানে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল মুসল্লিরা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

গাজীপুর: বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জমায়েত বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুক্রবার (১৫ জানুয়ারি) বাদ ফজর থেকে আমবয়ানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। দেশের ১৬ জেলা থেকে সড়ক, রেল ও নৌপথে মুসল্লিদের কাফেলা টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে আসে।

গত বুধবার থেকে আসতে থাকা মুসল্লিদের ঢল শুক্রবার জু’মার নামাজের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এসেছেন বিদেশি মেহমানরাও।
 
ইজতেমা ময়দানে শুক্রবার দেশের সর্ববৃহৎ জু’মার জামাত দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে শুরু হয়। এর আগে ১টা ৩০ মিনিটে খুতবা পাঠ করা হয়। বৃহৎ এ জু’মার নামাজের ইমামতি করেন ঢাকার কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ জুবায়ের।

ইজতেমায় যোগদানকারী মুসল্লি ছাড়াও জু’মার নামাজে অংশ নিতে ঢাকা ও গাজীপুরসহ আশপাশের এলাকার লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমাস্থলে হাজির হন। ভোর থেকেই রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা থেকে ইজতেমা মাঠের দিকে মানুষের ঢল নামে। দুপুর ১২টার দিকে ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের খোলা স্থান, রাস্তা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মাঠে জায়গা না পেয়ে মুসল্লিরা মহাসড়ক ও অলি-গলিসহ যে যেখানে পেরেছেন হোগলা পাটি, চটের বস্তা, খবরের কাগজ বিছিয়ে জু’মার নামাজে শরিক হয়েছেন। ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে প্রায় ১ ঘণ্টা পর যান চলাচল শুরু হলেও কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত ধীরগতিতে চলে যানবাহন। জু’মার নামাজ শেষে ইজতেমা ময়দানে এক মুসল্লির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

ইজতেমার মূল প্যান্ডেলের ভেতরে এবার ১৬টি জেলার ২৯টি খিত্তা থাকায় জেলাওয়ারি মুসল্লিরা অনেক জায়গা পেয়েছেন। ফলে মূল প্যান্ডেলে ভিড় আগের তুলনায় এবার অনেকটাই কম।

শুক্রবার বাদ ফজর তাবলীগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বী ভারতের হযরত মাওলানা আবদুর রহমান উর্দূতে আম বয়ান করেন। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জিকির-আসকার-ইবাদত বন্দেগিতে টঙ্গী এখন পুণ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। আয়োজকদের ধারণা, ইজতেমার ময়দানে দ্বিতীয় পর্বে আনুমানিক ৫ লক্ষাধিক মুসল্লি জু’মার নামাজ আদায় করেছেন।

বিশ্ব ইজতমোয় ঈমান, আমল ও দাওয়াতের মেহনত সম্পর্কে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ বয়ান পেশ করা হয়। মূল বয়ান উর্দূতে হলেও বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি, ফারসিসহ বিভিন্ন ভাষায় তাৎক্ষণিকভাবে তা অনুবাদ করা হয়। ইজতেমায় বিভিন্ন ভাষাভাষী মুসল্লিরা আলাদা আলাদা তাঁবুতে বসেন এবং তাদের মধ্যে একজন করে মুরব্বি মূল বয়ানকে তাৎক্ষণিকভাবে অনুবাদ করে শোনান।

বিশ্ব ইজতেমার কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- আম ও খাস বয়ান, তালিম, তাশকিল, ৬ উছুলের হাকিকত, দরসে কোরআন, দরসে হাদিস, চিল্লায় নাম লেখানো, নতুন জামাত তৈরি।

ভিআইপিদের জু’মার নামাজে অংশগ্রহণ
ইজতেমার ময়দানে জু’মার নামাজ আদায় করেছেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকটে আ ক ম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর জেলা প্রশাসক এস এম আলম, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ প্রমুখ।

