মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যম হলো ভাষা। প্রত্যেক জাতি, জনপদ বা এলাকার মানুষের জন্য আলাদা আলাদ ভাষা রয়েছে।
বাঙালি জাতির মুখের ভাষা হলো বাংলা ভাষা। সুতরাং বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে দ্বীনের বাণী পৌঁছাতে হলে বাংলা ভাষাসাহিত্যের চর্চা ও অনুশীলনের বিকল্প নেই।
কোনো ভাষার সমৃদ্ধি আন্দাজ করা যায় সে ভাষার রচনাসম্ভার দেখে। যে ভাষার বই-পুস্তক যতটা যথার্থ ও পর্যাপ্ত, সে ভাষা ততটাই সমৃদ্ধ। রচনাসম্ভারের যথার্থতা ও পর্যাপ্ততার দিক দিয়ে বাংলা ভাষা খুবই সমৃদ্ধ একটি ভাষা। ভাষা-সাহিত্যের অবদান বিশ্লেষণে যদিও নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের রচনাবলীকে আলাদা করে দেখিয়ে প্রভেদ সৃষ্টি করার সুযোগ নেই। তবে এতটুকু অবশ্যই বলা যেতে পারে যে, বাংলা ভাষায় যারা অসামান্য অবদান রেখেছেন, তন্মধ্যে মুসলিম মনীষাদের নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মুসলিম সাহিত্যিক-লেখকদের অবদানকে স্মৃতিবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে নিম্নে মুসলিম মনীষাদের বাংলা ভাষাসাহিত্যে অবদান সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো।
মুসলমানরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসে সুলতানি আমলে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাদের সব থেকে বড় অবদান মনে করা হয় কাহিনীকাব্য বা রোম্যান্টিক কাব্যধারার প্রবর্তনকে।
দেখা গেছে, ওই সময়ে মুসলমানদের রচিত সাহিত্যে 'মানুষ' প্রাধান্য পেয়েছে। সে হিসেবে বিষয়বস্তুর দিক থেকে মধ্যযুগের মুসলমানদের রচিত কাব্যগুলোকে প্রধানত ছয় ভাগে ভাগ করা যায়; কাহিনীকাব্য, ধর্মীয় কাব্য, সংস্কৃতিবিষয়ক কাব্য, শোকগাঁথা, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় কাব্য এবং সঙ্গীতশাস্ত্রীয় কাব্য।
ওই সময়কার মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছেন- শাহ মুহম্মদ সগীর। তার কাব্য 'ইউসুফ-জুলেখা' সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৮৯-১৪১০) রচিত বলে মনে করা হয়। এর সব পুথি চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা ও ভারতের ত্রিপুরা) থেকে পাওয়া গেছে। নবী হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সংক্ষিপ্ত কাহিনী যা ফেরদৌস ও জামীর ইউসুফ-জুলেখায় পল্লবিত, সেটাকে তিনি বাংলায় একটি মৌলিক কাব্যের মর্যাদা দিয়ে গ্রন্থিত করেছেন।
জৈনুদ্দীন একটিমাত্র কাব্য 'রসুলবিজয়' রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি গৌড় সুলতান ইউসুফ শাহের (১৪৭৪-৮১) সভাকবি ছিলেন। এর গল্পাংশ ফারসি থেকে নেওয়া।
মুজাম্মিল ১৫শ' শতকের মধ্যবর্তী সময়ের কবি ছিলেন। তিনি প্রধানত তিনটি কাব্যের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন, 'নীতিশাস্ত্রবার্তা', 'সায়াৎনামা' ও 'খঞ্জনচরিত'। আরবির অনুবাদ সায়াৎনামায় সুফিবাদ স্থান পেয়েছে এবং অনুবাদ ঝরঝরে হওয়ায় কাব্যটি আকর্ষণীয় হয়েছে। তার নীতিশাস্ত্রবার্তায় অনেক বিষয় লিপিবদ্ধ হয়েছে।
দোনাগাজীর বিখ্যাত কাব্য 'সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল'। তিনি সম্ভবত ১৬শ' শতকের মধ্যভাগে আবির্ভূত হন। তার ভাষা সাধারণ এবং প্রাকৃত-প্রভাব; সারল্যের মিশ্রণে প্রাচীনত্বের দ্যোতক।
শেখ ফয়জুল্লাহ মধ্যযুগের মুসলিম কবিদের মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। যে পাঁচটি গ্রন্থের জন্য তিনি খ্যাতিমান, সেগুল হলো- 'গোরক্ষবিজয়', 'গাজীবিজয়', 'সত্যপীর (১৫৭৫)', 'জয়নবের চৌতিশা' এবং 'রাগনামা'। রাগনামাকে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সঙ্গীতবিষয়ক কাব্য মনে করা হয়। দৌলত উজীর বাহরাম খাঁর একটিমাত্র কাব্য পাওয়া গেছে এবং সেটি হলো 'লায়লী-মজনু'; এর রচনাকাল ১৫৬০-৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অনুমান করা হয়। এটি ফারসি কবি জামীর 'লাইলী-মজনু' কাব্যের ভাবানুবাদ; তবে স্বচ্ছন্দ রচনা, কাব্যরস ইত্যাদি গুণে এটি অনন্য।
এ ছাড়া মধ্যযুগে অন্যান্য মুসলমান কবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- সৈয়দ সুলতান (আনু. ১৫৫০-১৬৪৮, কাব্য: নবীবংশ, শব-ই-মিরাজ, রসুলবিজয়, ওফাৎ-ই-রসুল, জয়কুম রাজার লড়াই, ইবলিসনামা, জ্ঞানচৌতিশা, জ্ঞানপ্রদীপ, মারফতি গান, পদাবলি), নসরুল্লাহ্ খাঁ (আনু. ১৫৬০-১৬২৫, কাব্য: জঙ্গনামা, মুসার সওয়াল, শরীয়ৎনাম।
