চিন্তা ও চিন্তাশক্তির কারণে মানুষ পশু থেকে পৃথক হয়েছে। চিন্তা নিয়ে চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাবো- চিন্তা করা, চিন্তা চালনা করা ও চিন্তা পরিচালনা করার ভেতরেই জেগে আছে মনুষ্যত্ব, আর এটাই পশু থেকে মানুষের স্বাতন্ত্র্য।
চিন্তা হলো দু’দিক অভিসারী ও আপেক্ষিক পদার্থ। চিন্তার ভালোটা ভালো, মন্দটা মন্দ। চিন্তার স্বাধীনতা আছে, অধীনতাও আছে। সাফল্য আছে, বিফলতাও আছে। উৎকর্ষ আছে, আছে অপকর্ষও। স্বাধীন চিন্তা, মুক্তচিন্তা বা চিন্তার স্বাধীনতা- শব্দ যেটাই বলি না কেন, মনে রাখতে হবে, চিন্তার উৎকর্ষের কোনো সীমা নেই। ছক-বাঁধা সংজ্ঞা নেই তার স্বাধীনতার। পৃথিবীতে সৃষ্টি নিয়ে যারা যত স্বাধীনভাবে, যত গভীরভাবে চিন্তা করতে পেরেছেন, তারা তত বড় ব্যক্তি হয়েছেন, প্রাজ্ঞ মনীষী হয়েছেন।
দেশের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, অসত্যের বিরুদ্ধে দুর্নিবার আন্দোলন গড়ে তোলার স্বাধীনতা, সৃষ্টি ও স্রষ্টা নিয়ে গবেষণার স্বাধীনতা, মানবকল্যাণের নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কারের স্বাধীনতা এবং আরও কত বিচিত্র স্বাধীনতা রয়েছে পৃথিবীতে। তবে যতো স্বাধীনতাই থাকুক, সবাইকে সর্বাগ্রে এটা মনে রাখতে হবে, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্মে স্বাধীনতা এক কথা নয়।
দেখুন, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ধর্ম নির্বাচনের অধিকার আছে ঠিক, কিন্তু নির্দিষ্ট একটি ধর্ম গ্রহণ করার পর তাতে কাটছাঁট করা, সম্পাদনা করা, নতুন রীতি তৈরি করার অধিকার যে নেই, সেটা বলাইবাহুল্য। তাই মনে রাখতে হবে- ধর্ম গ্রহণে স্বাধীনতা আছে, পালনে যথেচ্ছ স্বাধীনতা নেই।
‘লা ইকরাহা ফিদ্দীন’ তথা ধর্মে জোরজবরদস্তি নেই, সেটার অর্থ ধর্ম গ্রহণ করার জন্য কারও ওপর জবরদস্তি নেই। তার অর্থ এ নয় যে, গ্রহণ করার পর তার বিধি-বিধান মানার মধ্যে কোনো জবরদস্তি নেই, যার ইচ্ছা মানতে পারবে এবং যার ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে। তাই কোরআনে কারিমের সূরা ইউনূসের ৯৯ আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘আর তোমার পালনকর্তা ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সবাইকেই একসঙ্গে ঈমানদার বানিয়ে ফেলতে পারতেন, (কিন্তু তিনি তা করেননি); অতএব তুমি কি মানুষের সঙ্গে জোরজবরদস্তি করতে থাকবে, যতক্ষণ না তারা ঈমান গ্রহণ করছে?’
