নুসাজায়া (মালয়েশিয়া) ঘুরে: ছাদের কার্নিশে আস্ত খেজুর গাছের সারি। মুকুটের আদলে গড়া গম্বুজের ফাঁক গলে আসা সূর্যা্লোকেই আলোকিত নামাজ ঘর।
অনতিদূরে মালয়েশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় উন্নত রাজ্য জোহরের নতুন প্রশাসনিক রাজধানী কোটা ইসকান্দার। আশপাশে বসতি নেই, তবু গাড়ি হাঁকিয়ে আসা মানুষের জমায়েতে কাতারে কাতার ভরা জোহরের জামাতে।
মেঝের মোটা গালিচায় আরামে নামাজের আয়োজন। দেওয়ালে ইসলামি মোটিভের দ্যুতি। কাচঘেরা দরোজার বাইরেও নামাজের ব্যবস্থা বাড়তি মানুষের। এখানে মোট ৬ হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারেন এক সঙ্গে।
ফোয়ারা ঘিরে গড়া ওজুখানার সাজসজ্জায় ফাইভ স্টার হোটেলের প্রতিফলন। পাশে আকাশের আলো প্রতিফলিত পুল। অমুসলিমদের মসজিদ দর্শনের বিশেষ আয়োজনও চোখে পড়ার মতো।
মসজিদটার নাম সুলতান মাহমুদ ইসকান্দারের নামে। মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার রাজ্য জোহরের ১৪তম আর আধুনিক জোহরের চতুর্থ সুলতান ছিলেন তিনি। প্রজা বৎসলতার কারণে ২০১০ সালে তার মৃত্যুর পর জোহরবাসী যেনো আরো বেশি করে মনে রেখেছে তাকে।
আর তার নামে গড়া এই মসজিদটার মাধ্যমে মূলত যৌথভাবে নতুন এক নান্দনিক নগরের গোড়াপত্তন করে জোহর আর ফেডারেল সরকার। ৩২০ একর জায়গা জুড়ে বিছিয়ে থাকা কোটা ইসকান্দারকে ঘিরে ২৪ হাজার একর জায়গা জুড়ে চলছে আধুনিক নির্মাণের এক মহা আয়োজন। সেই আয়োজনে সামিল তাবৎ বিশ্বের বড় বড় সব বিনিয়োগকারী।
পাম বাগান কেটে এরই মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে সাগোল্যান্ড নামে ৫ হাজার গাড়ির পার্কিং ব্যবস্থা সম্বলিত থিম পার্কটা। পাশেই চলছে এডুসিটি নির্মাণের কাজ। গোটা কয় ফাইভ স্টার হোটেল মাথা তুলেছে এরই মধ্যে। জমে উঠেছে বিশ্বমানের রেস্টুরেন্ট। ধুমছে চলছে ৪ লেনের সব অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণের কাজ।
দশম মালয়েশিয় পরিকল্পনার আওতায় গড়ে ওঠা নতুন এ নগরটার নাম নুসাজায়া। এর দক্ষিণ ছুঁয়ে বইছে সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়াকে বিভক্তকারী জোহর প্রণালী। প্রায় ২ কিলোমিটার লম্বা জোহর-সিঙ্গাপুর দ্বিতীয় লিংকটাও নতুন এই আধুনিক শহরের গোড়াতেই।
নির্মীয়মান নগরের ভেতরেই প্রাইভেট ইয়টের পোতাশ্রয়ে সারি সারি বোট দুলছে। বিশ্বের ধনী দেশগুলো থেকে অবসর কাটাতে এরইমধ্যে এখানে আসতে শুরু করেছেন ধনকুবেররা।
পাম বাগান কেটে ২০০৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করা নুসাজায়ায় কেবল অট্টালিকাই উঠছে তা নয়, খড়-পাতার ভাস্কর্য গড়ে অন্যরকম এক আদল দেওয়া হচ্ছে শহরটাকে। ২০২৫ সালে প্রকল্প শেষ হলে এটাই হবে এক নগরে তাবৎ বিশ্ব।
এর সমন্বিত মহাপরিকল্পনার আওতায় আছে নজির বিহীন নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, সামাজিক অবকাঠামো আর অত্যাধুনিক পরিবহন ব্যবস্থাসহ সমৃদ্ধ জীবনধারার সব আয়োজন। যাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবসা ও শিল্প-বাণিজ্য বিকাশের অব আয়োজনের পাশাপাশি থাকছে পর্যটন আর অবসরযাপনেরও যাবতীয় আয়োজন।