ভ্রাম্যমাণ আদালত
ইজতেমা ময়দানের প্রথম দিনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ৪টি অভিযান পরিচালনা করে অর্ধলক্ষাধিক টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ইজতেমাস্থলের আশপাশে অবৈধ দখল ও স্থাপনা উচ্ছেদ এবং হোটেল, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন দোকানে খাবারের মান ও মেয়াদ যাচাইয়ে এসব অভিযান পরিচালিত হয়। কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এসব অভিযান পরিচালনা করছেন।

দ্বিতীয় পর্বে বিদেশিসহ তিন মুসল্লির মৃত্যু
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় ধাপে যোগ দিতে আসা একজন বিদেশি নাগরিকসহ তিন মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আব্দুর রহমান (৬০), নামে এক মুসল্লি মারা যান। তার বাড়ি বগুড়ার গাবতলী থানার মাঝবাড়ি এলাকায়।

শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ইজতেমার ময়দানে বার্ধক্যজনিত কারণে আবুল কাশেম (৬৫) নামে আরেক মুসল্লির মৃত্যু হয়। তার বাড়ি জামালপুর সদর উপজেলার কাচারিপাড়া এলাকায়।

শুক্রবার দুপুরে মারা গেছেন শাহিদান-দ্বিন ইব্রাহিম (৪৮) নামে মালয়েশিয়ান এক নাগরিক।

টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. পারভেজ হোসেন জানান, শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে শাহিদান-দ্বিন ইব্রাহিম অসুস্থ বোধ করলে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পথে দুপুর দেড়টার দিকে তার মৃত্যু হয়। তার মৃতদেহ মালয়েশিয়ান দূতাবাসের মাধ্যমে নিজ দেশে পাঠানো হবে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের নিরাপত্তা দিতে গাজীপুর জেলা পুলিশ ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছে। শুক্রবার দুপুরে ইজতেমায় স্থাপিত মিডিয়া সেন্টারে গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ সাংবাদিকদের জানান, দেশি-বিদেশি মুসল্লিদের নিরাপত্তায় প্রতিটি খিত্তায় সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন। এছাড়া রাস্তাঘাট, ব্যস্ততম এলাকাসহ পুরো ইজতেমা ময়দান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ঘিরে রেখেছেন। পাঁচ স্তরে পুরো ইজতেমা ময়দানকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।

বিদেশি মুসল্লি
পুলিশের কন্ট্রোল রুম সূত্র জানিয়েছে, ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে প্রথম দিন আমেরিকা, সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্থান, তুরস্ক, লেবানন, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, আফ্রিকা, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের ৯৬টি দেশের  প্রায় ৭ হাজারের বেশি মুসল্লি অংশ নিয়েছেন।

দ্বিতীয় পর্বে ১৬টি জেলার মুসল্লিদের অংশগ্রহণ
দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় মুসল্লিদের অংশ নেওয়ার জন্য জেলাওয়ারি পুরো প্যান্ডেলকে ২৯টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। এতে ১৬টি জেলার মুসল্লিরা অংশ নিচ্ছেন। খিত্তা অনুযায়ী জেলাগুলো হলো- ১নং থেকে ৭ নং খিত্তায় ঢাকা জেলার বাকি এলাকা, ৮নং খিত্তায় ঝিনাইদহ, ৯ ও ১১ নং খিত্তায় জামালপুর, ১০ নং খিত্তায় ফরিদপুর, ১২ ও ১৩ নং খিত্তায় নেত্রকোনা, ১৪ ও ১৫ নং খিত্তায় নরসিংদী, ১৬ ও ১৮ নং খিত্তায় কুমিল্লা, ১৭ নং খিত্তায় কুড়িগ্রাম, ১৯ ও ২০ নং খিত্তায় রাজশাহী, ২১ নং খিত্তায় ফেনী, ২২ নং খিত্তায় ঠাকুরগাঁও, ২৩ নং খিত্তায় সুনামগঞ্জ, ২৪ ও ২৫ নং খিত্তায় বগুড়া, ২৬ ও ২৭ নং খিত্তায় খুলনা, ২৮ নং খিত্তায় চুয়াডাঙ্গা এবং ২৯ নং খিত্তায় পিরোজপুর জেলা।