আধুনিক যুগে শেখ আবদুর রহিম বাংলা ভাষার মাধ্যমে যেভাবে বাঙালি মুসলমানদের ঐতিহ্য সন্ধান এবং মানব সভ্যতায় ইসলামের অবদান তুলে ধরার চেষ্টা করেন, তেমনিভাবে আর কেউ করেননি বলে অনেকে মনে করেন। তার প্রথম গ্রন্থ হজরত মহাম্মদ (সা.) 'র জীবনচরিত ও ধর্মনীতি (১৮৮৭) তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তিনি সুধাকর, মিহির, হাফেজ, মোসলেম প্রতিভা, মোসলেম হিতৈষী প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মোহাম্মদী পত্রিকায় তিনি যেসব প্রবন্ধ লেখেন তা থেকে সেকালের মুসলিম বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়।
মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ছিলেন একাধারে রাজনৈতিক কর্মী, সমাজসেবক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সুবক্তা। তিনি প্রধানত ইতিহাসমূলক রচনার জন্যই খ্যাতি লাভ করেন। 'ভারতে মুসলমান সভ্যতা' তার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি।
আধুনিক যুগের আরো কয়েকজন বিশিষ্ট মুসলমান লেখক হচ্ছেন- দীন মোহাম্মদ, এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪০), কাজী আকরম হোসেন (১৮৯৬-১৯৬৩) প্রমুখ। ইসলামের ইতিহাস (১৯২৪) গ্রন্থটি রচনা করে সুবিখ্যাত হলেও কাজী আকরম হোসেন সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অবদান রাখেন।
মুসলিম মানসে যুক্তিবাদী মননচর্চার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা তিরিশের কালে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রতিষ্ঠা। এই সমাজের মুখপত্র শিখা পত্রিকার নামে পরিচিত ‘শিখাগোষ্ঠী’ বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন করে সাহিত্য-ভাবনার সম্পূর্ণ নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করে। শিখাগোষ্ঠীর প্রাণপুরুষ ছিলেন আবুল হুসেন (১৮৯৬-১৯৩৮) এবং প্রধান লেখক কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০)।
ভারত ভাগের পর এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে যে সাহিত্যের ধারা নির্মিত হয়েছ তাতে সমধিক। উল্লেখযোগ্য হলেন গোলাম মোস্তফা। গোলাম মোস্তফার (১৮৯৭-১৯৬৪) সাহিত্যচর্চার ব্যাপ্তি দেশ ভাগেরপূর্ব কাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান পর্যায়েও বিস্তৃত। বাংলা সাহিত্যে ইসলামি ভাবধারার রূপায়ণ ছিল তার সাহিত্যসাধনার প্রধান লক্ষ্য। সব পরিস্থিতিতে তিনি তার মৌলিকত্ব বজায় রাখেন। গোলাম মোস্তফার সেরা রচনা বিশ্বনবী (১৯৪২) রসুলুল্লাহ্ (সা.)-র শ্রেষ্ঠ জীবনী গ্রন্থগুলির অন্যতম। এ গ্রন্থে তার গদ্যবৈশিষ্ট্য চূড়ান্তরূপ লাভ করেছে।
এ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকজন হলেন মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৮৮৫-১৯৬৯), এস ওয়াজেদ আলী (১৮৯০-১৯৫১), কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩), মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪), কবি বন্দে আলী মিয়া (১৯০৭-১৯৭৫) ও বেগম সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯) প্রমুখ। -সূত্র : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস/মাহবুবুল আলম
এ ছাড়াও বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা তাফসির রচনা করে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য বাংলা ভাষায় তাফসির অধ্যয়ন ও ইসলামচর্চায় নবধারা আবিষ্কার করেছেন আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) (১৮৯৬-১৯৬৯)। তার রচিত হক্কানী তাফসির নামক বাংলা তাফসিরটি প্রায় সতের হাজার পৃষ্ঠাব্যাপী। এ ছাড়া ইসলামি বিধি-বিধান সম্বলিত অন্যতম গ্রন্থ বেহেশতি জেওরের বঙ্গানুবাদও তিনি করেছেন। ইসলামি বিধি-বিধানের অালোকে একজন মুসলমানকে জীবনে যত বিষয়ের সম্মুখীন হতে হয়, এর প্রায় সব বিষয়েই তিনি রচনা করেছেন কালজয়ী সব গ্রন্থ। পারিবারিক ও দাম্পত্য বিষয়ক গ্রন্থ 'আদর্শ মুসলিম পরিবার', ব্যক্তিগত আমলের জন্য 'জীবনপাথেয়', লেনদেনবিষয়ক 'সাফাই-য়ে মুয়ামালাত', অধিকার বিষয়ক 'মা-বাবা ও সন্তানের হক', আধ্যাত্মিক বিষয়ে 'তাসাউফতত্ত্ব' -সহ তার রচিত ও অনুদিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক।
হাদিস শাস্ত্রের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য কিতাব সহিহুল বোখারির প্রথম বাংলা অনুবাদ করে হাদিসশাস্ত্রে বাংলায়নের পথ নির্মাণ করে অনবদ্য অবদান রেখেছেন আল্লামা আজিজুল হক শাইখুল হাদিস রহ. (১৯১৯-২০১২)।
এ ছাড়াও সমসাময়িকদের মধ্যে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান 'মাআরেফুল কুরআন বাংলা' অনুবাদসহ ও বাংলাভাষায় বিশুদ্ধ সিরাতচর্চা করে বাংলা ভাষাকে অন্যরকম উচ্চতা দান করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৬
এমএ/