হজরত ইউনুস আলাইহিস সালাস আল্লাহর নবী ছিলেন। কোরআনে কারিমের ১০ নম্বর সূরার নামকরণ তার নামে রাখা হয়েছে।
কোরআনে কারিমে হজরত ইউনুস (আ.)-এর নামে যেমন একটি সূরা রয়েছে তেমনি ইউনুস নামটিও অন্ততপক্ষে পাঁচ স্থানে উল্লেখিত হয়েছে। কোরআনে হজরত ইউনুস (আ.) কে ‘যুন্নুন সাহিবুল হূত’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। যুন্নুন শব্দের অর্থ মাছের সঙ্গে সম্পৃক্ত আর সাহিবুল হূত শব্দের অর্থ মৎস্য সহচর।
হজরত ইউনুস (আ.) নিনেভা নামক জনপদে প্রেরিত হন। কিন্তু নিনেভার লোকজন তার ডাকে সাড়া না দেওয়ায় তিনি তাদের আল্লাহর গজবের খবর দিয়ে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা না করে নিনেভা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য রওনা হন। পথিমথ্যে সমুদ্র পড়লে তা পাড়ি দেওয়ার জন্য একটি জাহাজে ওঠেন। জাহাজটি মাঝ সমুদ্রে ঘূর্ণিঝড়ে পড়ে। তখন জাহাজের চালক ধারণা করে যে, জাহাজে কোনো অপরাধী আছে, যে কারণে জাহাজটি বিপাকে পড়েছে। পরে সেকালের নিয়ম অনুযায়ী অপরাধীকে চিহ্নিত করতে লটারির ব্যবস্থা করা হয়। লটারিতে বার বার হজরত ইউনুস (আ.)-এর নাম ওঠে। তখন বাধ্য হয়ে তাকে সমুদ্রে ফেলে দিলে জাহাজটি বিপাক থেকে রক্ষা পায়, আর একটি বিরাট মাছ তাকে গিলে ফেলে।
এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘ইউনুসও ছিল রাসূলদের একজন। স্মরণ করো, যখন সে পালিয়ে বোঝাই নৌযানে পৌঁছল, অতঃপর সে লটারিতে যোগদান করল এবং পরাভূত হলো। পরে এক বৃহদাকার মাছ তাকে গিলে ফেলল। তখন সে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। সে যদি আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা না করত, তাহলে তাকে কিয়ামত পর্যন্ত ওই উদরে থাকতে হতো। ’ -সূরা সাফফাত : ১৩৯-১৪৪
হজরত ইউনুস (আ.) অক্ষত অবস্থায় ৪০ দিন সেই বৃহদাকার মাছের উদরে বসে তাসবিহ-তাহলিল, তওবা-ইস্তিগফার করেছিলেন এবং আল্লাহর বিনানুমতিতে স্বদেশ ত্যাগ করার জন্য অনুশোচনা ব্যক্ত করে কান্নাকাটি করেছিলেন। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘এবং স্মরণ করো যুন্নূনের কথা যখন সে রেগেমেগে বের হয়ে গিয়েছিল এবং মনে করেছিল আমি তাকে পাকড়াও করব না। অতঃপর সে (ইউনুস) অন্ধকার হতে আহবান করেছিল, আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আপনি পবিত্র সুমহান। নিশ্চয়ই আমি সীমা লঙ্ঘনকারী। ’-সূরা আম্বিয়া : ৮৭
আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নবীকে পরীক্ষা করেছেন। পরীক্ষার অংশ হিসেবে মাছের উদরের সেই নিকষকালো অন্ধকারে ৪০ দিন ভীষণ কষ্টের মধ্যে থেকে হজরত ইউনুস (আ.) আল্লাহর প্রেমের এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তখন আমি তার (ইউনুসের) ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে উদ্ধার করেছিলাম দুশ্চিন্তা থেকে এবং আমি মুমিনদের নাজাত দিয়ে থাকি। ’ -সূরা আম্বিয়া : ৮৮
