কাজের মেয়ে বা গৃহকর্মী নির্যাতন একটি অতি পুরনো নির্মম সত্য বিষয়। আবহমানকাল থেকে এ নির্যাতনের নির্মম সত্যকথন নীরবে-নিভৃতে কেঁদে ফিরছে।
নামমাত্র বেতনে অথবা শুধু পেটে-ভাতে অসংখ্য শিশুশ্রমিক ও নারী বাসাবাড়িতে কাজ করে। পচা-বাসি খাবার খেয়ে আর দিনের পর দিন একচিলতে বদ্ধঘরে মশারিবিহীন (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে) অবস্থায় দিন-রাত কাটিয়ে এরা ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়াসহ নানাবিধ রোগে ভোগে। ক্ষেত্রবিশেষ অসৎ চরিত্রের গৃহকর্তা অথবা বাড়িতে আশ্রিত পুরুষ আত্মীয়স্বজনের দেহের ক্ষুধা মেটাতে এরা ধর্ষণের শিকার হয়।
এক দিকে চরমভাবে যৌন নির্যাতনে মৃতপ্রায় হয়, নানাবিধ ভয়াবহ অসুখে আক্রান্ত হয়; অন্য দিকে গৃহকর্ত্রীও তাদের ওপর অমানসিক নির্যাতন চালায়। কোথাও বা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয় এদের। মাথার চুল কেটে দেয়া তো সাধারণ ব্যাপার। পরিশেষে তাকেই দোষী সাব্যস্ত করে ভ্রষ্টা অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। লোকলজ্জার ভয়ে এরা নিজেরা বা এদের হতভাগ্য অভিভাবকেরা আইনের দরজা পর্যন্ত আসতে পারে না, সুবিচার তো বহু দূর।
কাজের মেয়ে আর বেত্রাঘাত, গরম খুন্তির ছেঁকা, গরম ইস্ত্রির ছেঁকা, গরম পানি ঢেলে দিয়ে গা ঝলসে দেওয়া এবং লাঠিপেটা ইত্যকার শাস্তি যেন সম্পূরক বিষয়। অথচ এমন কাজ আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধর্মের দৃষ্টিতেও মহা অন্যায়ের কাজ।
অনেক কাজের মেয়ে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে যায়। তাদের পরিণতি হয় আরও করুণ। কাউকে বা ভিন্ন পরিস্থিতির শিকার হয়ে আশ্রয় নিতে হয় পতিতালয়ে। এ সমাজেরই কিছু দালাল ওঁৎ পেতে থাকে এমন আশ্রয়হারা ভাসমান মহিলা ও কিশোরীদের জন্য। তারা এদের অর্থের লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন দেশে পাচার করে দেয়। এদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়।
এক কথায় বলা চলে, গৃহকর্মীরা সুবিচার পায় না। অথচ আমাদের যা লাইফস্টাইল, যে রকম বাড়িঘর, যে রকম রান্নাবান্না, সে ধরনের শিশু পরিচর্যা, তাতে গৃহকর্মী ছাড়া জীবন চালানো কঠিন। শুধু কঠিনই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভবও বটে। কাজেই এই বিপুলসংখ্যক গৃহকর্মীকে নিয়ে অবশ্যই ভাবার অবকাশ আছে।
আমরা জানি, মানবজীবনকে সমস্যামুক্ত করার জন্য এবং শান্তিময় কল্যাণের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই সৃষ্টিকর্তা দয়াময় আল্লাহ বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত শ্রেষ্ঠতম মানুষ হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন এতিমের বন্ধু, গরিবের বন্ধু, বিধবার বন্ধু ও নির্যাতিত মানুষের সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো দাস-দাসী তোমাদের জন্য খাবার তৈরি করে এনে দেয় তখন নিজের সঙ্গে বসিয়ে তাকে খাওয়াবে। কেননা সে ধোঁয়া ও তাপ সহ্য করেছে। আর কোনো খাবার যদি পরিমাণে কম হয় তবে অন্তত দু-একমুঠো তার হাতে দেবে। ’-সহিহ মুসলিম
সহিহ বোখরি শরিফের বর্ণনা মতে নবী করিম (সা.) মৃত্যু মুহূর্তে শেষ বাক্য হিসেবে বলে গেছেন- ‘নামাজ আর দাস-দাসীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করতে। নবী করিম (সা.) কথাগুলো বারবার বলেছেন’।
উল্লিখিত হাদিসের শিক্ষা হৃদয় ও প্রজ্ঞা দিয়ে অনুভব করে আমাদের চলা উচিত। বর্ণিত হাদিস থেকে আমরা যে দিকনির্দেশনা পেলাম তা অতি সুস্পষ্ট। এর ভিত্তিতে বলা চলে-
ক. গৃহকর্মীরা পরিবারের সদস্যতুল্য গণ্য হবে।
খ. পরিবারের সদস্যরা যা খাবে, তারাও তাই খাবে।
গ. পরিবারের সদস্যরা যা পরবে তাদেরও (সতর ঢাকা) সে ধরনের পোশাক দিতে হবে।
ঘ. সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ তাদের ওপর চাপানো যাবে না। যদি দেওয়া হয় তবে তাকে যথেষ্ট সময় দিতে হবে ও সক্রিয় সহযোগিতা করতে হবে।
ঙ. সর্বোপরি আখেরাতের ভয়াবহ দিনের কথা স্মরণ রেখে অধীনদের প্রতি সুবিচার করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ, ছোট-বড় প্রতিটি কর্মকাণ্ড একটি বিশেষ দিনে জবাবদিহি করতে হবে। এটা ভুলে গেলে চলবে না। প্রত্যেক মানুষই সেদিন তার অর্জিত পাপ-পুণ্য নিয়ে মহান স্রষ্টার হুকুমে তার সামনে কাঁপতে কাঁপতে হাজির হবে; সেদিন অত্যাচারিতের, নির্যাতিতের আর্তনাদে রাব্বুল-ইজ্জতের আরশ কেঁপে উঠবে। মহান আল্লাহ কৃতকর্মের জন্য কাউকে পুরস্কৃত করবেন, আবার কাউকে পাঠাবেন অনন্ত অগ্নিকুণ্ডে। সে দিনটিকে আমরা কেউ উপেক্ষা করতে পারব না। শাস্তির ভয়ে পালিয়ে যেতেও সক্ষম হবে না কোনো প্রাণী। পাপী মানুষেরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে অগ্নিপ্রাচীর ঘেরা গহ্বরে।
সুতরাং সেই ভয়াবহ আজাবের কথা চিন্তা করে আমাদের উচিত অধীনস্থ দাস-দাসীদের প্রাপ্য অধিকার কোরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক আদায় করে চলা। অবহেলিত হতদরিদ্র গৃহকর্মীদের একটি নিয়মের আওতায় আনা। তাদের কাজের সুনির্দিষ্ট পরিধি ও সময় নির্ধারণ করে দেওয়া। তৃপ্তিদায়ক খাবার দেওয়া। ঘুম, বিশ্রাম ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনীয় ছুটির সুযোগ দেওয়া।
মানছি গৃহকর্মীদের নিয়ে কিছু সমস্যা হয়। এমন হলে, তাকে অত্যাচার না করে কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তার অপরাধ যদি আইনে শাস্তিযোগ্য হয়, তবে আইনে আওতায় আনা যেতে পারে। কিন্তু কোনোভোবেই নির্যাতন করা যাবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০১৬
এমএ/