সৃষ্টির সেরারূপে মানুষকে সৃষ্টি করে আল্লাহতায়ালা প্রত্যেকের ওপর কোনো না কোনো দায়-দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। কর্মময় জীবনে মানুষ নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করবে, এটাই স্বাভাবিক।
জীবনের সর্বাবস্থায় ধর্মীয় রীতি-নীতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে বাস্তবতার সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করে ভূমিকা পালনের চেতনাই হল কর্তব্যপরায়ণতার মূল অঙ্গীকার। আল্লাহতায়ালা মানুষকে কর্তব্য পালনের নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে। ’
কর্তব্যপরায়ণতার পরিধি অনেক বিস্তৃত। মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চায়। সে খেয়ালখুশি অনুযায়ী চলতে পারে না। সমাজের সবার সুবিধার্থে ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হয়। শুধু ঘরে বসে অলস জীবনযাপনের কোনো অর্থ হয় না। এমনকি বিরাট অর্থ-বিত্তশালী ব্যক্তিও কাজকর্ম ছাড়া অলসভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পছন্দ করে না। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে সব মানুষের প্রতি পারস্পারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। তাই আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী মানুষকে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ হতে হবে। ইমানদারের প্রতিটি কর্তব্যই ইবাদত, যদি তা কল্যাণকর ও নিঃস্বার্থ হয়। এ প্রসঙ্গে হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘কর্মের ফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। ’ –সহিহ বোখারি
একজন মানুষের সার্র্বিক জীবনবোধের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যপরায়ণতা। নিজের দায়িত্ব ও শৃঙ্খলার জন্য কর্তব্যপরায়ণতার গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি মানুষের অন্যতম কাজ। তাই নবী করিম (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তোমার নিজের প্রতি কর্তব্য রয়েছে। ’-সহিহ বোখারি
ইসলামে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বায়োজ্যেষ্ঠ ও বয়ঃকনিষ্ঠ সবার প্রতি পারস্পারিক দায়িত্ববোধকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সব সময় পিতা-মাতার আদেশ-নিষেধ মান্য করা এবং তাদের সঙ্গে সৌজন্যময় আচরণ করা মানুষের একান্ত কর্তব্য। পিতা-মাতা, সন্তান-পরিজনের প্রতি বিশেষ কর্তব্য রয়েছে। পিতা-মাতার প্রতি অবহেলা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তাদের সেবা করার জন্য পবিত্র কোরআনে বর্ণিত রয়েছে, ‘তোমরা পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্বব্যবহার করবে। ’
আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালনের বিশেষ দিক নির্দেশনাও ইসলামে রয়েছে। পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের সহায়তা করা এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা একান্ত কর্তব্য। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত রয়েছে, ‘সত্যিকার কর্তব্যপরায়ণ তারাই যারা আত্মীয়স্বজনকে তাদের প্রিয় ধন-সম্পদ দান করে। ’
যে পাড়া-প্রতিবেশীর বিপদে-আপদে সাহায্য-সহযোগিতা করে এবং প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না সেও কর্তব্যপরায়ণ মানুষ। এ বিষয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির প্রতিবেশী তার অত্যাচার ও অন্যায় আচরণ থেকে রক্ষা পায় না, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ’-সহিহ মুসলিম
সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীদের সঙ্গে কোনো রকম অপ্রীতিকর কর্মকাণ্ড ও দ্বন্দ্ব-কলহ করা যাবে না। সর্বদা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হবে। শিক্ষার্থী বন্ধুদের বই, খাতা, কলম, পেনসিল না থাকলে এগুলো দিয়ে তাকে সাহায্য করা কর্তব্য। পিতা-মাতা যেমন সন্তানের লালন-পালন করেন, তেমনি শিক্ষকও ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলেন, তাই শিক্ষকদের যথাযথ শ্রদ্ধা করা, তাদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলা উচিত। ধনী লোকরা দরিদ্র-অসহায়দের সাহায্য করবে এবং গরিবরা ধনীদের সহযোগিতা করবে, এটাই ইসলামের বিধান। সুতরাং অনাথ, মিসকিন, দুস্থ ও হতদরিদ্র ব্যক্তিদের সর্বাত্মক সাহায্য-সহায়তা করা অপরিহার্য। পবিত্র কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘আর তাদের (ধনীদের) সম্পদে প্রার্থী ও ধনীদের অধিকার রয়েছে। ’
কর্মজীবনে মালিকপক্ষ কর্তব্যরত শ্রমিকদের সঙ্গে অবশ্যই উত্তম ব্যবহার করবে। শ্রমিক-কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানে মালিকের কাজকর্মে কোনো রকম ফাঁকি দেবে না। কর্মচারীরা মন-প্রাণ দিয়ে স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে থাকবে। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের নির্ধারিত পারিশ্রমিক ঠিকমতো দিয়ে দেবে। শ্রমিক ও মজুরের উপর কোনো ধরনের জুলুম-নির্যাতন ও শোষণ করবে না। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিককে তার ঘাম শুকানোর আগে পারিশ্রমিক দিয়ে দাও। ’
দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার পরিণাম খুবই ভয়াবহ। কর্তব্যে অবহেলা, অমনোযোগিতা প্রভৃতি নানা ধরনের বিপদ, ব্যর্থতা ও বিপর্যয় ডেকে আনে। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় কর্তব্যপরায়ণতা একটি আমানত এবং মনুষ্যত্বের প্রতীক। পরিবারে পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্যে অবহেলার দরুন সুখের সংসার ধ্বংস হয়ে যায়; ছেলেমেয়েরা পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিপথগামী ও উদাসীন হয়। তারা ঠিকমতো পড়াশোনা না-করে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। এভাবে প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন না করলে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সমাজ জীবনে নানাবিধ ক্ষতি সাধিত হয়।
হাদিস শরিফে কর্তব্যপরায়ণতার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে- শাসক, স্বামী, স্ত্রী, দাস প্রত্যেকেরই জবাবদিহির বিষয় রয়েছে। তাই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকেরই রক্ষক এবং তোমাদের সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। ’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
সমাজ, দেশ ও জাতির উন্নয়ন এবং অগ্রগতি প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ দায়িত্ব কর্তব্যপরায়ণতার ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে দায়িত্বসচেতন থাকে এবং প্রত্যেকে নিজের কাজটুকু ঠিকমতো সম্পন্ন করে, তা হলে কোনো কাজই অবহেলিত হয় না। তখন সমাজ উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে চলতে থাকে এবং দেশ ও জাতি সমৃদ্ধশালী হয়।
তাই মানবজীবনে সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ণতার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। জাতি-বর্ণ-ধর্ম-সম্প্রদায়-দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজ, দেশ ও জাতিকে পুনর্গঠন করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৬
এমএ/