সন্তানের প্রতি স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসা মানুষের সহজাত। ভালোবাসার শক্ত এ ভিতের ওপরই টিকে আছে মানবজাতি, দাঁড়িয়ে আছে মানবসভ্যতা।
সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার প্রপাঢ় ভালোবাসার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জেনে রেখো! নিশ্চয় সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি (এর মোহ ও মমতা) তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা। ’ -সূরা আনফাল : ২৮
অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য। ’ -সূরা কাহাফ : ৪৬
এ ছাড়াও পবিত্র কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা সন্তানের প্রতি নবীদের স্নেহ ও মমতার একাধিক দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। যেমন, প্রিয় সন্তান হজরত ইউসুফকে হারিয়ে হজরত ইয়াকুবের ব্যাকুলতার বর্ণনা। সন্তানের জন্য কাঁদতে কাঁদতে তার দৃষ্টিশক্তি পর্যন্ত লোপ পায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং সে বললো, আফসোস ইউসুফের জন্য! শোকে তার দু’চোখ সাদা হয়ে গেছে এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট। তারা বললো, আল্লাহ শপথ! আপনি ইউসুফের কথা ভুলবেন না, যতোক্ষণ না আপনি মুমূর্ষ হবেন অথবা মৃত্যুবরণ করবেন। ’ -সূরা ইউসুফ : ৮৪-৮৫
দীর্ঘ বিচ্ছেদের পরও সন্তানের প্রতি তার ভালোবাসা ও মমতা ছিলো অক্ষুণœ। পুত্র ইউসুফের শরীরের গন্ধ পর্যন্ত তিনি তখনও ভুলেননি। তার শরীরের গন্ধ টের পেয়ে বলেছিলেন, ‘নিশ্চয় আমি ইউসুফের গন্ধ পাচ্ছি। ’ -সূরা ইউসুফ : ৯৪
একইভাবে বিপদগামী সন্তানের ধ্বংস দেখে হজরত নুহ (আ.)-এর পিতৃহৃদয় কেঁদে ওঠে। তিনি আল্লাহর দরবারে আকুতি জানান, ‘হে আমার প্রভু! আমার ছেলে তো আমার পরিবারভুক্ত। আর তাদের (রক্ষার) ব্যাপারে আপনার অঙ্গীকারও সত্য। নিশ্চয় আপনি সর্বোচ্চ ন্যায় বিচারক। ’ -সূরা হুদ : ৪৫
সন্তান যেমনই হোক পিতা-মাতার অন্তরে তাদের জন্য স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসার একটি জায়গা সব সময় থাকেই। তারা সব সময় সন্তানের কল্যাণ কামনা করেন।
আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)ও ছিলেন তার সন্তান-সন্তুতি ও পরিবারের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল। তিনি তার সন্তানদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তুলনায় পরিবার-পরিজনের প্রতি অধিক স্নেহ-মমতা পোষণকারী আর কাউকে দেখিনি। ’ -আল আদাবুল মুফরাদ : ৩৭৬
হজরত রাসূলে আকরাম (সা.) ৭ সন্তানের জনক ছিলেন। তন্মধ্যে ৩ ছেলে হলো- কাসেম, ইবরাহিম ও আবদুল্লাহ। আর মেয়ে ৪ জন হলো- জায়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও ফাতেমা। ছেলেদের সবাই শৈশবে মারা যান। মেয়েদের মধ্যে হজরত ফাতেমা (রা.) ব্যতীত সবাই রাসূল (সা.)-এর পূর্বেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।
হজরত ফাতেমা (রা.)-এর দুই পুত্র হজরত হাসান ও হোসাইন (রা.)-এর মাধ্যমে রাসূল (সা.)-এর বংশের বিস্তৃতি ঘটে। রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর ৬ মাস পর হজরত ফাতেমা (রা.)ও ইন্তেকাল করেন। -মাওলানা আকবর শাহ খান নজিবাবাদী, ইসলামের ইতিহাস, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২২৮
সন্তান জন্মের সংবাদে রাসূল (সা.) আনন্দিত হতেন। হজরত আবু রাফে (রা.) যখন রাসূল (সা.) কে তার পুত্র ইবরাহিমের জন্মের সংবাদ দেন, তখন তিনি খুশি হয়ে তাকে একজন দাস বা সেবক দান করেন।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তার সন্তানদের নাম রাখেন। শুধু সন্তান নয় নাতি-নাতনির জন্যও সুন্দর সুন্দর নাম নির্বাচন করেন তিনি। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, হাসান জন্মগ্রহণ করলে আমি তার নাম রাখি ‘হারব’। অতপর রাসূল (সা.) আসলেন এবং বললেন, আমাকে আমার নাতি দেখাও। তোমরা তার কী নাম রেখেছো? হজরত আলি (রা.) বলেন, আমি বললাম, হারব। ’ রাসূল (সা.) বললেন, না। তার নাম হাসান। ’ -মুসনাদে আহমদ : ৭৬৯
