ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

ওয়াজ মাহফিলে আদর্শবাদী ও আল্লাহওয়ালা বক্তাদের দাওয়াত দিন

মুফতি মাহফূযুল হক, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৭
ওয়াজ মাহফিলে আদর্শবাদী ও আল্লাহওয়ালা বক্তাদের দাওয়াত দিন বক্তা নির্বাচনের সময় তাদের নির্বাচন করুন- যারা আদর্শবাদী, বুজুর্গ, নেককার ও পরহেজগার

ওয়াজ মাহফিলের মধ্যমণি হলেন সম্মানিত বক্তারা। তাদের ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকারের বদৌলতে আপামর জনসাধারণের মাঝে এখনও ইসলামের নাম আছে, ঘরে ঘরে ইসলামের কিঞ্চিত হলেও আলোচনা চলমান। ইসলাম বিরোধী নানাবিধ আগ্রাসনের বিপরীতে ইসলামের এমন উপস্থিতির পেছনে সম্মানিত বক্তাদের অবদান অসামান্য। তারা সাধারণ মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষক, পথপ্রদর্শক।

ধর্মীয় কারণে সাধারণ মুসলমানও বক্তাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখেন। মন থেকে সমীহ করেন, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ নিজেদের সাধ্য মতো হাদিয়া দিয়ে তারা বক্তাদের সম্মানিতও করেন।

বক্তা ও শ্রোতার পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মানের এ বন্ধন মুসলমানদের হাজার বছরের ঐতিহ্য।

বক্তাদের হাদিয়া দেওয়া ও গ্রহণ করা নতুন কিছু নয়, দোষেরও কিছু নয়। কারও আলোচনা, নসিহত, বক্তৃতা আমাকে মুগ্ধ করলে আমি তার প্রতি দুর্বল হবো- তাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করবো, তাকে ভালোবাসবো এবং দুর্বলতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শনে মনের খুশি থেকে তাকে মানসম্পন্ন হাদিয়া দেবো এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়।  

সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের মানুষ মনে করেন, বক্তা মানে একজন বুজুর্গ ব্যক্তি। বক্তা মানে দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত মানুষ। দ্বীনের জন্য, ইসলামের জন্য আত্মনিবেদিত মহান ব্যক্তি। দ্বীনের প্রতি এ ত্যাগ ও নিমগ্নতার কারণে অবশ্যই তার স্ত্রী ও সন্তানদের অনেক জরুরত অপূরণীয় থেকে যায়। যেহেতু তিনি দুনিয়া উপার্জনকে জীবনের লক্ষ্য স্থির করেননি তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই তার পরিবার কষ্টে থাকে।

তাই মুসলমান হিসেবে সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করেন, যিনি ইসলামের সেবা করে যাচ্ছেন, মানুষকে ওয়াজ-নসিহত করে দ্বীনের পথে ডাকছেন- তাকে একটু স্বস্তি দেই, একটু খুশি করি। সমাজের ধর্মপ্রাণ মানুষের দেওয়া সামান্য হাদিয়া তার আদরের স্ত্রী ও স্নেহের সন্তানদের কিছুটা হলেও উপকৃত করবে। এই হাদিয়ার কারণে হয়তো তার বৃদ্ধ পিতা-মাতার কিছুটা হলেও ওষুধ-পথ্যের ব্যবস্থা হবে। তাই একজন মুসলমান হিসেবে বক্তাকে হাদিয়া দিতে আগ্রহী হওয়া খুবই স্বাভাবিক বিষয়।  

ইসলামকে যে ভালোবাসবে- সে অবশ্যই কামনা করবে পারবারিক অভাবের তাড়নায়, সন্তানদের ভরণপোষণের চাপে কোনো বক্তার দরদমাখা কণ্ঠ যেন থেমে না যায়। জীবিকার টানে বক্তারা ওয়াজের মঞ্চ রেখে চলে যাক। কারণ, দ্বীনের স্বার্থে এমন কিছু মানুষ এমন দরকার- যারা ওয়াজের মঞ্চকে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখার জন্য দুনিয়ার অন্য সব চিন্তা-ভাবনা ছেড়ে দেবে।  

কিন্তু সমস্যা হলো, সর্বসাধারণের এমন অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও হাদিয়ার স্রোত দেখে কিছু অসাধু মানুষ ওয়াজ মাহফিলের মঞ্চ দখল করে নিয়েছে। দ্বীনের খেদমতের স্পৃহায় নয় বরং সংক্ষেপে তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার স্পৃহায় তারা বক্তা সেজেছে। যেহেতু তাদের স্বপ্নই বড়লোক হওয়া, সেহেতু তারা সুনিপুণ শিল্পীর মতো ওয়াজের কলাকৌশল চমৎকারভাবে রপ্ত করে বাজারে খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।  

ওয়াজে সুর মন্দ কিছু নয়। কিন্তু সুরের মায়াজালে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে মোহাবিষ্ট করে দ্বীন জিন্দার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে টাকার পেছনে দৌঁড়ানোর মনোভাব কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ জাতীয় বক্তারা ওয়াজ মাহফিলের পবিত্র মঞ্চকে দ্বীনের খেদমতে ব্যবহার না করে, নিজেকে বিত্তশালী বানানোর কাজে ব্যবহার করে থাকে। ওয়াজ তাদের কাছে দুনিয়ার অন্য দশটা পেশার মতো একটি পেশা মাত্র।