নিঃসন্দেহে বিবেক হলো আল্লাহর দেওয়া একটি বড় নেয়ামত, যার বলে ও বৈভবে মানুষ উন্নতির বহু পথ পেরিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর দিগ-দিগন্তে আলোর যে স্ফুরণ দেখতে পাচ্ছি, তা একমাত্র আল্লাহর দেওয়া চিন্তারই আলোকসম্পাত। কিন্তু ‘স্বাধীন চিন্তা’ বনাম স্বেচ্ছাচারিতা ইবলিসেরই আবিষ্কার ও উপহার। এই আবিষ্কারের নেপথ্যে রয়েছে আদম সন্তানকে মনুষত্বের মর্যাদা থেকে নেমে এনে পশুত্বের পঙ্কিলতায় পর্যবসিত করার অপপ্রয়াস।
স্বাধীন চিন্তার কারণে আজ মানবজাতির এই অধঃপতন। কারণ তাদের বিবেকে এখনও অঙ্কুরিত হয়নি চিন্তা ও গভীর ভাবনার শক্তি-বীজ। চিন্তা যদি নিতান্ত কাঁচা হয়ে থাকে, তাহলে স্বাধীন চিন্তা তো মারাত্মক ভয়ঙ্কর। সেটা তো হতে পারে মানুষকে পশু বানানোর যন্ত্র। ইবলিসের উদ্দেশ্য হলো- আদম সন্তান আধ্যাত্মিকতা ও চরিত্র-মহিমার বস্ত্র থেকে উলঙ্গ হয়ে যাক। তাই সে আদম সন্তানকে প্ররোচনা দেয়, যেহেতু তোমরা স্বাধীন সুতরাং নিজের চিন্তাকেও সমূহ চারিত্রিক বাঁধ ও বেষ্টনি থেকে মুক্ত করে নাও।
পৃথিবীতে প্রকৃত সৌন্দর্য ও বাস্তবিক উন্নতি শুধু চারিত্রিক ও শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ মানার মাধ্যমেই সম্ভব। যেমন, কোনো সংগীত বা গানকে যদি তার শাস্ত্রীয় নিয়মনীতি থেকে স্বাধীন করে ফেলা হয়, তাহলে সেই সংগীত বা গানের সৌন্দর্য, মাধুর্য ও আকর্ষণ একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে।
উপরন্তু কোনো বিষয়ে মত ব্যক্ত করার অধিকার শুধু সেই ব্যক্তিরই থাকা চাই, যে ব্যক্তি বিষয়টিতে পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করেছে। সুতরাং কোনো ডাক্তারের চিকিৎসাপত্রে সেই ব্যক্তির মত ব্যক্ত করার কোনো অধিকার নেই, যে চিকিৎসাবিদ্যায় কোনো জ্ঞান রাখে না। তেমনিভাবে ধর্মীয় বিষয়ে সেসব ব্যক্তির কিছু বলার অধিকার নেই, যারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ধর্মীয় জ্ঞানের শিক্ষা সম্পন্ন করেনি।
আমাদের মনে রাখা দরকার, চিন্তার স্বাধীনতা বলে পশ্চিমারা আজ বিনা বাধায় যা চালিয়ে দিচ্ছে, সে ধরনের গতানুগতিক কোনো স্বাধীনতার ধারণা ইসলাম আমাদের দেয়নি। ইসলাম মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তি, সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার যথার্থ কর্মসূচি পেশ করেছে। মানব জাতির সুষ্ঠু-সৎ মনোবৃত্তিগুলোর স্বাধীন বিকাশের মধ্য দিয়ে সত্যচর্চার পথ উন্মুক্ত করেছে ইসলাম।
ভৌগোলিক স্বাধীনতার মূল্য ও ইসলামের দৃষ্টি কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু ভৌগোলিক স্বাধীনতা লাভের পর শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্বাধীনতা অর্জন করা ও স্বকীয়তা রক্ষা করা সম্ভব না হলে স্বাধীনতা কখনও সঠিক অর্থে ফলপ্রসূ হতে পারে না। বরং তাকে বলা যায় আগের পরাধীনতার চেয়ে আরও জঘন্যতম পরাধীনতা। যে পরাধীনতা একটি জাতির সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে মুহূর্তেই।
বাংলাদেশ সময়: ২০০২ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১৬
এমএ/