কুলখানি ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত একটি প্রথা। কোনো ব্যক্তি মারা যাওয়ার তিন দিন, চার দিন, সাত দিন পর কুলখানির আয়োজন করা হয়।
কুলখানির আয়োজন ধর্মীয় আবহে করা হলেও ধর্মে এর কোনো ভিত্তি নেই। কুলখানিতে ফাতেহাসহ কোরআন তেলাওয়াত করা হয়, দরুদ পাঠ করা হয়, দোয়া করা হয় এবং খাবার খাওয়ানো হয়। পৃথকভাবে এ কাজগুলোর প্রতিটিই ইসলাম অনুমোদিত। কিন্তু কারও মৃত্যু উপলক্ষে এসব কাজ একত্রিত করে একটি অনুষ্ঠানের রূপ দান করার ভিত্তি বা অনুমোদন কোরআন-হাদিসে নেই। এমনকি সাহাবা ও তাবেয়িদের যুগে বর্তমানে প্রচলিত কুলখানি অনুষ্ঠানের কোনো প্রচলন ছিল না।
পরিচিতদের দাওয়াত করে খাওয়ানো একটি আনন্দের বিষয়। ভালো খাবারের আয়োজন মানুষের মাঝে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করে। আবার উৎসব উপলক্ষে মানুষ সাধ্যমতো ভালো খাবারের আয়োজন করে। বিপরীতে শোক মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়। শোকাহত মানুষ খাবার গ্রহণ ছেড়ে দেয়। সদ্য সন্তানহারা মা ভালো খাবার সামনে দেখলে, সন্তানের প্রিয় খাবার সামনে দেখলে মৃত সন্তানের বিরহ নতুনভাবে তাকে শোকাহত করে। এগুলো মানুষের চিরায়ত স্বভাব। স্বভাবজাত ধর্ম ইসলাম মানুষের এ স্বভাবের স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই বিয়ে উপলক্ষে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধ্যমতো ওলিমার আয়োজন করতে বলেছেন। আবার সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে সপ্তম দিন আকিকা করতে বলেছেন। বিয়ে, সন্তানের জন্ম- এগুলো অানন্দ লাভের উপলক্ষ। ইসলাম এসব উপলক্ষে সাধ্যমতো মানুষকে খাওয়াতে বলে।
পক্ষান্তরে মৃত্যু হলো- চরম দুঃখ ও বেদনার উপলক্ষ। তাই ইসলাম মৃত্যু উপলক্ষে পাড়াপড়শি, গ্রামবাসী, আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করতে বলেনি। আপনজনহারা শোকাহত, বিপদগ্রস্থ পরিবারকে দাওয়াতের আয়োজন করতে বলা, তাদের কাছে খাবার দাবি করা, তাদের সামনে সবাই মিলে আনন্দ করে গোশত, মাছ, বিরিয়ানি খাওয়া কী পরিমাণ নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক আচরণ বৈ অন্যকিছু নয়।
কেউ মারা গেলে কুলখানির আয়োজন করা বা তার ঈসালে সওয়াবে জন্য গ্রামবসী, আত্মীয়-স্বজন ও গরিব-মিসকিনদের খাবার খাওয়ানোর আয়োজন করাতে যদি দুনিয়া আখেরাতের কোনো কল্যাণ থাকতো- তবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই তা করতেন। অথবা তার সাহাবারা করতেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় তার পরিবারের একাধিক সদস্য ইন্তেকাল করেছেন। প্রিয়তমা স্ত্রী হজরত খাদিজা (রা.), প্রিয় চাচা হজরত হামজা (রা.), দুই মেয়ে হজরত উম্মে কুলসুম ও হজরত রোকাইয়া, দুই ছেলে হজরত ইবরাহিম ও হজরত কাসেম (রা.) মহানবীর জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু তিনি তাদের কারও জন্যই কুলখানির আয়োজন করেননি। মানুষ খাওয়ানোর আয়োজন করেননি। অথচ মানুষকে খাওয়ানোর সামর্থ্য রাসূলের ছিল। মানুষকে খাওয়ানোর গুণে রাসূল ছিলেন আরবের বিখ্যাত ব্যক্তি। মানুষকে খাওয়ানোর ফজিলতের যত আয়াত আছে- সেগুলো তার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি নিজেও এ আমলের অনেক ফজিলত হাদিসে বর্ণনা করেছেন।
যে অনুষ্ঠান রাসূল (সা.) নিজে করেননি, জীবদ্দশায় কাউকে করতে বলেননি, চার খলিফাদের কেউ করেনি, সাহাবা ও তাবেয়িদের কেউ করেনি সেই কুলখানির আয়োজন করে আমরা কিভাবে সওয়াবের আশা করতে পারি?
তাই সচেতন মুসলমানদের এসব অনুষ্ঠান পালন থেকে বিরত থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো- তাহলে আমরা আমাদের মৃত মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য কি করবো? আলেমরা বলেন, মৃতদের রুহের মাগফিরাতের জন্য নিম্নে বর্ণিত আমলগুলো করা যেতে পারে-
মৃতদের জন্য বেশি বেশি দোয়া করা, তাদের পক্ষ থেকে সদকা করা, ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করা, মানত পূরণ করা, তাদের পক্ষ থেকে হজ ও উমরা আদায় করা, কবর জিয়ারত করা, তাদের বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ভালো ব্যাবহার করা, তাদের অনাদায়কৃত নামাজ-রোজার ফিদইয়া আদায় করা ইত্যাদি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৬
এমএইউ/