আমি বেশ কিছুক্ষণ ধরে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। তাঁকে কাছে ডেকে আমার পাশের চেয়ারে বসিয়ে যা শুনলাম তাতে আমার ব্রক্ষ্মতালু জ্বলে গেল।
তথাকথিত ‘ঈমানদার’ কেরানি পবিত্র হজের স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় ৪০০টাকা কম নিয়েছেন (আল্লাহ তাকে রহম করুন)। ৬০০ টাকা ঘুষ নিয়েও তাঁর আবেদনপত্রটি ফরোয়ার্ড (অগ্রায়ন) না করে আকলিমা বেগমের পাসপোর্ট দখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। আমি তাঁর আবেদনপত্র ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখলাম সবই যথাযথ আছে। পাসপোর্টের ফটোকপিও আছে। ছুটি মঞ্জুরের জন্য পাসপোর্ট কেন লাগবে আমার বোধগম্য হলো না। তিনি একজন নিবন্ধিত হজযাত্রী। হজের সম্পূর্ণ টাকা জমা দেয়ার পরেই তাঁকে নিবন্ধিত করা হয়েছে এবং তিনি একটি নিবন্ধন সনদ পেয়েছেন, যা একটি সরকারি দলিল। তাঁর হজযাত্রার পক্ষে এই নিবন্ধন সনদটিই অকাট্ট প্রমাণ। এক্ষেত্রে পাসপোর্ট কেন লাগবে। তিনি আরো জানালেন, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের অফিসেও তথাকথিত ‘ঈমানদার’ কেরানিদের ইনাম দিতে হবে। নিজ দায়িত্বে জমা দেওয়ার শর্তে আমি তাঁকে পাসপোর্টটি ফেরত দিলাম। তিনি মুখের উপর থেকে বোরকার পর্দাটি সরিয়ে ফেললেন । হঠাৎ করেই আমার দু’হাত চেপে ধরলেন। তিনি বললেন, আমি আপনাদের কিছু খাওয়াই। তাঁর চোখ দু’টো জলে আর্দ্র। হঠাৎ মনে হলো, আমার বড় বু মনোয়ারা বেগম পরম মমতায় আমার হাত ধরে আছেন। গত শনিবার আকলিমা বেগম তাঁর পাসপোর্টটি ফেরত দিয়েছেন। বললেন,শিক্ষা অফিসের কেরানি সাহেব তাঁর পাসপোর্টটি ছুঁয়েও দেখেননি। তাঁকে খুব হাসি-খুশি মনে হচ্ছিল। মজা করার জন্য বললাম, আমকে কি দেবেন? আকলিমা বেগম আগের দিনের মতো ই আমার দু’হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, ভাইও,আমি তোমার জন্য আরাফাতের ময়দানে দোয়া করুম। প্রচন্ড আবেগে আমার দু’চোখের পাতা ভিজে যায়।
গল্প-২
জনৈক ব্যক্তি আর তাঁর স্ত্রী হজে যাবেন। সরকারের বড় কর্তা। দেশের একটি বড় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহী। তাঁর পিএস আমাকে ২৫ বার মোবাইলে কল করেছেন। তিনবার ব্যক্তিগতভাবে এসেছেন। হজের খুঁটিনাটি জানার জন্য একের পর এক প্রশ্ন করেছেন।
সচিবদের জন্য কেন আলাদা/বিশেষ সুযোগ সুবিধা যেমন হারাম থেকে সবচেয়ে কাছের বাড়ি, একরুমে স্বামী-স্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা, বিমানের বিজনেস ক্লাশে আসন সংরক্ষণ, সাত দিনের প্যাকেজ ইত্যাদি ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি। বলি, তোমার সচিব যে অংকের টাকা দিয়েছেন ঠিক একই অংকের টাকা দিয়েছেন রংপুরের একজন প্রান্তিক হজযাত্রী। তাঁদের দু’জনের প্রাপ্য আলাদা নয়। যখন জানতে পারি পিএস আমার ক্যাডারের কর্মকর্তা তখন তাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করি। এটাই আমাদের ক্যাডারের রেওয়াজ। পিএস সন্তুষ্ট হতে পারলো না। সে প্রকারন্তরে বলতে চায়, সচিব আর রংপুরের মানুষটি কখনোই এক হতে পারেন না। সে আরো বলে, তার স্যার কারো সঙ্গে রুম শেয়ার করতে অভ্যস্ত নন, তাঁর অ্যালার্জি আছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভাড়া বাড়িতে দুই সিটের কোনো রুম নেই। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বামী-স্ত্রীকে এক রুমে রাখা যায়। তাঁর জন্য টাকাও দিতে হয় বেশি।
সাধারণ মানের একটি হোটেলের সিট ভাড়া সত্তর থেকে আশি হাজার টাকা। তারকা হোটেল হলে তো কথাই নেই! আমার জানা মতে, বাংলাদেশের কিছু কর্মকর্তা প্রতিজন চল্লিশ লক্ষ টাকার প্যাকেজে স্বামী-স্ত্রী মিলে স্বর্গসুখে পবিত্র হজব্রত পালন করেছেন। তোমার সচিব বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গেলে ভালো হতো। ভি ভি আই পি ব্যবস্থাপনায় আরামে-আয়েশে হজ করতে পারতেন। তবে, আরাফাত ময়দানে আল্লাহ একজন বিধ্বস্ত মানুষকে বেশী পছন্দ করেন। পিএস আমার কথায় খুব একটা খুশি হতে পারলো না। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠতে উঠতে বললো, স্যার, You are rough and tough. আমি বললাম, তোমার এই মন্তব্য আমার কোম্পানি জানলে আমাকে আজই Whatsapp এ মেসেজ পাঠাবে: Your sevice is no longer required in our company. আমার ক্যাডারের এই কনিষ্ঠ কর্মকর্তা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এরাই ‘ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্থপতি’!
লেখক
বজলুল হক বিশ্বাস
অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব এবং হজ অফিসের সাবেক পরিচালক
হজ ব্যবস্থাপনায় সার্বিক দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজনেস অটোমেশন লিমিটেড-এ সিইও ই-সার্ভ এবং পরিচালক
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৮
জেএম/