হে দরদী পাঠক! এ মাসের একটি মুহূর্তও যেন আপনার অমনোযোগিতায় না কাটে। শয়তান যেন এ কথা বলে আপনাকে ধোঁকায় না ফেলে- মাত্র তো মাস শুরু হলো, সময় তো আরও আছে, ক’দিন পর থেকেই ইবাদতে মনোযোগী হব ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখন থেকেই আপনার পরিকল্পনা করা উচিত- রমজানে কিভাবে ইবাদতে বেশি সময় কাটাবেন। আমরা যখন কোনও কাজে নামি, বা কোথাও ভ্রমণে বের হই, আগে-ভাগে প্রস্তুতি নিয়ে, চিন্তা-ভাবনা করে বের হই। তখন আমাদের ভ্রমণ হয় আনন্দমুখর। উপভোগ্য। হ্যাঁ! কখনও কখনও প্রস্তুতিহীন ভ্রমণেও আমাদের বের হতে হয়। আর তখনকার অভিজ্ঞতা মোটামুটি আমাদের সবারই আছে। সে ভ্রমণকে আর যাই বলি না কেন, আনন্দমুখর কিংবা উপভোগ্য বলা চলে না। রমজান থেকে যদি আমরা কিছু অর্জন করতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের আগে-ভাগে প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।
রমজানের প্রস্তুতি বিষয়ে একটি পরামর্শ দিতে চাই। ইবাদতের পাশাপাশি অধ্যয়নের জন্য সময় বরাদ্দ করুন। ভুলে যাবেন না, অধ্যয়নও একধরনের ইবাদত। বরং নফল সব ইবাদতের চেয়ে পড়াশোনা শ্রেষ্ঠ ইবাদত বলে মুসলিম গবেষকরা উল্লেখ করেছেন। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেন, ইলমের স্থান দুই কারণে আমলের ওপরে। প্রথমত, ইবাদত সম্পর্কে জানতে হলে ইলমের সিঁড়ি বেয়ে যেতে হবে। আর দ্বিতীয়ত, ইলম অর্জনই একটি স্বতন্ত্র ফরজ ইবাদত। খুব আফসোসের সঙ্গেই বলতে হয়, আমরা ইবাদতে যত বেশি আগ্রহী, জ্ঞানচর্চায় তেমন আগ্রহী নই, তাই এই রমজানে আমাদের জ্ঞান চর্চা বাড়িয়ে দিতে হবে।
প্রিয় ব্যবসায়ী ভাইদের যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো রমজান তাৎপর্যপূর্ণ একটি মাস। বিশ্বজুড়ে ইবাদতের সাগরে ডুবে থাকার মাস। একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা-মমতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মাস। কিন্তু আমরাই একমাত্র জাতি, যাদের কাছে রমজান আসে সাধারণ মানুষকে হয়রানির শেষ সীমায় পৌঁছে দিতে। রমজানের তিনমাস-ছয়মাস আগে থেকেই আমাদের ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী মজুদ করা শুরু করেন, রমজানে চুটিয়ে ব্যবসা করবেন এই আশায়। হায়রে ব্যবসায়ী সমাজ! পৃথিবীজুড়ে যেখানে মানুষ রোজারদের জন্য কম লাভে, ক্ষেত্রবিশেষ লোকসানেও জিনিসপত্র বিক্রি করে, সেখানে আপনি কয়েকগুণ লাভ করে বিপাকে ফেলছেন এদেশের মধ্য আয়ের মানুষগুলোকে। কী জবাব দেবেন আল্লাহর কাছে?
এবারও পত্রিকায় খবর ছেপেছে, রমজান উপলক্ষে বাড়তে শুরু করেছে জিনিসপত্রের দাম। রমজান আসলে আগুনের মত দাউ দাউ করে বাড়তে থাকে নিত্যপণ্যের দাম। মানুষ তখন আল্লাহকে ডাকবে নাকি পুরো রমজান কাটাবে কিভাবে, সে হিসাব কষবে? কত পরিবার যে দুঃসহ কষ্ট নিয়ে রমজান কাটায়, তার হিসাব কি আমরা রাখি? হায় রমজান!
যারা দাম বাড়ানোর আশায় মানুষকে কষ্ট দিয়ে পণ্য মজুদ করে, তাদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন রাসুল (সা.)। তিনি বলেছেন, সেই ব্যবসায়ী কতই না দুর্ভাগা, আল্লাহর বান্দাদের কষ্ট দিয়ে যে খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে। নবীজী (সা.) আরও বলেছেন, গুদামজাতকারীর মানসিক অবস্থা দেখ কত নিকৃষ্ট ধরনের। যখন আমদানি বেশি হয়, তার মুখ কালো হয়ে যায়। আর যখন আমদানি কম হয়, মানুষের কষ্ট বেড়ে যায়, তখন তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। হজরত ওমর (রা.) বলেছেন, মানুষকে কষ্ট দেওয়ার নিয়তে যে ব্যবসায়ী ৪০ দিন খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করবে, তার গোনাহের খাতায় এতবেশি গোনাহ লেখা হয় যে, তার সব সম্পদ সদকা করে দিলেও সে গোনাহ কাটা যাবে না।
হে আমার ব্যবসায়ী বন্ধু! আমরা কিন্তু চাইলেই সাধারণ মানুষের কাছে রমজানকে উপভোগ্য মাস হিসেবে উপহার দিতে পারি। আমাদের একটু ভালো ইচ্ছেই পারে এদেশের কোটি কোটি মধ্য আয়ের মানুষকে নির্ভাবনায় রমজান কাটানোর সুযোগ করে দিতে।
আরেকটি অনুরোধ আপনাদের করতে চাই। দয়া করে, রোজাদার মানুষকে ভেজাল এবং ফরমালিন দেওয়া খাবার খাওয়াবেন না। ফরমালিন মেখে, ভেজাল খাইয়ে কয় টাকাইবা লাভ করবেন আপনি? কিন্তু আমলনামায় যে গোনাহ যোগ হচ্ছে, মানুষের যে অভিশাপ কামাই হচ্ছে, তার যন্ত্রণা কত বেশি একটু ভেবে দেখেছেন?
যদিও সব ব্যবসায়ী কিন্তু এক নন। অনেক ব্যবসায়ীকে আমি দেখেছি, ভেজাল ও বিষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। তারা রোজাদারদের জন্য কম খরচে বাজারের ব্যবস্থা করে দেন। আল্লাহপাক অবশ্যই তাদের নবী-আউলিয়াদের সঙ্গে হাশর করাবেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সুন্দর রমজান যাপনের তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক
বিশিষ্ট মুফাসসিরে কুরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
চেয়ারম্যান: বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৭ ঘণ্টা, মে ০৭, ২০১৮
এইচএ/