সমাজের বিভিন্ন জন বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালার কাছে মর্যাদাবান হিসেবে উপস্থিত হতে চান। কিন্তু আল্লাহতায়ালার কাছে প্রকৃত মর্যাদাবান কারা তাদের পরিচয় দিয়ে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো এবং মসজিদে হারামের সেবা ও রক্ষণাবেক্ষণ করাকে সেই লোকের কাজের সমান মনে কর, যে ঈমান রাখে আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি এবং যুদ্ধ করছে আল্লাহর রাহে? অল্লাহর নিকট তো এই দুই শ্রেণীর লোক এক সমান নয়।
বর্ণিত আয়াত চারটিতে প্রকৃত পুণ্য ও মর্যাদার কাজ কোনটি তা নিয়ে চিন্তাগত দিক থেকে অবিশ্বাসীরা যে ভ্রান্তিতে নিপতিত ছিল, তা নিরসন করে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে যে, শিরকমিশ্রিত আমল তা যতই বড় হোক না কেন, তা আল্লাহর কাছে কবুলযোগ্য নয় এবং এর কোনো মূল্য নেই। সে কারণে কোনো মুশরিক মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণ ও হাজীদের পানি সরবরাহ দ্বারা মুসলমানদের সমতুল্য ফজিলত ও মর্যাদা লাভ করতে পারে না। মুশরিকি ধ্যান-ধারণা সংশোধন করার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম সমাজে বিদ্যমান ভ্রান্ত ধারণার নিরসন হয়েছে এ আয়াতসমূহের মাধ্যমে।
যেমন কোনো জিয়ারত কেন্দ্রের গদ্দীনশীন হওয়া বা খাদেম হওয়া। এই ধরনের প্রদর্শনীমূলক কতগুলো ধর্মীয় কাজকর্ম ও অনুষ্ঠান পালন দুনিয়ার স্থূল দৃষ্টিসম্পন্ন লোকেরা সাধারণত শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য করে থাকে। কিন্তু বাস্তবে আল্লাহর নিকট এ গুলোর কোনো মূল্য নেই।
প্রকৃত পক্ষে এ আয়াত চারটির মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ইসলাম গ্রহণের পর অর্থাৎ মুসলমানদের জন্য ঈমান ও জেহাদের মর্যাদা সময় ও সুযোগ মতো কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান জাঁকজমকের সঙ্গে পালন, মসজিদুল হারামের রক্ষণাবেক্ষণ, হাজীদের খেদমত ইত্যাদির চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মুমিনের প্রকৃত মর্যাদা রয়েছে ঈমান ও খোদার পথে ত্যাগ স্বীকারের মধ্যে।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সর্বোত্তম মর্যাদাবানদের পরিচয় নিরূপণ করতে গিয়ে আমরা বলতে পারি, ‘বাস্তব কথা এই যে, যারা নবীর সর্বোত্তম সংশ্রব গ্রহণ করার সৌভাগ্য লাভ করেছেন, তারাই হলেন সর্বোত্তম উম্মত। ’
যেসব বান্দাকে খোদায়ী কিতাবের উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়েছে তারা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘অতঃপর আমার বান্দাদের মধ্যে তাদেরই আমি আল কিতাবের উত্তরাধিকারী করেছি, যাদের আমি নির্বাচন করেছি তাদের মধ্যে কেউ স্বীয় সত্তার ওপর অত্যাচারী আবার কেউ মধ্য পন্থা অবলম্বনকারী আবার কেউ আল্লাহর হুকুমে সৎ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী। এটাই হলো আল্লাহর বড় ফজল। ’
কোরআনে কারিমে এই তিন শ্রেণীর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণী হলো- সেই সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম শ্রেণী, যারা কেবল হক পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়াকেই যথেষ্ট মনে করে না বরং হক পন্থীদের কাফেলার সর্বাগ্রে যেতে চান। এটাই হলো সেই মাকাম, যা অন্য একপ্রকারে শ্রেণী বিভাগ করলে সালেহিনদের ঊর্ধ্বে আরোহন করে সত্যের সাক্ষীদের স্তরে পৌঁছে যায়। অতঃপর সিদ্দিকি মাকামে পৌঁছে মানবতার সর্বোচ্চ শিখর ও কামালিয়াতের উৎস অর্থাৎ মাকামে নবুওয়তের সঙ্গে মিলিত হয়ে যায়।
মানবজাতির মধ্যে আল্লাহতায়ালা যাদের মান ‘আনয়ানমাল্লাহু আলাইহিম’-এর দলভুক্ত করেছেন, তারা এই চার প্রকারের বাইরে নন। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ ওই পবিত্র বান্দা, যাদের তিনি নিয়ামত দান করেছেন তারা হলেন আম্বিয়ায়ে কিরাম, সিদ্দিকিন, শুহাদা ও সালেহিন। ’ –সূরা আন নিসা : ৬৯
সৎকর্মশীলদের পুরস্কার সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষণা হলো, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে তারা হবে ওই সব জান্নাতের অধিবাসী যার নিচ দিয়ে নহর প্রবাহিত হবে, তারা সেখানে চিরদিন বসবাস করবে। এটাই হলো বড় পুরস্কার বা ফওজে কাবির। ’ –সূরা বুরুজ : ১১
