জোরপূর্বক ঢুকে নবজাতক-শিশুদের কোলে তুলে নিয়ে নাচানাচি এবং দু’হাজার থেকে ১০-১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দাবি করে বসা; না দিলে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ, অঙ্গভঙ্গি এমনকি কাপড় খুলে ফেলাসহ হেন কোনো অপকর্ম নেই- যা তারা করে না।
বাড়ির মালিকের কাছে বাস্তবে তাদের দাবিকৃত অর্থ থাকুক চাই না থাকুক, তাদের কাছে ছাড় বলতে কিছু নেই।
অবশ্য রাস্তাঘাটে বা যানবাহনে তারা জোরাজুরি তুলনামূলক কম করে। যে কারণে বাইরের সাধারণ জনগণ তাদের রুদ্রমূর্তি ও বাস্তব আচরণ বিষয়ে তেমন ওয়াকিবহাল নন।
অনেকে প্রশ্ন করে থানা-পুলিশ এদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয় না কেন? পার্শ্ববর্তী কেউ জবাব দেয়, এদের কাছে থানা-পুলিশও অসহায়। যে কারণে ভুক্তভোগীরাও নীরবে সহ্য করে যায়। নির্যাতিত হয়েও কারো কাছে সাহায্য কামনার হাত প্রসারিত করতে পারে না বা করে না।
ইদানীং অবশ্য অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন। তাদের কথা হলো- এরা তো দেখতে বেশ তাগড়া ও সুস্থ্য-সবল মনে হয়। তাও এরা কাজকর্ম করতে পারে না? আবার কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, আয়-উপার্জন, জায়গা-জমি-সম্পদ, দায়-দায়িত্ব ও উত্তরাধিকার বিষয়ে ইসলামি শরিয়তে কি এদের ব্যাপারে কোনো কিছু নেই।
অন্যদিকে বেশ কিছুদিন আগে সরকারি একটি সমাজসেবা অফিস থেকে হিজড়াদের মৃত্যু-পরবর্তী সৎকার, কাফন-দাফন বিষয়েও জানতে চেয়ে একটি আবেদন এসেছিল। এসব বিষয় নিয়েই আজকের এই লেখা।
আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি হিজড়া নামে এ জনগোষ্ঠী, যারা আমাদের মতোই ‘শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি’ মানবজাতিরই একটি অংশ। তাই শরিয়তসম্মত সঠিক নির্দেশনার আলোকে এদের প্রকৃত মুসলমান হতে সাহায্য করা এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে জনবল হিসেবে যেন কাজে লাগানো যায়, সেই লক্ষে পারিবারিক, সামাজিক রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর কাফন-দাফন ও উত্তরাধিকার: কাফন-দাফন, গোসলদান ও জানাজা পড়া ইত্যাদি সব বিধানেই হিজড়ারা সমান অধিকার ও সেবাপ্রাপ্তি প্রশ্নে অহিজড়া মুসলমানদের অনুরূপ। একজন মুসলিম নর-নারী হিসেবে মুসলিম সমাজের কাছে তেমন সমান আচরণ প্রাপ্তি তাদের অধিকার।
০১. উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যেমন সংশ্লিষ্ট হিজড়াকে পুরুষ গণ্য করা হবে, না কি নারী? সে ক্ষেত্রে যেমন বলা হয়েছে, যদি তার সৃষ্টিগত বাহ্যিক অবস্থা ও আভ্যন্তরীণ অবস্থা- উদাহরণত, দাড়ি-মোচ গজানো, পুরুষের অনুরূপ আচরণ এবং পুরুষের অনুরূপ বা তার কাছাকাছি প্রস্রাবের স্থান অথবা তার দ্বারা কোনো নারীর গর্ভ সঞ্চারিত হওয়া; কিংবা নারীসুলভ আচরণ, স্তন-গুপ্তাঙ্গ নারীদের অনুরূপ বা কাছাবাছি হওয়া অথবা তার মাসিক স্রাব হওয়া, ইত্যাদি লক্ষণীয় হয় এবং পুরুষ বলে ধর্তব্য হয়; তা হলে একজন অহিজড়া মুসলিম পুরুষের সমপরিমাণ অংশ সেও পায়। আর নারী বলে ধর্তব্য হলে, একজন অহিজড়া মুসলিম নারীর সমপরিমাণ অংশ একজন হিজড়া নারীর প্রাপ্য; যদিও ক্ষেত্রবিশেষে অর্থাৎ কেবল ‘জটিল হিজড়া’র ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। ঠিক তেমনি গোসল ও কাফন-দাফনে নারী-পুরুষ নির্ধারণ করে এবং জেনে নিয়ে অর্থাৎ, নারী হলে অন্য কোনো নারীই তাকে গোসল দেবে এবং তিন কাপড়ের স্থলে পাঁচ কাপড় দেওয়া হবে।
