আসলে বন্ধুত্ব হলো- এক ধরনের আত্মিক বন্ধন। এই বন্ধন মানুষকে তার চিন্তা-চেতনা ও কাজকর্মের দিক থেকে কাছে নিয়ে আসে এবং পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার মধ্য দিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ জীবনযাপন সুন্দরভাবে কাটে।
মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বন্ধুত্ব হলো ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পূর্ণতার সহায়ক। সেই শৈশব কৈশোর জীবন থেকেই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
শিশু-কিশোরদের জন্য জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন সময় হলো- বন্ধুদের সঙ্গে কাটানোর সময়। বন্ধুদের সঙ্গে এদিক-সেদিক যাওয়া-আসা করা, তাদের সঙ্গে ভালো-মন্দ একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় শেয়ার করার মধ্যে অন্যরকম এক আনন্দ অনুভব করে। বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, পরামর্শ করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের ব্যক্তিগত বিষন্নতা, সুখ দুঃখবোধ ইত্যাদি দূর করার চেষ্টা করে। অভিজ্ঞ, বুদ্ধিমান এবং মেধাবি বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশার মধ্য দিয়ে তারা তাদের বস্তুগত, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাপারে উন্নতি লাভ করতে পরে।
তবে কখনো কখনো বন্ধুত্ব হয়ে উঠতে পারে কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার অভিন্ন চিন্তা কিংবা বস্তুগত স্বার্থসিদ্ধির মাপকাঠিতেও। সেক্ষেত্রে ওই বন্ধুত্ব মানবিক উন্নত অবস্থান থেকে একেবারে রসাতলে চলে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি। সব বন্ধুকে এক মানদণ্ডে ভাবলে চলবে না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে একজন ভালো বন্ধু কী করে নির্বাচন করবো? বন্ধু নির্বাচনের সঠিক মাপকাঠিগুলো কী? পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে মানুষের ব্যক্তিত্বের মাপকাঠি সরাসরি তাদের বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল। ঈমানের মতো মূল্যবান ও দুর্লভ মর্যাদার অধিকারী যে নয় তার ব্যক্তিত্ব বন্ধুত্ব গড়ার মতো খুব একটা উন্নত বলা যাবে না। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার এবং তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমরা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করছো অথচ যে সত্য তোমাদের কাছে এসেছে তারা তা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ’
মানুষের ব্যক্তিত্বের ওপর বন্ধুদের ব্যাপক প্রভাবের প্রতি দৃষ্টি রেখে পবিত্র কোরআন সবার কাছে প্রত্যাশা করে, বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেন সঠিক মানদণ্ডে বিচার করা হয়। আর সেই সঠিক মানদণ্ড হলো- ঐশি মানদণ্ড। কোরআনে কারিমের মানদণ্ডে বন্ধুকে যাচাই-বাছাই করে চিনতে হবে। কারণ, স্থায়ী বন্ধুত্ব ঈমানদারদের মধ্যেই হয়ে ওঠে। যেই বন্ধুত্ব কেবল পৃথিবীতে নয় পরকালেও অটুট থাকতে পারে।
কোরআনে কারিমে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, কিয়ামতে সব বন্ধুই পরস্পরের শত্রুর মতো থাকবে, শুধুমাত্র মুত্তাকিরা ছাড়া অর্থাৎ যারা আল্লাহকে ভয় করে চলেছে পৃথিবীতে।
ইসলামের দৃষ্টিতে বন্ধুত্বের নীতি হলো, একজন আরেকজনকে প্রয়োজনীয় কাজকর্মে সাহায্য সহযোগিতা করবে। তবে এই সাহায্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির বিপরীতে যায় তাহলে ধরে নিতে হবে ওই সাহায্য তাকে বিচ্যুতি ও ধ্বংসের দিকে ধাবিত করতে করা হয়েছে। ইসলামে এটা বর্জনীয়।
বন্ধুত্বের বাড়িয়ে দেওয়া হাত যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির বিপরীতে হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে ওই সাহায্য তাকে বিচ্যুতি ও ধ্বংসের দিতে ধাবিত করতে পারে।
পবিত্র কোরআনে কিয়ামতে অত্যাচারী জালেমদের কথা বর্ণনা প্রসঙ্গে ইঙ্গিতে বলা হয়েছে যে, বন্ধু নির্বাচনে সেদিন তারা যার পর নাই ব্যথিত ও দুঃখিত হবে। সূরা ফোরকানের ২৭ থেকে ২৯ নম্বর আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, জালেম অর্থাৎ মুশরিকরা সেদিন আক্ষেপ করে নিজেদের হাত কামড়াতে থাকবে এবং বলতে থাকবে; হায়! যদি আমি রাসূলের সহযোগী হতাম! হায়! আমার দুর্ভাগ্য, হায়! যদি আমি অমুক লোককে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করতাম। তার প্ররোচণার কারণে আমার কাছে আসা উপদেশ আমি মানিনি। মানুষের জন্য শয়তান বড়ই বিশ্বাসঘাতক প্রমাণিত হয়েছে।
সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কল্যাণ ও উপকার একটি বড় উপায়। এর ফলে বন্ধুত্ব দৃঢ় হয় এবং কল্যাণকারীর প্রতি অন্যদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। জ্ঞানীরা বলেন, সামান্য হাসিও সম্পর্কের সেতু নির্মাণে সহযোগিতা করে এবং আলোচনার পথ খুলে দেয়। কাউকে কাছে আসার সুযোগ দিতে এই মৃদু হাসিটুকুই যথেষ্ট। হাত মেলানো, সালাম করা এবং প্রথম সাক্ষাতে হাসিমুখে কথা বলা ইত্যাদি সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্র সৃষ্টি করে।
কোরআনে কারিমে অন্যদের সঙ্গে সুন্দর ও ইতিবাচক সম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিকেই সঠিক বলে বর্ণনা করেছে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব গাঢ় করার ক্ষেত্রে উপহার আদান-প্রদান একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। দুই পক্ষের মাঝে এর মাধ্যমে আন্তরিকতা এবং ভালোবাস বেড়ে যায়। উপহারের মাহাত্ম্য হলো- দুই পক্ষের মনের ভেতর যত দুষণ আছে, পঙ্কিলতা আছে, মন্দ চিন্তা আর রূঢ়তা আছে- সেসব যেন ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এ কারণে ইসলাম, বন্ধুদের মাঝে পারস্পরিক সন্তুষ্টি ও আন্তরিকতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপহার সামগ্রী বিনিময়ে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৯২১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৮
এমএইউ/