হজরত ইউনুস (আ.) ৪০ দিন মাছের উদরে ছিলেন। এর পর আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন এবং আল্লাহর হুকুমে মাছটি তাকে সমুদ্রের কিনারে উগরে দেয়। কোরআনে কারিমে হজরত ইউনুস (আ.)-এর মুক্তি পাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে, ‘অতঃপর আমি ইউনুসকে নিক্ষেপ করালাম এক তৃণহীন প্রান্তরে এবং সে ছিল রুগ্ন। আর আমি তার ওপর একটি লাউগাছ গজালাম। ’ -সূরা সাফফাত : ১৪৫-১৪৬
উল্লেখ যে, হজরত ইউনুস (আ.) দীর্ঘ ৪০ দিন মাছের পেটে পানি-খাদ্যবিহীন অবস্থায় থাকায় ফ্যাকাসে এবং ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, যে কারণে এই অবস্থা থেকে নিরাময়ের জন্য আল্লাহ্তায়ালা পরিবেশ দূষণমুক্তকারী এবং নির্মল ছায়াদানকারী লাউগাছ সেখানে গজিয়ে দেন। সেই লাউগাছটি এত দ্রুত গজিয়ে ওঠে যে, মুহূর্তের মধ্যে ঘন লতাপাতায় তা তাঁবুর আকার ধারণ করে। তিনি কচি লাউ খাবার হিসেবে গ্রহণ করেন।
দোয়া ইউনুস- লাইলাহা ইল্লা আন্তা সুব্হানাকা ইন্তি কুন্তু মিনাজজলিমীন এর মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহর নবী হজরত ইউনুস (আ.) এই দোয়া পাঠ করেই আল্লাহর রহমতে মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
যদি কেউ দোয়া ইউনুস কয়েকবার পড়ে দোয়া করে তার দোয়া কবুল হয়। কেউ যদি বিপন্ন বা বিপদগ্রস্ত অবস্থায় এই দোয়া পাঠ করে আল্লাহর রহমতে সে বিপদ থেকে উদ্ধার পায়।
কোনো কোনো বুজুর্গ বলেন, সিজদায় যেয়ে ৪০ বার দোয়া ইউনুস পাঠ করে দোয়া করলে আল্লাহ তা কবুল করেন।
আরও বর্ণিত আছে, দৈনিক এক হাজার বার দোয়া ইউনুস পড়লে পদমর্যাদা সমুন্নত হয়, আল্লাহ তার রুজি-রোজগারে সমৃদ্ধি দান করেন, তার দুঃখ-যন্ত্রণা, পেরেশানি, অশান্তি, কষ্ট প্রভৃতি নিবারিত করেন, সকল প্রকার কল্যাণের দ্বার তার জন্য খুলে দেন, শয়তানের প্ররোচনা হতে তাকে রক্ষা করেন।
এ দোয়া এক লাখ পঁচিশ হাজার বার পড়লে (খতমে ইউনুস) সব ধরনের অপকার থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, রোগ-শোক থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
সূরা ইউনুসে রয়েছে আল্লাহর তাওহিদের সুস্পষ্ট ঘোষণা, তার পবিত্রতার ঘোষণা এবং নিজের অপরাধের স্বীকারোক্তি, যে কারণে এটা এত মাহাত্ম্যপূর্ণ হয়েছে।
নিয়মিত সূরা ইউনুস আমলের মধ্যে অনেক ফায়দা রয়েছে। হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) বলেন, আমি হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! এই দোয়ার গ্রহণীয়তা কি কেবল হজরত ইউনুস (আ.)-এর জন্যই প্রযোজ্য, না সব মুসলিমের জন্য? জবাবে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে তার জন্য এই দোয়াটি খাসভাবে কবুল হলেও কবুলের ব্যাপারে এটা সব মুসলিমের জন্য সব সময়ই প্রযোজ্য। তুমি কি কোরআনে পাঠ করোনি- ‘ওয়া কাজালিকা নুনজিল মুমিনিন- আর এভাবেই আমি আল্লাহ মুমিনদের উদ্ধার করে থাকি। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৬
এমএ