আর যদি পুরুষ গণ্য করা হয়, তাহলে তাকে অন্য কোনো পুরুষই গোসল দেবে এবং তিন কাপড়ে কাফন দিয়ে, জানাজা পড়ে দাফন করতে হবে। কোনোরূপ বৈষম্য করা যাবে না।
অবশ্য যে হিজড়াকে নারী বা পুরুষরূপে নির্ধারণ করা যাচ্ছে না, তথা ‘জটিল হিজড়া’, তাকে সতর্কতামূলক নারীর অনুরূপ পাঁচ কাপড়ে দাফন করা যেতে পারে; যদিও তিন কাপড়ে দাফন করা জায়েজ আছে।
০২. মৃত হিজড়া যদি চার বছর বয়সী বা কম-বেশি বয়সের এমন শিশু হয় যে, তার প্রতি স্বভাবজাত আকর্ষণ জন্মে না, তা হলে তাকে নারী-পুরুষ যে কেউ গোসল দিতে পারবে।
০৩. মৃত হিজড়া যদি এমন হয় যে, তাকে নারী বা পুরুষ কোনো দিকেই প্রাধান্য দেওয়া যাচ্ছে না, তা হলে সে ক্ষেত্রে সে সাবালকের কাছাকাছি হোক বা সাবালক হোক; তাকে তায়াম্মুম করিয়ে, কাফন পরিয়ে জানাজা দিয়ে কবরস্থ করা হবে।
০৪. জানাজার দোয়ার ক্ষেত্রেও উপরিউক্ত নিয়মে নারী-পুরুষ জেনে নিয়ে দোয়া পড়বে। আর মৃতটি যদি নাবালক হয় এবং ছেলে বা মেয়ে নির্ধারণ জটিল হয়, তাহলে শিশুদের ক্ষেত্রে বর্ণিত দোয়ার যে কোনোটি পড়লেই যথেষ্ট হবে।
উপসংহার: ইসলামি শরিয়তে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ মানবজাতির ছোট একটি অংশ হলেও আলোচ্য হিজড়াদের ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় ও যথেষ্ট দিকনির্দেশনা বিদ্যমান। যে কারণে খোদ হিজড়াদের নিজেদের বেলায় দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতন হওয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় নেতৃবৃন্দেরও ধর্মীয় কর্তব্য বর্তায়, হিজড়াদের সংশ্লিষ্ট পরিবার-স্বজনদের, জনগণকে, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এদের বিষয়ে সচেতন ও উৎসাহিত করা। যেন সবাই এদের সঙ্গে অপর দশজনের অনুরূপ সদ্ব্যবহার ও মানবিক আচরণ করে; এদের বিয়েশাদি, ঘর-সংসার, আয়-উপার্জন, সামাজিকতা, ইবাদত-বন্দেগি, মৃত্যু-পরবর্তী সম্মানজনক কাফন-দাফন-জানাজায় সবাই সহযোগিতা করতে পারে।
বিশেষ করে এরা যেন ভবঘুরে হয়ে রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি বা হাত পাতা কিংবা বাসাবাড়িতে হানা দিয়ে সংশ্লিষ্টদের উত্যক্ত না করে; বরং অন্য দশজনের অনুরূপ প্রয়োজনীয় ও সম্ভাব্য কাজকর্ম ও পেশায় নিয়োজিত হয়ে সম্মানজনক জীবিকা এবং সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হতে পারে- তেমন সার্বিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে আমাদের সবাইকে শরিক হতে হবে। তার পাশাপাশি রাষ্ট্র ও প্রশাসনকেও এদের সার্বিক কল্যাণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৮
এমএইউ/