গিবত শব্দটি আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। গিবত অর্থ পরোক্ষ নিন্দা বা কারও অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করা।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘গিবত হচ্ছে কারও অসাক্ষাতে তার সম্পর্কে এমনসব কথাবার্তা বলা যেগুলো শুনলে সে অপছন্দ করবে। সাহাবারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জানতে চাইলেন, বাস্তবে যদি ওই ব্যক্তির মধ্যে সেসব দোষ-ত্রুটি থেকে থাকে, তাহলেও কি গিবত হবে! রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, বাস্তবে তার মধ্যে সেসব দোষ-ত্রুটি থেকে থাকলেই তো তা হবে গিবত; আর যদি সেসব দোষ-ত্রুটি তার মধ্যে না-ই থেকে থাকে তা হলেতো তা হবে মিথ্যা অপবাদ- আরবিতে যাকে বলা হয় বুহতান। ’
মিথ্যা অপবাদ গিবতের চেয়েও বড় অপরাধ। আর মিথ্যা অপবাদের চেয়েও জঘন্য অপরাধ হলো- মিথ্যা অপবাদকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেওয়া।
একদা এক বেঁটে মহিলা কোনো প্রয়োজনে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়। প্রয়োজন শেষে মহিলা বিদায় নেওয়ার পর হজরত আয়েশা (রা.) বললেন, মহিলাটি কত বেঁটে! তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আয়েশা! এর দ্বারা তুমি সেই মহিলার গিবত করলে। ’
তার মানে গিবত এতটাই সূক্ষ্ম ব্যাপার, যে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে এমন ক্ষুদ্রতম মন্তব্য যা সে শুনতে পছন্দ করবে না; তা করাটা গিবতই হয়ে যাবে।
বর্তমান মানুষ এমন অহরহ গিবতের মধ্যে ডুবে আছে। কারণ গিবত করতে যেমন মজা লাগে, শুনতেও তেমনি আনন্দ হয়। তাই গিবত প্রতিহত করার ব্যাপারে আমাদের কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায় না।
গিবত এমনই এক সামাজিক অপরাধ, যাকে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। -সূরা হুজুরাত : ১২
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা গিবত থেকে বেঁচে থাকো, কেননা গিবত ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য। ’
গিবত হলো- বান্দার হক। তাই গিবতের অপরাধ হতে মুক্ত হতে হলে গিবতকৃত ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ও ক্ষমা অর্জন করে নেওয়া আবশ্যক।
গিবতের মধ্যে তিনটি মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে- ১. গিবতকারী ব্যক্তির দোয়া কবুল হয় না; ২. তার নেক আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না; ৩. তাকে অসংখ্য পাপরাশীর বোঝা বহন করতে হবে।
তবে হ্যাঁ, কারো মাঝ যদি এমন দোষ-ত্রুটি থাকে যা ধর্ম, রাষ্ট্র, দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর তা প্রকাশ করা গিবতের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
এ ছাড়া গিবত জাতীয় আর একটা জঘন্য অপরাধের নাম হলো- চোগলখোরি। চোগলখোরি হচ্ছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একের কথা অপরের কাছে ছড়িয়ে বেড়ানো। কোনো ব্যক্তির কাছে অন্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে গোপনে এমন কিছু বলা বা এমন কথা লাগানো যার ফলে আলোচ্য দুই ব্যক্তির মধ্যে দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় এবং তদস্থলে তাদের মধ্যে দা-কুড়াল সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এ হলো- চোগলখোরির কুফল।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, চোগলখোর ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
অনেকে মনে করে থাকে, কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে শুধু তার পেছনে কিছু বলা বা মন্তব্য করাই অন্যায়; কিন্তু সামনা-সামনি বলাতে কোনো দোষ নেই। এটাও অত্যন্ত ভুল ধারণা। সামনা-সামনি কোনো লোককে কটাক্ষ করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, অপমান-অপদস্থ করাকে কোরআনে কারিমে হুমাজাহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
দাম্ভিকতা ও অহঙ্কার হলো হুমাজাহকারী ব্যক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর পেছনে পরনিন্দা, কুৎসা রটনা, চোগলখোরি করা তথা সব মাত্রার গিবতকে লুমাজাহ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
হুমাজাহ ও লুমাজাহ এ উভয় প্রকারের অপরাধের শাস্তি হিসেবে কোরআনে কারিমে নিশ্চিত ধংস বা ওয়াইল নামীয় দোজখ সাব্যস্ত করা হয়েছে। -সূরা হুমাযাহ: ০১
মানুষ হিসেবে সবাইকে মনে রাখতে হবে, মানুষের মুখ থেকে এমন কোনো কথা বের হয় না যা রেকর্ড হয় না। এটা কোরআনে কারিমে স্পষ্টভাবে বলা আছে। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে প্রতিটি মন্দ কথা, মিথ্যা কথা ও অন্যায় কথার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। অন্যথায় কাল কিয়ামতের ময়দানে এ সবের জবাব দিতে হবে।
ইসলামি শরিয়তের বিধান অনুযায়ী গিবত সংশ্লিষ্ট সব অপরাধ কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত; যা মূলত হারাম। গিবত একটা সামাজিক ব্যাধি। গিবতের মাধ্যমে সমাজে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি হয়, বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট হয়, পরস্পরে ভুল বোঝাবুঝি ও শত্রুতার সৃষ্টি হয়, মানব জীবনে শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়। গিবত করা যেমন হারাম, গিবত শ্রবণ করাও তেমনি হারাম।
তাই গিবতকারীকে গিবতের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সজাগ করত তাকে গিবত থেকে বিরত রাখা শ্রবণকারীর কর্তব্য। এক হাদিসে উল্লেখ আছে, যে ব্যক্তি তার অপর ভাইয়ের গিবতকারীকে বাধা দেয় বা প্রতিরোধ করে তাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহতায়ালার ওপর বর্তায়।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন bn24.islam@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৬
এমএইউ/