উল্লিখিত তিন শ্রেণীর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণী যারা সৎ কাজে অগ্রভাগে থাকবে তাদের থেকেও অগ্রে পৌঁছে যায় মোকাররব শ্রেণি। তাদের ফওজে কাবির তথা মহা পুরস্কারের চেয়ে ও অধিক মূল্যবান আল্লাহর বিশেষ নৈকট্যের দ্বারা সম্মানিত করা হবে। ‘যারা সৎ কাজের অগ্রভাগে থাকে তাদের ও যারা আগে পৌঁছে, তারাই জান্নাতে মুর্কারব তথা বিশেষ নৈকট্য লাভকারী হবেন। ’ –সূরা ওয়াকিয়া : ১০-১২
এই সৎ কাজের প্রতিযোগিতায় অগ্রগামী থাকাকেই পবিত্র কোরআনে কারিমে ‘আজমে উমুর’ বলা হয়েছে।
আজমে উমুরের বিভক্তির ফলস্বরূপ নেককারদের দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যার দ্বিতীয় শ্রেণি প্রথম শ্রেণির তুলনায় উচ্চমর্যাদার অধিকারী।
এ বিষয়ে ইরশাদ হচ্ছে, ‘ক্ষতিগ্রস্ত লোক ছাড়া মুসলমানদের মধ্যে যারা জিহাদে অংশগ্রহণ করে না তারা ওই সব মুসলমানের সম মর্যাদার নয়, যারা জান ও মালসহ জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছে। ’ -সূরা আন নিসা : ৯৫
তবে এ কথা সত্য যে, উভয় প্রকার লোকই মুমিন ও সৎ এবং আল্লাহতায়ালা উভয় প্রকার লোকের জন্য জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। কিন্তু যারা জিহাদে অংশগ্রহণ করেনি, তাদের তুলনায় মুজাহিদদের আল্লাহ বড় ফজিলত ও মর্যাদা দান করছেন।
নেককারদের শ্রেণীসমূহের ব্যাখ্যা বিভিন্ন হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে। তন্মধ্যে মুসলিম শরিফের একটি হাদিস এখানে উল্লেখ করা হলো। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমার পূর্বে সব নবীর উম্মতের মধ্যে এমন কিছু সাহায্যকারী ও সাথী বিদ্যমান ছিল যারা তার মতো ও পথ ধারণ করতো এবং তার হুকুমের অনুসরণ করতো। পরবর্তী কালে তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। তারা এমন সব কথা বলে যা তারা নিজেরা করে না এবং তারা করে ওই সব কাজ যা তাদের নিষেধ করা হয়েছিল। এরূপ গুণ বিশিষ্ট লোকদের সঙ্গে যে জন হাতের দ্বারা জিহাদ করে সে মুমিন, যে মুখের দ্বারা জিহাদ করে সে মুমিন এবং যে অন্তর দ্বারা জিহাদ করে সে মুমিন। এই তিন স্তরের পর সরিষা পরিমাণ ঈমানও কারুর মধ্যে থাকে না।
উল্লিখিত হাদিসে তিনটি শ্রেণীর উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম শ্রেণি হল তাদের, যারা আজিমতের অধিকারী। দ্বিতীয় শ্রেণি হলো, রুখসত গ্রহণকারীদের যারা শরিয়তের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। তৃতীয় শ্রেণি দুর্বলদের এবং ঈমানের সীমা এখানেই শেষ হয়। এরপর সরিষা পরিমাণও ঈমান আর অবশিষ্ট থাকে না। ’
মর্যদায় অগ্রগামীদের পরিচয়ের পরে উক্ত মর্যাদাশীল লোকদের পুরস্কার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘তাদের প্রতিপালক তাদের জন্য সুসংবাদ দিয়েছেন স্বীয় দয়া ও সন্তোষের এবং জান্নাতের। যেখানে রয়েছে স্থায়ী শান্তি এবং সেখানে থাকবে চিরদিন, আর আল্লাহর কাছে রয়েছে মহান পুরস্কার। ’
এই মর্যাদা লাভের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের ভালোবাসা। যারা ঈমানের ওপরে কুফরকে ভালোবাসে তাদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করা অর্থাৎ ইসলামের নীতি-বিধানের বিপরীত বিধান মেনে নেওয়া হবে সীমা লঙ্ঘনের আচরণ।
প্রকৃত পক্ষে আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের সব সম্পর্কের ওপর আল্লাহ ও রাসূলের সম্পর্ক অগ্রগণ্য। এ কথাই বলা হয়েছে পরবর্তী দু’টি আয়াতে। উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মানবগোষ্ঠী সাহাবায়ে কেরাম সর্ব ক্ষেত্রে ও অবস্থায় সর্বপ্রকার সম্পর্কের ওপর আল্লাহ ও রাসূলের সম্পর্ককে প্রধান্য দিয়েছেন। হিজরত ও জিহাদের আহ্বান আসার পরও যারা তা বাদ দিয়ে অন্য সব আমলের ওপর নিজদের সংশ্লিষ্ট রাখতে চায়, যারা আত্মীয়-স্বজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় নিজ গৃহে আরাম-আয়েশে দিন গুজরান করতে চায় তারা আল্লাহর অভিশাপে নিপতিত হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৬
এমএ/