ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

হেলিকপ্টারে উড়ে গিয়ে ওয়াজ করা বিলাসিতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৭
হেলিকপ্টারে উড়ে গিয়ে ওয়াজ করা বিলাসিতা নতুন এক প্রচলন শুরু হয়েছে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে বক্তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওয়াজ মাহফিলে...

ব্যাপারটি আস্তে আস্তে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। লাখ টাকার হেলিকপ্টারে উড়ে গিয়ে বক্তারা যখন ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেন, ‘আমার নবীর ঘরে খেজুর পাতার ছাউনি ছিল! এক নাগারে তিনদিন নবীর চুলায় আগুন জ্বলত না! পেটে পাথর বেঁধে দিনের পর দিন দ্বীনের কাজ করে গেছেন আমার নবী...।’

তখন তাদের লজ্জা করে কিনা জানি না, আমরা শুনে লজ্জা পাই। আমার যদি ক্ষমতা থাকত, তাহলে ফতোয়া জারি করতাম, হেলিকপ্টারে গিয়ে ওয়াজ করা এবং তাদের ওয়াজ শোনা- দুটোই হারাম! সাফ হারাম।

নতুন এক প্রচলন শুরু হয়েছে আজকাল। লাখ লাখ টাকা খরচ করে বক্তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য। আমার মনে হয়, হেলিকপ্টারে করে গিয়ে যাদের বয়ান করার শখ, তাদের বয়ান থেকে এক পয়সার হেদায়েত আশা করা বোকামি। হেদায়েত মুখের কথায় আসে না। হেদায়েতের সঙ্গে সহিহ নিয়ত এবং তাকওয়ার (একনিষ্ঠতা) সম্পর্ক জড়িত।

বিশ্ববাসীর জন্য রহমত, আমার নবী দিনের পর দিন না খেয়ে থেকে দ্বীনের কথা বলেছেন। সাহাবায়ে কেরাম গাছের পাতা খেয়ে ওয়াজ করে বেড়িয়েছেন। আমরা ছোট থেকে বড় হওয়ার পথে আমাদের বুজুর্গদের দেখেছি মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে গিয়ে ওয়াজ করতে। এমনও হয়েছে যে, ওয়াজ করে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই চলে গেছেন। হাদিয়ার টাকা দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ তাদের অনেককে খুঁজেও পায়নি।  

আর এখন...
-১৫ হাজার, ২৫ হাজার, ৩০ হাজার...
-আগাম ফরম পূরণ, এডভান্স---বকেয়া...
গাড়ির তেল, ড্রাইভারের হাদিয়া, বিমানের টিকেট...

এভাবে যারা চুক্তির মাধ্যমে দরদাম করে ওয়াজ করে বেড়ায় (বেড়ান নয়), সময় এসেছে তাদেরকে চিহ্নিত করার। ওয়াজের দাওয়াত দিলে যারা আগাম টাকার কথা বলবে- তাদেরকে মুখের ওপর ‘না’ বলে দিতে হবে। আর এ কথা সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে। বলতে হবে অমুক বক্তা ওয়াজ করার জন্য, ইসলামের কথা শোনানোর জন্য, কোরআনের বাণী শোনানোর, হাদিসে শিক্ষার কথা আমাদের জানানো জন্য টাকা দাবি করেছেন। আমরা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছি; আপনারাও করুন।

দুই.
মাঝে-মধ্যেই শুনি এমন বক্তাদের সুবিধাভোগী কিংবা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কেউ বলেন, গান গাইতে আসা শিল্পীদের লাখ লাখ টাকা দেওয়া হয়, সেখানে আমরা কিছু বলি না। আর কোরআনের কথা বলা বক্তাদের বেশি বেশি টাকা-পয়সা দেওয়া নিয়ে আমরা কেন কথা বলি?

কিসের সঙ্গে কী মেলানো হয়! ওরা তো প্রফেশনাল শিল্পী। ওরা গান গায়। ওরা হালাল-হারামের সূত্র মেনে হারমোনিয়ামে সূর তুলে না। ওরা জান্নাত-জাহান্নামের কথা ভেবে তবলায় থাবা মারে না। ওরা মানুষকে বলে না- গান শুনে অশেষ নেকি হাসিল করুন।

আর ওদের সঙ্গেই যদি তুলনা দিতে হয়, তাহলে তেমন বক্তাদেরও উচিত একটা করে আরবি ব্যান্ডের নাম দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া। মানুষ জানতে পারবে- কার রেট কত! খামাখা সময় নষ্ট হবে না।
গলাবাজ বক্তাদের ওয়াজে সমাজে কোনো প্রভাব পড়বে না, পড়ছেও না
হ্যাঁ, মানছি- বক্তারও পেট-পিঠ আছে। বউ-বাচ্চা আছে। সুতরাং স্বেচ্ছায় কেউ যদি দশ-বিশ হাজার দেয়- সেটা ভিন্নকথা। মানুষ কি কোনো বক্তাকে হাদিয়া না দিয়ে বিদায় দেয়? এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। তবুও তাদের জিহ্বা এত লম্বা কেনো?