এই নুসাজায়াকে বলা হচ্ছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ সমন্বিত নগর। কৌশলগতভাবে এটি নতুন অর্থনৈতিক এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকেন্দ্র। কাছাকাছি ২টি আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট আর ৫টি সমুদ্র বন্দর এ অঞ্চলের আর সব দেশের সঙ্গে নুসাজায়ায় সহজ যোগাযোগের সেতু গড়ে দিয়েছে। টেকসই উন্নয়নের ভাবনা মাথায় রেখেই এ নগরের গোড়াপত্তন। জোহর রাজ্যে বেড়াতে আসা মানুষের কাছে তাই নুসাজায়া এরইমধ্যে হয়ে উঠেছে অবশ্য দর্শনীয় পর্যটটন গন্তব্য।
উনিশ শতকে যে গোল মরিচ আধুনিক জোহরের প্রাথমিক অর্থনীতির ভিত গড়ে দিয়েছিলো, বিশ শতকের গোড়াতে যে রাবার চাষ সামনে এসেছিলো অপার সম্ভাবনা নিয়ে তারই ধারাবাহিকতায় আজকের এই নুসাজায়া। ১৯০৪ সালে তৎকালীন সুলতান ইব্রাহিম ব্রিটিশ উপদেষ্টা নিতে বাধ্য হলেও তাতে থেমে থাকেনি জোহরের অর্থনীতির চাকা। ১৯১০ সাল থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত এই জোহরই ছিলো শীর্ষ রাবার উৎপাদক মালয় রাজ্য। এখনো পাম অয়েল উৎপাদনে জোহরই শীর্ষে। সুনাম আছে এখানকার কাঠের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানিদের সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে এই জোহরই। এবার গোটা বিশ্বকেই কাছে টানার ব্যবস্থা তারা পাকা করেছে নুসাজায়ায়।
সংবিধানে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রবর্তনের প্রথম মালয় রাজ্যও এই জোহর। রয়েল জোহর মিলিটারি ফোর্স নামে সুলতানের ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীও আছে জোহর রাজ্যে। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, মায়ানমার, বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান আর চীনা অভিবাসীদের শ্রম-ঘামে বেশ শক্ত অবকাঠামোই গড়ে তুলেছে তারা। এবার তারা নুসাজায়ায় গড়ছে শহরের ভেতরে বিশ্ব।
গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইন ফরেস্ট আর জলবায়ুর এই রাজ্যে আবহাওয়াটাও বেশ সহনীয়। আছে ৪শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈতক। শিল্পকলা, সামাজিক আচার আর খাদ্যাভাসে আরবদের ব্যাপক প্রভাব থাকলেও নুসাজায়াকে তারা গড়ে তুলছে মুক্ত সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০১৬
জিপি/এমজেএফ/জেডএম/
আরও পড়ুন
** জোহর সুলতানের সুন্দর মসজিদে
** সিঙ্গাপুরের কজওয়েতে মরে আছে জোহর প্রণালী
** বাংলাদেশিদের হাতেই জোহর বাহরুর পাইকারি বাজার
** ‘ভালো আছে জোহর বাহরুর বাংলাদেশ’
** লাখ টাকায় কোটিপতি হোন আপনিও
** বিনা ভাড়ায় ঘুরুন কুয়ালালামপুরে
** শিকারি কুমিরের সঙ্গে কোলাকুলি
** আকাশের হেলান দিয়ে মসজিদ ভাসে ওই
** প্রলয় নৃত্যে হতবাক দর্শক
** নরমুণ্ডু শিকারী মুরুত গাঁওয়ে
** মুসলিম বাজাউরাই বিত্তশালী বোর্নিওতে
** কলসির ভেতর লুনদায়েহ কবর
** লঙহাউজের রুঙ্গুস রাণী
** বনের ভেতর দুসুন গাঁও
** এক বাজারেই পুরো বোর্নিও
** বোর্নিওতে কী পেতে পারে বাংলাদেশ
** সুলু সাগর তীরের হেরিটেজ ট্রেইলে
** সূর্য ভাল্লুকের সঙ্গে লুকোচুরি
** ওরাংওটাং এর সঙ্গে দোস্তি
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
** সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে