সমাজের অনেকেই বলে থাকেন অলি-আউলিয়া বা বুজুর্গদের কবরকে কবর না বলে মাজার বলতে হবে। এভাবে কবর বলাতে অলি-আউলিয়াদের অসম্মান হয়।
কবর শব্দের অর্থ দাফনস্থল অর্থাৎ যে স্থানে মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা হয়। আর মাজার শব্দের অর্থ দু’টি- জিয়ারত করা এবং জিয়ারত স্থল। তাই যে কোনো মুসলমানের দাফনস্থলকে যেমন কবর বলা যায় তেমনি যে কোনো মুসলমানের কবরকে আভিধানিক অর্থে মাজারও বলা যায়।
কেননা, সকল মুসলমানের কবরই জিয়ারত করা বৈধ। অলি-আউলিয়া, বুজুর্গ ও নেককারদের দাফনস্থলকে কবর বলা যাবে না এমন কোনো বিধান ইসলামি শরিয়তে নেই। অলি-বুজুর্গদের কবরের জন্য কোরআন-হাদিসে কোথাও মাজার শব্দ ব্যবহার হয়নি।
হাদিসে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ নবীদের দাফনস্থলকেও কবর বলা হয়েছে। এমনকি হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরকেও কবর শব্দেই উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন সহিহ বোখারিতে বর্ণিত এক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ইহুদি ও নাসারাদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ, কারণ তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে সিজদার স্থান বানিয়েছে। -সহিহ বোখারি
বর্ণিত হাদিসে নবীদের দাফনস্থলকে কবর বলা হয়েছে।
অন্য এক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তার নিজের ব্যাপারেই বলেন, আমার কবরকে তোমরা উৎসবের স্থান বানিও না। -সুনানে আবু দাউদ: ১/২৭৯
সুতরাং বোঝা গেল, যত সম্মানিত ব্যক্তিই হোক তার দাফনস্থলকে কবর বলা দোষণীয় কিছু নয়। তাই অলি-বুজুর্গদের দাফনস্থলকেও কবর বলা যাবে।
তবে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দাফনস্থলকে রওজা বলা হয়। এর কারণ হলো, রওজা শব্দের অর্থ বাগান। এখানে রওজা দ্বারা উদ্দেশ্য, ‘জান্নাতের একটি বাগান। ’
যেহেতু হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কবরটি জান্নাতের নেয়ামতে ভরপুর একটি পবিত্র বাগান। তাই এ অর্থে তার কবরকে ‘রওজা আতহার’ (পবিত্র বাগান) বলা হয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, কবর ইবাদত বা উপাসনার স্থান নয়। কবর সংক্রান্ত যে সব বিষয় হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন (যথা জিয়ারত, সালাম ও দোয়া) সেগুলো ছাড়া অন্য কোনো কিছু করা বৈধ নয়।
কবরকে সিজদা করা, চুমু খাওয়া, তাতে বাতি জ্বালানো- গুনাহ ও শিরকি কাজ। এ বিষয়ে শরিয়তের অনেক দলিল রয়েছে।
সহিহ মুসলিমের এক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমাদের পূর্ববর্তী কতক উম্মত নিজ নবী ও বুর্জুদের কবরকে সিজদার স্থান বানিয়েছে। সাবধান! তোমরা কবরকে সিজদার স্থান বানাবে না। আমি তোমাদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করছি। -সহিহ মুসলিম: ১/২০১
অন্য এক হাদিসে কবরের ওপর যারা বাতি জ্বালায় তাদের ওপর হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। -সুনানে তিরমিজি: ১/৭৩
আরেক হাদিসে এসেছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হজরত আলীকে (রা.) এই ফরমান দিয়ে পাঠালেন যে, কোনো উঁচু কবর দেখলে তা সমান করে দেবে এবং কোনো মূর্তি দেখলে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে। -জামে তিরমিজি: ১/২০৩
ইসলামি আইনসমৃদ্ধ প্রসিদ্ধ কিতাব তাহতাবি আলা মারাকিল ফালাহতে বলা হয়েছেম, কবর মুছবে না, কবরে চুমু দিবে না এবং কবরকে স্পর্শ করবে না। কেননা, এটা নাসারাদের (খ্রিস্টান) রীতি।
উল্লেখ্য কবরে চুমু খাওয়া, সিজদা করা, তাওয়াফ করা, কবরের ওপর ইমারত বানানো, গিলাফ চড়ানো, মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালানো ইত্যাদি একদিকে যেমন শরিয়তের দৃষ্টিতে গর্হিত কাজ, অপরদিকে তা কবরবাসী অলি-আউলিয়াদের প্রতি চরম অবিচার।
কেননা, তারা পুরো জীবন শিরক-বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন অথচ মৃত্যুর পর তাদরে প্রতি ভক্তি নিবেদনের নামে ওই সব কাজই করা হচ্ছে!
প্রকৃতপক্ষে সাহাবা, তাবেয়িন এবং অলি-বুজুর্গদের পথ-নির্দেশনা অনুযায়ী নিজের ঈমান-আমল ঠিক করা, তাওহিদ ও সুন্নতকে আঁকড়ে ধরা এবং শিরক-বিদআত ও সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমেই তাদেরকে প্রকৃত সম্মান করা যায়।
কবর জিয়ারতের সুন্নত পদ্ধতি হলো, প্রথম কবরের কাছে গিয়ে সালাম দেবে। এরপর কবরকে পিছনে রেখে কিবলামুখি হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের জন্য এবং কবরবাসীর জন্য মাগফিরাতের দোয়া করবে। এছাড়া কোরআনে কারিম থেকে কিছু অংশ তেলাওয়াত করে কবরবাসীর জন্য ইসালে সওয়াব করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
এমএইউ/