তিন.
বাংলাদেশে হেলিকপ্টার ভাড়া প্রতি ঘণ্টা ৬০ থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে রয়েছে ট্যাক্স, ইন্সুরেন্স ও ওয়েটিং চার্জ। একসঙ্গে অনেক টাকার হিসাব। এতগুলো টাকা একজন বক্তার পেছনে কোন বিবেকে ঢালা হয়? কী লাভ হয়? 

বলবেন, হেলিকপ্টারের ভাড়া ভক্তরা দিয়ে দেয়। প্রশ্ন হলো, সেই সহজ-সরল ভক্তদের ব্রেইনটা ওয়াশ করল কে? কে তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিল অমুক মাও‍লানাকে হেলিকপ্টারে উড়িয়ে এনে ওয়াজ করালে সওয়াব হবে?

কেন সওয়াব প্রত্যাশী ওই সহজ-সরল দ্বীনদার মানুষটিকে বুঝিয়ে বলা হয় না- বাবারে! তোমার গ্রামে খোঁজ নিয়ে দেখ; কন্যাদায়গ্রস্ত অনেক পিতার রাতে ঘুম হয় না। টাকাগুলো হেলিকপ্টারের পেছনে খরচ না করে ওই মেয়েটির বিয়ের ব্যবস্থা করে দাও। নিশ্চিত কবুল হবে। একটু খোঁজ নাও। দেখবে তোমার গ্রামেরই অনেক ঘরের বাচ্চা দুইবেলা পেটভরে খেতে পায় না। পেটে ক্ষুধা নিয়ে রাতে বিছানায় ছটফট করে ঘুমিয়ে যায়। টাকাগুলো ওদের জন্য খরচ করো। আল্লাহ খুশি হবেন। কিয়ামতের দিন বলবেন, বান্দা আমার কাছে আয়। আমার অসহায় গরিব বান্দাকে তুই খাইয়েছিলি। তুই আসলে তাকে খাওয়াসনি। আমি আল্লাহকেই খাইয়েছিলি। আয় আমার কাছে আয়।

চার.
আজকাল অনেক মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলেও হেলিকপ্টারে বক্তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ওই মাদরাসার শিক্ষকের বেতন বাকি কয়েক মাসের। বলি, এটা কেমন ন্যায়বিচার! সারা বছর পড়িয়ে শিক্ষকরা ত্রিশ-চল্লিশ হাজারও বেতন পান না। আর একজন বক্তা এসে এক ঘণ্টা গলা বাজিয়ে এক লাখ টাকা সাবাড় করে চলে যাবে? হয় না। হতে পারে না। হওয়া উচিত না।

তা ছাড়া মাদ্রাসায় এমন মূল্যের বক্তাদের দিয়ে ওয়াজ করাতেইবা হবে কেন? এলাকার সাধারণ মুসলমানদের ইসলাম, কোরআন ও হেদায়তের কথা বলে বোঝানোর যোগ্যতা কি সেই মাদ্রাসার উস্তাদদের নাই?

হয়তো বলা হবে, উনাদের বয়ানে বেশি মানুষ এসে বসবে না। বরং গীতিকার ও সুরকার টাইপ বক্তাদের নাম পোস্টারে দিলে মানুষের ঢল নামবে। জলসা ভরপুর কামিয়াব হবে! বলি-
কামিয়াবি কারে কয়?
উদ্দেশ্য কী ওয়াজের?
লাখো মানুষের সমাগম?
আলিশান ডেকোরেশন করে লোক দেখানো?

এ সব যদি ওয়াজ মাহফিলের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে ঠিক আছে। যে দরের খরিদ, সেই দরেই বিক্রি হোক।

আর যদি ওয়াজ হেদায়তের উদ্দেশ্য হয়, খোদার কসম করে বলি; সহিহ বোখারি-মুসলিম যারা পড়ান, তাদের কথায় মানুষের মধ্যে যে প্রভাব পড়বে, গলাবাজ বক্তাদের ওয়াজে তার দশমিক শূন্য শূন্য একভাগ প্রভাবও পড়বে না। পড়ছেও না।

কী দরকার লাখ লাখ লোক জড়ো করে হাসি-কান্নার কোরাস গাওয়ানোর, যদি না পরিবর্তন আসে! একশ’ লোক জড়ো হোক, পাঁচজন হেদায়ত নিয়ে ঘরে ফিরুক। এটাই তো ভালো। এটাই তো সফলতা।

ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন bn24.islam@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৭
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।