মানুষকে আল্লাহতায়ালা ভালো-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর, কল্যাণ-অকল্যাণ বুঝার জন্য একটি কলব বা অন্তর দিয়েছেন। যার মাধ্যমে মানুষ তার চলার পথ বেছে নিতে পারে।
অন্তরে রোগ হলে, অসুস্থতা দেখা দিলে চিকিৎসা দেওয়া দরকার। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জেনে রেখো! শরীরের মধ্যে এমন এক টুকরো গোশত রয়েছে, যা সুস্থ থাকলে সারা শরীর সুস্থ থাকে, আর এটা অসুস্থ হলে সারা শরীরই অসুস্থ হয়ে যায়। জেনে রেখো, আর এটাই হলো কলব বা অন্তর। ’ –সহিহ বোখারি
মানুষের অন্তর ভালো থাকলে কাজ ভালো হয়, অন্তর খারাপ হলে কাজে মনোযোগ থাকে না। কাজ অগোছালো হয়ে যায়। অন্তরকে ভালো রাখতে হবে, মসৃণ রাখতে হবে, রোগমুক্ত রাখতে হবে। পবিত্র অন্তরে পাপ ঢুকতে পারে না। শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে। অন্তরকে কুচিন্তা-কুবুদ্ধির হাত থেকে রক্ষা করা যায়। এর অন্যথা হলে অন্তর কঠিন হয়ে যায়।
জ্ঞানীরা বলেন, হৃদয় এবং মস্তিষ্কের মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব জাগে, তখন তুমি হৃদয়কেই গ্রহণ করো। কারণ বুদ্ধিমান মানুষের চেয়ে হৃদয়বান মানুষ অনেক শ্রেয়। বুদ্ধিমান বুদ্ধি দিয়ে ভালোও করতে পারে, মন্দও করতে পারে, কিন্তু হৃদয়বান কেবল ভালোই করবে। মন্দ বা পাপ কাজ, মন্দ চিন্তা ও শয়তানি কর্মকাণ্ড জীবনকে গ্রাস করে ফেলে।
অন্তর কঠিন হলে মানুষ আল্লাহর আজাব ও জাহান্নামের শাস্তির কথা শুনলে মন কাঁদে না, ভয়ভীতির উদ্রেগ হয় না। আর তখন মানুষের ইহলৌকিক জীবনে অমানিশা নেমে আসে এবং পারলৌকিক জীবনে মুক্তির দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কিয়ামতের দিন কোনো অর্থসম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি কারো কোনো উপকারে আসবে না। একমাত্র সে ব্যক্তি মুক্তি পাবে, যে সুস্থ কলব বা অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে পৌঁছবে। ’ -সূরা শোয়ারা : ৮৮-৮৯
অন্তর সুস্থ রাখার জন্য প্রত্যেক মানুষের সৃদৃঢ় প্রচেষ্টা থাকা দরকার। কেননা কলব অসুস্থ হয়ে পড়লে মানুষের অন্তর কঠিন হয়ে যায়; আর কঠিন অন্তরে আল্লাহর আনুগত্যে ও ভালো কাজে অলসতা জন্মায়। ইবাদতে মনোযোগ হারিয়ে যায়। লোক দেখানো ইবাদত করা হয়। মন্দ কাজের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। মুনাফেকি চরিত্র ফুটে ওঠে। নামাজ পড়বেন কিন্তু অন্তরে আল্লাহভীতি থাকবে না। নামাজে নফল ও সুন্নত আদায়ের পরিমাণ কমে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন তারা নামাজে দাঁড়ায় তখন তারা অলসভাবে দাঁড়ায়। ’ -সূরা নিসা : ১৪২
পক্ষান্তরে অন্তর সুস্থ থাকলে লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা দূরীভূত হয়ে যায়। দুনিয়াবি মায়া-মমতা, হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা, কৃপণতা, অহমিকা থাকে না। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি আনুগত্য এবং ইসলামের বিধিনিষেধের প্রতি আগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্তরকে সুস্থ রাখার জন্য বিদআত থেকে দূরে থাকতে হবে। আল্লাহর নির্দেশ পরিপন্থী কামনা-বাসনা পরিহার করতে হবে। ইবাদতে ও ভালো কাজে অলসতা বর্জন এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে। আর আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে এমন কাজের প্রতি আগ্রহ ও প্রচেষ্টা থাকলে আল্লাহ তাদের প্রতি সদয় থাকবেন। আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষ ও নারীদের মধ্যে যে সৎকর্ম করে সে মুমিন, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের জন্য প্রাপ্য পুরস্কার দেবো যা তারা করতো। ’ -সূরা নহল : ৯৭
অন্তরকে সুস্থ রাখতে আমাদের পরিকল্পনা করা দরকার। এ জন্য দুনিয়ার কাজ থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে থাকতে হবে। দুনিয়ার ভালোবাসা আখেরাতের ভালোবাসা থেকে প্রাধান্য পেলে অন্তরকে সুস্থ রাখা সম্ভব নয়। দুনিয়ার স্বার্থে বিভোর হয়ে গেলে ভালো পরিবেশ থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে হয়। খারাপ প্রবৃত্তির সাথে সম্পৃক্ততা আকৃষ্ট করে। অসৎ সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য সম্পর্কে ভাবার অবকাশ থাকে না। ধর্মীয় কাজে অলসতা আঁকড়ে ধরে। অলসতা একটি কঠিন ব্যাধি, যা মানুষকে অকর্মণ্য করে তোলে। মনকে ক্রমে ক্রমে ভালো কিছু করা থেকে মাহরুম করে ফেলে। তখন তারা আর ভালো কিছু ভাবার অবকাশ পায় না। আল্লাহ বলেন, ‘তারা হলো সে সব লোক যাদের অন্তর, শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির ওপর আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন। ’ -সূরা নাহল : ১০৮
কলব বা অন্তরকে সুস্থ রাখতে না পারলে মানুষের জীবন থেকে যা কিছু ভালো তা আস্তে আস্তে চলে যায়। মানুষ তখন পাপ কর্মে প্রবিষ্ট হতে থাকে। মনের পবিত্রতা ক্ষীণ হয়ে আসে। অধিকহারে পাপ কাজের প্রভাব এক সময় তার অন্তরকে কঠিন করে তোলে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যখন বান্দা কোনো পাপ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। যখন সে তাওবা করে, তখন সেটা তুলে নেয়া হয়। আর ইস্তেগফারের মাধ্যমে অন্তরকে পরিষ্কার করা হয়। আর যদি পাপ বাড়তেই থাকে, তাহলে দাগও বাড়তে থাকে। আর এটাই হলো মরিচা। ’ –আহমদ ও তিরমিজি
মানুষ পৃথিবীর মোহে পড়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। শয়তানের প্ররোচণায় পড়ে নেক আমলকে বরবাদ করার তামাশাগ্রস্ততা থেকে মুক্তি পেতে তাই এখনই সতর্ক হওয়া দরকার। সুতরাং আমাদের উচিত, বেশি বেশি পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করা, জিকির করা, নেক আমল করা, সৎ ও পরহেজগার ব্যক্তিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করা, কলবকে পরকালীন চেতনায় উজ্জীবিত করা, পরকাল ও পরকালীন আজাব সম্পর্কে বেশি করে চিন্তাভাবনা করা।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪০ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৬
এমএ/