সন্তান মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। পরম ভালোবাসার ধন।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে একজন মমতাময়ী মা ও তার কাছে সন্তানের আশ্রয় প্রদানের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন- ‘এবং মুসার মায়ের অন্তর অস্থির হয়ে উঠলো। যদি তার অন্তর সুদৃঢ় না করতাম তবে সে অস্থিরতা প্রকাশের উপক্রম হয়েছিলো। আর আমি তা করেছিলাম যেনো সে মুমিনদের অর্ন্তভুক্ত থাকে। ... অতঃপর আমি তাকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলাম যাতে তার চক্ষু জুড়ায় এবং সে দুঃখ না করে। এবং জানতে পারে আল্লাহর অঙ্গীকার সত্য। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। ’ -সূরা কাসাস : ১০ ও ১৩
কিন্তু দুর্ভাগ্য স্নেহ ও মমতার পবিত্র বন্ধনে যেনো ছেদ পড়তে শুরু করেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে আপনজন মায়ের কাছেও সন্তানরা হয়ে উঠছে অনিরাপদ। মায়ের আঁচলে আশ্রয় নেওয়া সন্তানের নির্মম মৃত্যু হচ্ছে মায়ের হাতেই। কখনও কখনও সন্তানের হাতেও খুন হচ্ছে প্রিয় মা-বাবা। নিকট অতীতকালে দেশবাসী এমন কিছু খবর দেখেছে। যার মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। ভ্রুণ হত্যা ও অবৈধ গর্ভপাতের কথা না হয় বাদই দিলাম।
ক্রমবর্ধমান এ অপরাধ প্রবণতা সমাজের বিবেকবান শ্রেণীকে ভাবিয়ে তুলেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় পিতা-মাতার কাছে যদি সন্তানের জীবন অনিরাপদ হয়ে যায়, তবে শিশুরা যাবে কোথায়? আর কেনোইবা এই নৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হলো আমাদের সমাজে?
সমাজতাত্ত্বিকদের অভিমত হলো, বস্তুবাদী জীবনব্যবস্থার ভোগবাদী মানসিকতা, তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের ফলে সৃষ্ট নৈতিক স্খলন, একক পরিবার ব্যবস্থার চাপ ও বিষন্নতা, সুশাসনের অভাব ও ভবিষ্যৎ জীবনের অনিশ্চয়তা, পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনের অনুপস্থিতি; সর্বোপরি খোদাভীতি ও ধর্মীয় জীবন থেকে বিমুখতাই এ বিপর্যয়ের প্রধান কারণ।
শিল্প বিপ্লব পৃথিবীর চিরায়ত চেহারাই পাল্টে দেয়। প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত জীবনব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে বস্তুবাদী জীবনব্যবস্থার প্রবর্তন করে। যা পৃথিবীকে সীমাহীন ‘বেগ’ দিলেও কেড়ে নিয়েছে ‘আবেগ’। ফলে মানুষ স্বার্থান্ধ অর্থোপার্জনের মেশিনে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে আকাশ সংস্কৃতি মানুষকে বাঁধনহারা, বল্গাহীন ও অসহিষ্ণু করে তুলছে। ভেতরগত ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ তাকে পরিণতির ব্যাপারে আতঙ্কিত করে তুলছে। মানসিক এ সঙ্কটই মানুষকে এমন অপরাধে জড়িয়ে ফেলছে।
ইসলাম সকল পর্যায়ে সন্তান হত্যা নিষিদ্ধ করেছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন, আল্লাহর নিকট কোনটি সবচেয়ে বড় অপরাধ? তিনি বলেন, আল্লাহর কোনো সমকক্ষ নির্ণয় করা। অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, এরপর কোনটি? রাসূল (সা.) বলেন, সন্তানকে হত্যা করা সে তোমার সঙ্গে খাবে বলে। তিনি বলেন, অতঃপর কোনটি? রাসূল (সা.) বলেন, প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। -সহিহ বোখারি : ৭৫৩২
ভ্রুণ হত্যা ও গর্ভপাত সন্তান হত্যার প্রাথমিক স্তর। আল্লাহতায়ালা ভ্রুণ হত্যা ও গর্ভপাতকে গোপন হত্যা হিসেবে উল্লেখ করে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন- ‘যখন কবরস্থ কন্যা সন্তানটির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে, কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিলো। ’ -সূরা তাকবির : ৮-৯
অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘এবং তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। আমিই তোমাদেরকে এবং তাদেরকে রিজিক প্রদান করি। এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নোংরামির কাছেও যেও না। আল্লাহ যার জীবনকে নিরাপদ করেছেন, তাকে ন্যায়সঙ্গত কারণ ব্যতীত হত্যা করো না। আল্লাহতায়ালা তোমাদেরকে এ ব্যাপারে ওসিয়ত করছেন, যেনো তোমরা অনুধাবন করতে পার। ’ -সূরা আনআম : ১৫২
