ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

ইজতেমার ময়দান ও ধৈর্যের শিক্ষার প্রতিফলন

সাঈদ কাদির, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৬
ইজতেমার ময়দান ও ধৈর্যের শিক্ষার প্রতিফলন ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বিশ্ব মুসলিমের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছ তুরাগ তীর। নূরানী বয়ানের হৃদয়গলা কলতানে পুরো এলাকা মোহিত।

কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছে মানুষ। সাদাকালোর ভেদাভেদ নেই। ধ্বনি-গরীবের পার্থক্য নেই। সবাই এক কাতারে। সবাই এক ধ্যানে। সবার মানসিক অবস্থা অভিন্ন। সহিষ্ণুতার জয়জয়কার। ভ্রাতৃত্বের অপূর্ব প্রদর্শনী। ধৈর্যের অনুপম দৃশ্য। বিশ্বের সব মুমিনই যে পরস্পর ভাই ভাই, এ যেন তার বাস্তব চিত্র। যেন সূরা হুজরাতের দশ নাম্বার আয়াতের (মুমিন পরস্পর একে অপরের ভাই) জ্বলন্ত নমুনা।

ইজতেমাকে কেন্দ্র করে টঙ্গীর আশপাশ এলাকা মানবসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। কোথাও পা ফেলবার জায়গা নেই। এলাকাজুড়ে লাখ লাখ মানুষের জমায়েত। বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্র থেকেই এসেছে বিশ্বাসী মানুষেরা। তবু নেই কোনো ঠেলাঠেলি। কারো পায়ে পাড়া লাগলেও (অন্য সময়ের মতো) সে চোখ রাঙাচ্ছে না। কোনো চিল্লাচিল্লি নেই। তেমন একটা ধাক্কাধাক্কি নেই। হৈ-হুল্লোড় নেই। শুধু জিকির আজকার আর তাসবিহ-তাহলিলের নুরানি স্লোগান।

একজনের বিছানা অপরজন ব্যবহার করছে। একজনের মালপত্র মাড়িয়ে অপরজন এগিয়ে যাচ্ছে সামনের কাতারে। একজন আরেকজনকে ডিঙিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ অন্যের বিছানা মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। একজনের গায়ের ওপর দিয়েও যেতে হচ্ছে অন্যজনকে। বাথরুমের সামনে লম্বা লাইন। অজুখানায় মানুষের ভীড়। গোসলের সুযোগ পাচ্ছেন অনেকেই। তবু কেউ অধৈর্য হচ্ছে না। ধৈর্যের এ যেন এক অবিশ্বাস্য চিত্র। কারো মুখে বিরক্তির লেশমাত্র নেই। অধৈর্য হয়ে কেউ খেদ প্রকাশ করছে না। এ যেন স্বেচ্ছায় কষ্ট সয়ে নেওয়ার এক বিস্ময়কর দৃশ্য। সহিষ্ণুতার এক বিরল দৃষ্টান্ত।

মানুষের মনে হেদায়াতের ঢেউ দোলায়িত হচ্ছে। একটি নিরব আবেদন সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে। সহিষ্ণুতার এক নজীরবিহীন চিত্র ফুটে উঠেছে। সবাই যেন সহ্যের সাগরে অবগাহন করছে। ধৈর্যের তরঙ্গায়িত ঢেউ আছড়ে পড়েছে পুরো এলাকায়। এলাকাবাসী নিজ ঘরদোরকে ওয়াকফ করে দিয়েছে। মুসল্লিরা অন্য ভাইকে জায়গা করে দিচ্ছে। ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

মানবচরিত্রের সবচে উন্নত চরিত্র হলো ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। পবিত্র কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা বহু জায়গায় নিজেকে ধৈর্যধারণকারী ও সর্বসহিষ্ণু হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, 'এবং আল্লাহই তো সম্যক প্রজ্ঞাময়, পরম সহনশীল। ' সূরাহজ : ৫৯

ধৈর্যকে আরবিতে বলা হয় সবর। আর সহিষ্ণুতার আরবি হলো, হিলম। সবর ও হিলম শব্দদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ পার্থক্য রয়েছে। সাধারণত সবর তথা ধৈর্য হলো অপারগতার কারণে বা অসমর্থ হয়ে প্রতিকারের চেষ্টা বা প্রতিরোধ না করা। আর হিলম তথা সহিষ্ণুতা হলো, শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ গ্রহণ না করা। এ দিক দিয়ে হিলম বেশি উন্নত। তবে এ উভয় শব্দ কখনো কখনো উভয় অর্থে এবং একে অন্যের স্থানে ব্যবহৃত হয়।

হিলম তথা সহিষ্ণুতা সম্পর্কে মহাগ্রন্থ কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘... এবং আল্লাহই তো সম্যক প্রজ্ঞাময়, পরম সহনশীল। ’ –সূরা হজ: ৫৯

সবর, অর্থাৎ ধৈর্য সম্পর্কে কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আমি তো তাকে পেলাম ধৈর্যশীল। কতই না  উত্তম বান্দা সে! সে ছিল আমার অভিমুখী। ’ –সূরা সাদ: ৪৪

কোরআনে কারিমে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় এতে তো নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক পরম ধৈর্যশীল ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য। ’ সূরা ইবরাহিম: ৫

লক্ষ্য করলে প্রতীয়মান হয়, ইজতেমার মুসল্লিরা সবরকে ছাপিয়ে হিলম তথা সহিষ্ণুতার গুণ অর্জন করে নিচ্ছেন। চাইলে প্রতিকার করতে পারেন, কিন্তু সামর্থ্য থাকা সত্বেও সহিষ্ণুতা অবলম্বন করছেন। কেউ অসহিষ্ণু হলেও অন্যজন তাকে নম্রতার সঙ্গে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। সহিষ্ণুতা ও সবরের পরকালীন ফায়দার তালিম পেয়ে একজন সাধারণও হয়ে উঠছে সত্যিকারের সহিষ্ণু, প্রকৃত হালিম।

ধৈর্যের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেছেন, ‘মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়। ’ –সূরা আসর : ১-৩

ইজতেমার ময়দানে আগত মুসল্লিদের ধৈর্য অবলম্বনের আসলে কোরআনি নির্দেশনারই বাস্তবায়ন।

ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার রয়েছে জাগতিক ও পরকালীন অসামান্য প্রতিফল। দুনিয়া ও আখেরাতে ধৈর্য্য ধারনকারীর সাফল্য সুনিশ্চিত। ব্যক্তি তার সবর ও হিলমের সুফল সর্বদাই পেতে থাকে। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন খোদ ধৈর্য ধারনকারীর সঙ্গে থাকেন। আর আল্লাহ যার সঙ্গে থাকেন, সে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াব। মহাগ্রন্থ কোরআনে কারিমে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। -সূরা আল বাকারা: ১৫৩

বস্তুত দ্বীনের দাওয়াত, বিশ্ব মুসলিমের পরকালীন মুক্তি, ঈমানের মেহনত, নিজে সংশোধন ও অপরকে সংশোধনের শিক্ষাসহ বিশ্ব ইজতেমা থেকে মানুষ ধৈর্য ও সহনশীলতার সুমহান শিক্ষা পাচ্ছে।

সে হিসেবে বলা চলে, বিশ্ব ইজতেমা মুসলিম উম্মাহকে শুধুমাত্র আমলের শিক্ষাই দেয় না, বরং উন্নত চরিত্র গঠনেও বিশ্ব ইজতেমা অসামান্য অবদান রেখে চলেছে।



বাংলাদেশ সময়: ১৪০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৬
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।