আর এ উদ্দেশ্য হাসিলের নিমিত্তে অনেক সময় কাউকে কাউকে অনৈতিক ও অসৎ পথেরও আশ্রয় নিতে দেখা যায়। নতুন দাওয়াতে বেশি টাকা পেলে পূর্বের প্রতিশ্রুত মাহফিলের দাওয়াত বাতিল করে দেওয়া হয় নানা অজুহাতে।  
দ্বীনের স্বার্থে এমন কিছু মানুষ এমন দরকার- যারা ওয়াজের মঞ্চকে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখার জন্য দুনিয়ার অন্য সব চিন্তা-ভাবনা ছেড়ে দেবে
এই তো কিছুদিন আগেও বক্তাদের চুক্তির জন্য নিন্দা করা হতো। কিন্তু এখন এটাকে আর দোষের কিছু মনে করা হয় না। দিনে দিনে চুক্তিবাদী বক্তার সংখ্যা বাড়ছে।  

ওয়াজের জন্য হাদিয়া নেওয়া জায়েয। আর টাকা নেওয়া যখন জায়েজ তখন চুক্তি করে নেওয়াও জায়েয এবং অনেক বেশি নেওয়াও জায়েয। এখানে ধর্মীয় বিধান লংঘনের মতো কিছু ঘটছে না। শুধু সমস্যা হলো- আদর্শের। আদর্শিকভাবে চুক্তি ও বেশি টাকার দাবীকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। একজন বক্তার জন্য নিজের পরিচয় স্পষ্ট হওয়া দরকার। আপনি কে? আপনি কোন আদর্শের প্রচারক? ওয়াজ কি আপনার আদর্শের প্রচার, নাকি গাড়ি-বাড়ি বানানো মাধ্যম? আপনি যদি ওয়াজজীবি হয়ে থাকেন, গাড়ি-বাড়ির ধান্ধায় এ লাইনে এসে থাকেন তাহলে এটা স্পষ্ট ভাষায় বলে দিন। আপনার সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কোনো কথা নেই। কেননা তা জায়েয।

কিন্তু আপনি যদি দাবি করেন, আপনি ইসলামের খাদেম, সমাজে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার নেশায় আপনি ব্যাকুল, আপনি নবীর উত্তরসূরি হওয়ার দায়িত্ব পালন করছেন, নবী শিক্ষা ও আদর্শের প্রচার করছেন- তবে বন্ধু আপনার প্রতি বিনীত অনুরোধ হলো, উচ্চা মাত্রার পারিশ্রমিক-চুক্তি এগুলো বাদ দিন। কারণ, মোটাদাগের পারিশ্রমিক আর চুক্তি করে কোনোদিন আদর্শের প্রচার করা যায় না, বরং বিনোদন বিলানো যায়; মানুষকে বিনোদিত করা যায়।  

আপনার আদর্শ যাই হোক, আপনি যদি আপনার লালিত আদর্শ প্রচার করতে চান তবে বিনিময় গ্রহণের মোহমুক্ত হয়ে আপনাকে কাজ করতে হবে। এর উদাহরণ যেমন পাবেন কোরআন-হাদিস থেকে শুরু করে পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠিত বা ব্যর্থ মতাদর্শের প্রচারকদের জীবনীতে। কোনো আদর্শের প্রচারক পৃথিবীর ইতিহাসে বিনিময়ের চুক্তি করে বা দরকষাকষি করে আদর্শ প্রচার করেনি। বিনিময়ের প্রতি এমন নির্মোহতা শুধু নবিদের সুন্নত নয় বরং সকল মতাদর্শের সকল প্রচারকদের আদর্শ। আদর্শের প্রচার নির্মোহভাবে করতে পারলেই কেবল মানুষ আপনার আদর্শ গ্রহণ করবে।

মনে রাখতে হবে, আদর্শ যাই হোক- তার প্রচারে নামলে জীবনের শখ, আহলাদ ও বিলাসকে ভুলে যেতে হবে। বিলাসী জীবনের সঙ্গে নেতৃত্ব মানানসই হলেও আদর্শের প্রচারণার কথা মানায় না।

যারা মাহফিলের ব্যবস্থা করেন, তারা ভেবে দেখুন। কেন মাহফিলের আয়োজন করছেন? যদি ইসলাম প্রচার আপনাদের উদ্দেশ্য থাকে, স্থানীয় মানুষের হেদায়েত আপনাদের উদ্দেশ্য থাকে; তবে বক্তা নির্বাচন করার সময় তাদের নির্বাচন করুন- যারা আদর্শবাদী, বুজুর্গ, নেককার ও পরহেজগার। যারা ইসলাম প্রচারের দরদ ও ফিকির মনে একান্তভাবে লালন করে। তারা ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ির স্বপ্ন দেখে না। এই শ্রেণির বক্তারা ইসলাম জিন্দা হওয়ার স্বপ্ন দেখে। খোঁজে খোঁজে তাদের দাওয়াত দেন। বাজারি বক্তাদের পরিহার করুন, ওয়াজজীবিদের বর্জন করুন। যারা গরিব মুসলমানদের মুষ্টির চালের টাকায় বড়লোক হওয়ার লালসায় ওয়াজের পথ বেছে নিয়েছেন তাদেরকে ‘না’ বলুন।

ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৭২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৭
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।