রাসূল (সা.) তার সন্তান এবং নাতিদের জন্মের পর তাদের চুলের ওজনে রৌপ্য দান করেন এবং সবার নামে আকিকা করেন। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) হাসানের পক্ষ থেকে একটি ছাগল আকিকা করেন। এবং বলেন, ফাতেমা! হাসানের মাথা মুড়িয়ে দাও এবং তার চুলের সমপরিমাণ রৌপ্য সদকা করো। ’ -সুনানে তিরমিজি : ১৫১৯
শত ব্যস্ততার মাঝেও রাসূল (সা.) তার সন্তানদের আদর-যত্ন করতেন এবং খোঁজ-খবর রাখতেন। তাদেরকে কোলে তুলে আদর করতেন। চুমু খেতেন; এমনকি তাদের শরীরের ঘ্রাণ নিতেন।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তুলনায় পরিবার-পরিজনের প্রতি অধিক স্নেহ-মমতা পোষণকারী আর কাউকে দেখিনি। তার এক পুত্র (ইবরাহিম) মদিনার উপকণ্ঠে দুধ পান করতো। তার দুধমা ছিলো কায়না। আমরা তার কাছে যেতাম। ...রাসূল (সা.) তাকে চুমু খেতেন এবং তার ঘ্রাণ নিতেন। ’ -আল আদাবুল মুফরাদ : ৩৭৬
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদা (রা.) স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহকে দেখেছি, তিনি খুতবা দিচ্ছিলেন। অতপর হাসান ও হুসাইন (রা.) তার সামনে আসলো। তাদের গায়ে ছিলো লাল জামা। তারা পা পিছলে পরে যাচ্ছিলো আর দাঁড়াচ্ছিলো। রাসূল (সা.) নামলেন এবং তাদের দু’জনকে ধরে কোলে বসালেন। অতপর রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ সত্যই বলেছেন, নিশ্চয় সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা। আমি এ দু’জনকে দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারিনি। এরপর পুনরায় খুতবা শুরু করলেন। ’ -সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৬০০
রাসূল (সা.)-এর ভালোবাসা ও স্নেহ-মমতা শুধু ছেলে শিশুর জন্য ছিলো না; বরং তিনি তার পরিবারের কন্যা শিশুকেও সমান ভালোবাসতেন। হজরত আবু কাতাদা আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নিশ্চয় রাসূল (সা.) নামাজ আদায় করছিলেন। তার কোলে ছিলো- আবুল আস ইবনে রাবিআহ ও রাসূল (সা.)-এর মেয়ে জয়নব (রা.)-এর সন্তান উমামা। নবী করিম (সা.) সেজদা যাওয়ার সময় তাকে নামিয়ে রাখছিলেন এবং সেজদা থেকে দাঁড়িয়ে তাকে কোলে নিচ্ছিলেন। ’ -সহিহ বুখারি : ৫১৬
রাসূল (সা.) নিজে যেমন কন্যা সন্তানকে অবহেলা করতেন না, তেমনি কেউ পুত্র সন্তানের তুলনায় কন্যা সন্তানকে অবহেলা করলে রাসূল (সা.) তাকে সতর্ক করতেন। হজরত আনাসা (রা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট বসাছিলো। এ সময় তার পুত্র সন্তান তার কাছে এলো। সে তাকে চুমু দিলো এবং কোলে তুলে নিলো। এরপর তার কন্যা সন্তান এলো এবং সে তাকে সামনে বসিয়ে দিলো। এ দৃশ্য দেখে তিনি বললেন, এদের উভয়ের সঙ্গে একই রকম আচরণ করলে না কেনো?’ -মুসনাদে বাজ্জার : ৬৩৬১
সন্তান-সন্তুতি কান্না করলে রাসূল (সা.) বিচলিত হতেন। তাদেরকে কোলে তুলে নিয়ে শান্ত করতেন। একবার রাসূল (সা.)-এর কানে হজরত হোসাইন (রা.)-এর কান্না এলো। এতে তিনি ভীষণ ব্যথিত হলেন। তিনি হজরত ফাতেমা (রা.) কে বললেন, তুমি কী জান না তার কান্না আমাকে কষ্ট দেয়। ’ -দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, পৃষ্ঠা-১২৪