বর্ণিত আয়াত ও হাদিসে আল্লাহতায়ালা যেনো আমাদের সমাজচিত্রটিই এঁকে বলছেনÑ আভিজাত্য, দারিদ্র্য ও প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নোংরামির কারণে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না।
ইসলাম পিতা-মাতার ত্যাগ ও অবদানের কথা বিবেচনা করে তাদেরকে সন্তান হত্যার দায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি কেসাসের হাত থেকে রেহাই দিলেও দিয়্যত (অর্থদণ্ড) সহ অন্যসব শাস্তি বহাল রেখেছে। পিতা-মাতা সন্তানকে অথবা সন্তান পিতা-মাতাকে যে যাকেই হত্যা করুক না কেনো পরস্পরের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এছাড়াও পরকালীন জীবনে ভয়াবহ শাস্তি তো রয়েছেই। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে কোনো মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে, তার পরিণাম চিরস্থায়ী জাহান্নাম। তার প্রতি রয়েছে আল্লাহর ক্রোধ ও অভিশাপ। তিনি তার জন্য প্রস্তুত করেছেন ভয়াবহ শাস্তি। ’ -সূরা নিসা : ৯৩
আমাদের দেশে সংঘটিত সন্তান হত্যার পেছনে অধিকাংশ সময় পিতা-মাতার অবৈধ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। হয়তো মা তার অবৈধ সম্পর্ক আড়াল করতে নবজাতক সন্তানকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করছে, অথবা পিতার অবৈধ সম্পর্কে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে সন্তান ও নিজে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। বা পিতা নিজেই মা ও সন্তানকে হত্যা করে নিজের পথ পরিষ্কার করছে। ইসলামের দৃষ্টিতে এসব মারাত্মক অপরাধের কাজ।
ইসলামে ব্যক্তি স্বাধীনতা স্বীকৃত হলেও তা প্রশ্নাতীত নয়। মানুষ তার প্রতিটি কাজের জন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র; সর্বোপরি মহান আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যেদিন মানুষ বিভিন্ন দলে আত্মপ্রকাশ করবে, যাতে তাদের কৃতকর্ম প্রদর্শন করা যায়। অতঃপর যে এক অণু পরিমাণ ভালো কাজ করেছে তা দেখতে পাবে এবং যে এক অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করেছে তা দেখতে পারবে। ’ -সূরা জিলজাল : ৬-৮
বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন সামাজিক অনাচার রুখতে পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনকে পুনর্জ্জীবিত করতে হবে। পরিবার ও সমাজে কোনো অপরাধ প্রবণতা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা দমন করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, ইসলাম প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠির নিজস্ব সংস্কৃতির স্বীকৃতি দিয়ে বলেছে, ‘আমি তোমাদের প্রত্যেককেই দিয়েছি স্বতন্ত্র ধর্ম ও জীবন প্রণালী। ’ -সূরা মায়েদা : ৪৮
তবে তা গ্রহণ করতে হবে পরিণতি বিবেচনা করে। বেছে বেছে উপকারী জিনিসগুলো গ্রহণ করতে হবে এবং অপকারী বিষয়গুলো পরিহার করতে হবে। এ ব্যাপারে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে যে জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত। ’ -মেশকাতুল মাসাবিহ
ভালো-মন্দের এ বিবেচনাবোধ তখনই তৈরি হবে, যখন সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মীয় নৈতিকতার আলোকে সাজানো হবে। আদর্শ ও নৈতিক জাতি গঠনের দায়িত্ব প্রধানত রাষ্ট্রের এবং সাধারণভাবে প্রতিটি নাগরিকেরই। আল্লাহতায়ালা ইসলামি রাষ্ট্র ও সমাজের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন, ‘তারা এমন লোক যে, আমি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা নামাজ কায়েম করবে, জাকাত প্রদান করবে, সৎকাজের আদেশ দিবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। ’ -সূরা হজ : ৪১
বাংলাদেশ সময়: ২০১৯ ঘণ্টা, ২৭ মার্চ ২০১৬
এমএ