ইজতেমায় স্বাস্থ্যসেবা
ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিতে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়, টঙ্গী সরকারি হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান ইজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে নিউ মন্নু কটন মিলের ভেতরে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইজতেমা ময়দানে হামদর্দ, ইবনে সিনা, টঙ্গী ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতি, আবেদা মেমোরিয়াল প্রাইভেট হাসপাতাল লিমিটেড, সি কে ডি অ্যান্ড ইউরোলজিস্ট হসপিটাল, যমুনা ব্যাংক ফাউন্ডেশন, ইসলামী ফাউন্ডেশন, নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্বাস্থ্য অধিদফতর চিকিৎসা কেন্দ্র, গাজীপুর সিটি করপোরেশনসহ ৫৪ ফ্রি মেডিকেল টিম বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবার জন্য ক্যাম্প খুলেছে।

র‌্যাবের ব্রিফিং
ইজতেমা ময়দানে শুক্রবার সকালে ব্রিফিংয়ে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেছেন, ইজতেমা এলাকায় সম্ভাব্য সব ধরনের হুমকির বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নজরদারি নিশ্চিত করা হয়েছে। এজন্য অন্য সব গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ রয়েছে।

তিনি বলেন, দ্বিতীয় পর্বে লাখো মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে মোনাজাতে অংশ নেন। আখেরি মোনাজাত আমাদের চ্যালেঞ্জ। গত পর্ব ও বিগত দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে এবারও বেশি সিকিউরিটি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সাদা পোশাকের বিপুল সংখ্যক র‌্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পুরো ইজতেমা এলাকায় সিসি টিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। যা র‌্যাব কন্ট্রোল রুম থেকে নজরদারি ও মনিটরিং করা যাচ্ছে।

৫০ হকার আটক
ইজতেমা ময়দানের আশপাশ থেকে ৫০ জন হকারকে আটক করা হয়েছে। ময়দানের আশপাশে বসে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিভিন্ন পণ্য ও খাদ্যসামগ্রী বিক্রির অভিযোগে তাদের আটক করা হয়।

এবার হচ্ছে না যৌতুকবিহীন বিয়ে
প্রতি বছর ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী, ইজতেমার দ্বিতীয় দিনে যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠানের রেওয়াজ থাকলেও এ বছর প্রথম পর্বে বিয়ের আয়োজন ছিল না। দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় দিনেও যৌতুকবিহীন বিয়ে হবে না বলে ইজতেমা আয়োজক কমিটির সদস্য মো. গিয়াস উদ্দিন জানিয়েছেন।  

বিশ্ব ইজতেমা ইতিহাস
ইজতেমার মুরুব্বিদের দেওয়া তথ্য মতে, ১৯৪৬ সালে কাকরাইল মসজিদে প্রথম ইজতেমার আয়োজন করা হয়। এরপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজি ক্যাম্পে ও ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৬৬ সালে গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বর্তমানস্থলে বিশ্ব ইজতেমা স্থানান্তর করা হয়। পরে সরকারিভাবে তুরাগ তীরের ১৬০ একর জমি স্থায়ীভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ২৩০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৬
আরএম

** ইজতেমায় মালয়েশীয় মুসল্লির মৃত্যু
** ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে আরও এক মুসল্লির মৃত্যু
** ধুলাবালি, ময়লা-আবর্জনায় ভোগান্তি
** দ্বিতীয় পর্বেও ৭ স্থানে ডাইভারশন
** জুমার নামাজে লাখো মুসল্লির ঢল
** র‍্যাবের ৫ স্তরের নিরাপত্তা জোরদার
** ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে এক মুসল্লির মৃত্যু
** আমবয়ানে চলছে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব
** বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু
** বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু শুক্রবার

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।