কন্যাদের সঙ্গে রাসূল (সা.) এর সুগভীর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। সুখে দুঃখে তিনি তাদের পাশে থাকতেন এবং তাদের খোঁজ-খবর নিতেন। তাদের সুখে তিনি আনন্দিত হতেন এবং দুঃখে ব্যথিত হতেন। তাদেরকে সান্তনা দিতেন। কখনও তারা রাসূল (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হলে আদর করে পাশে বসাতেন এবং একান্ত আলাপচারিতায় মেতে উঠতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘ফাতেমা হেঁটে আসলো। তার হাঁটার ভঙ্গিটা ছিলো যেনো রাসূল (সা.)-এর হাঁটার মতো। রাসূল (সা.) বললেন, আমার কন্যাকে অভিনন্দন। অতপর তিনি ফাতেমাকে তার ডান বা বাম পাশে বসালেন। নবী (সা.) তাকে গোপন কোনো কথা বললেন, ফলে সে কাঁদলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কাঁদছো কেনো? অতপর রাসূল (সা.) তাকে আরেকটি গোপন কথা বললেন, ফলে সে হাসলো। ’ -সহিহ বোখারি : ৩৬২৩
হজরত ফাতেমা (রা.) ছিলেন নবী করিম (সা.)-এর সবচেয়ে প্রিয় কন্যা। তার ব্যাপারে নবী করিম (সা.) বলতেন, ফাতেমা আমার দেহের একটি অংশ। যাতে তার কষ্ট হয়, তাতে আমারও কষ্ট হয়। ’ -সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভি রহ., নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা- ৪২৩
বিয়ের পরও রাসূল (সা.) তার কন্যাদের প্রতি লক্ষ রাখতেন। তাদের ভালো-মন্দের খোঁজ রাখতেন। বদর যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার কন্যা হজরত রুকাইয়া (রা.) অসুস্থ ছিলেন। তার সেবা-যত্নের জন্য স্বামী হজরত উসমান (রা.) কে মদিনায় রেখে যান। -সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভি রহ., নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা- ৪২৪
এমনিভাবে তার কন্যা হজরত জয়নব (রা.) স্বামীর মুক্তিপণ হিসেবে অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে মায়ের দেওয়া হার মদিনায় পাঠিয়ে দেন। রাসূল (সা.) হারটি দেখে স্মৃতিকাতর হন এবং তিনি অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেন। অতপর সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর সঙ্গে আলোচনা করে শুধু হারটি ফেরত দেন। -সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভি রহ., সীরাতে রাসূল আকরাম সা., পৃষ্ঠা- ১১৩
হজরত ফাতেমা (রা.) ব্যতীত রাসূল (সা.)-এর বাকি সব সন্তান তার জীবদ্দশায়ই মারা যান। পিতা হিসেবে রাসূল (সা.)-এর জন্য এ ছিলো সীমাহীন কষ্টকর এক অভিজ্ঞতা এবং ঈমানি পরীক্ষা। তিনি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। রাসূল (সা.) তার সন্তানদের মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছেন এবং কেঁদেছেনও। কিন্তু তিনি এমন কোনো আচরণ করেননি যাতে আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ পায়; তিনি তার সব কষ্টকে ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করেন। রাসূল (সা.)-এর পুত্র ইবরাহিম মারা গেলে তিনি বলেন, ‘আমাকে না দেখিয়ে তাকে কাফন পরিও না। অতপর তিনি আসেন এবং তার প্রতি ঝোঁকেন ও কাঁদেন। ’ -সুনানে ইবনে মাজা : ১৪৭৫
অশ্রসিক্ত নয়নে রাসূল (সা.) বলেন, ‘আমরা তোমার বিচ্ছেদে ব্যাথিত। চোখ অশ্রু ঝরাচ্ছে এবং অন্তর বিষাদগ্রস্থ। আমরা এমন কোনো কথা বলবো না যাতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। ’ -কানজুল উম্মাল : ৪২৪৫০
রাসূল (সা.) নিজেই শুধু সন্তান-সন্তুতি ও পরিবার-পরিজনকে ভালোবাসেননি; বরং তিনি প্রতিটি মুমিনকে সন্তানের প্রতি স্নেহশীল হতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা শিশুদেরকে ভালোবাস এবং তাদের প্রতি দয়া করো। তাদের সঙ্গে কোনো ওয়াদা করলে তা পূর্ণ করো। কেননা তারা তোমাদেরকে তাদের রিজিক সরবারহকারী বলে জানে। ’ -সহিহ বোখারি ও মুসলিম
সুতরাং প্রতিটি মুমিনের জন্য দায়িত্ব হলো, জীবনের সৌন্দর্য ও সম্পদ সন্তানের প্রতি স্নেহশীল হওয়া এবং তাদেরকে কল্যাণকামিতার সঙ্গে প্রতিপালন করা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৬
এমএ/