ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

ঘড়ির পেন্ডুলাম আবিষ্কার করেন যে মুসলিম বিজ্ঞানী

ইসলাম ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৮
ঘড়ির পেন্ডুলাম আবিষ্কার করেন যে মুসলিম বিজ্ঞানী ঘড়ির পেন্ডুলাম

ঘড়ির পেন্ডুলাম আবিষ্কারক একজন মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তার নাম আবুল হাসান আলি ইবনে ইউনুস আল-মিসরি। তিনি মিসরের রাজধানীর কায়রোস্থ বিখ্যাত জ্ঞান-গবেষণাকেন্দ্র দারুল হিকমার নেতৃস্থানীয় গণিতজ্ঞ ছিলেন। 

৯৫০ বা ৯৫২ খ্রিস্টাব্দে বৈজ্ঞানিকচর্চায় বিখ্যাত একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার চেহারা তেমন ভালো ছিল না।

সবসময় তিনি নির্লিপ্ত ও উদাসীন থাকতেন। জরাজীর্ণ পোশাক পড়তেন। তার পিতা ও দাদা দুইজনই বিখ্যাত ছিলেন। তার পিতা মিসরের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও বাগ্মীলোক ছিলেন। আর দাদা ছিলেন হাদিসের বিজ্ঞ পণ্ডিত ও মুহাদ্দিস। শাফেয়ি মাজহাবের প্রধান ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইদরিস আশ-শাফেয়ির সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল।

মিসরের ফাতেমি রাজবংশের খলিফা আল-আজিজ ৯৭৫ সালে ক্ষমতায় আসেন। আল-আজিজ খলিফা হওয়ার দুই বছর পর ইবনে ইউনুস জোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণা আরম্ভ করেন। তার গবেষণায় কী কী যন্ত্রপাতি ছিল, তা ইতিহাসে স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। তবে খলিফা আল-আজিজ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে তাকে সহযোগিতা করেছিলেন বলে জানা যায়। ইবনে ইউনুস জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়ার পাশাপাশি ত্রিকোণমিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক তালিকা তৈরির কারণে বিখ্যাত হয়ে আছেন।

আল-আজিজ ২০ বছরের রাজত্বকালে অধিকাংশ সময় সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে ব্যস্ত ছিলেন। বিশেষ করে, উত্তারাঞ্চলে সিরিয়ার দিকে সামরিক অভিযানে ব্যস্ত হয়ে পড়লে ইবনে ইউনুসকে সহযোগিতা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই তিনি ঠিকভাবে ইবনে ইউনুসকে সহযোগিতা করতে পারেননি। ফলে ইবনে ইউনুসের কাজ তখন ফলপ্রসূ হতে পারেনি।

আল-আজিজের মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই আল-হাকিম রাজ্যভার গ্রহণ করেন। আল-হাকিম ইবনে ইউনুসকে উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা করে। আল-হাকিমের বাসভবন ছিল কায়রোর মুকাতান পাহাড়ে। তিনি বাসায় কয়েকটি জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক যন্ত্রপাতি স্থাপন করেছিলেন। আল-হাকিমের বাসায় বসে ইবনে ইউনুস শুক্রগ্রহ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। পর্যবেক্ষণ কাজ চালানোর জন্য তিনি তার প্রপিতামহ ও কারাফায় ইবনে নাসেরের মসজিদ ব্যবহার করতেন। ৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ২২ এপ্রিল তিনি এ মসজিদ থেকে চন্দ্রগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি ‘বুলুগুল আমনিয়্যাহ ফিমা ইয়াতাআল্লাকু বি তুলুয়িশ শারি আল-ইয়ামানিয়্যাহ’ (On the Attainment of Desirer) শিরোনামে একটি গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেন। এতে ভোরের আলো ফোটার পূর্বাহ্নে লুব্ধকর উদয় এবং কপটিক বর্ষে সপ্তাহ শুরুর দিন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন।

ইবনে ইউনুসের পাণ্ডুলিপি ও পেন্ডুলাম

মুসলমানরা তাদের স্বর্ণযুগের শুরুতেই ঘড়ির ব্যবহার শুরু করেছিল। এদিকে ইবনে ইউনুস পেন্ডুলাম আবিষ্কার করেন। পেন্ডুলাম আবিষ্কারের মাধ্যমে যান্ত্রিক ঘড়ি তৈরি করা হয়। পশ্চিমা কিছু বিজ্ঞানী ইবনে ইউনুসের পেন্ডুলাম আবিষ্কারের কথা কৌশলে অস্বীকার করতে চাইলেও এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা ও ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ আছে, দশম শতাব্দীর জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইবনে ইউনুস ঘড়ির পেন্ডুলাম আবিষ্কার করেন এবং সময় নির্ধারণে তা ব্যবহার করেন। এছাড়াও ইবনে ইউনুসের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি প্রমাণ করে তিনিই পেণ্ডুলামের প্রথম আবিষ্কারক।

ইবনে ইউনুসের রচনা
ইবনে ইউনুস ‘আল-জিজ আল-কবির আল-হাকিমি’ নামে জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক একটি বিশাল গ্রন্থ রচনা করেন। এতে ৮১টি অধ্যায় রয়েছে। এ গ্রন্থে ইবনে ইউনুস তার পূর্ববর্তী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আকাশমণ্ডল পর্যবেক্ষণের তালিকা যোগ করেছেন। প্রথম অধ্যায়ে মুসলিম, কপটিক, সিরীয় ও পার্সি পঞ্জিকার তালিকাও রয়েছে। এছাড়া তারিখ পরিবর্তন ও ইস্টারের তারিখ গণনার তালিকাও দিয়েছেন।  

ইবনে ইউনুস নির্ভুলভাবে ৪০টি গ্রহ সংযোগ ও ৩০টি চন্দ্রগ্রহণের বর্ণনা দিয়েছেন। আমেরিকান কানাডীয় বিজ্ঞানী সাইমন নিউকম ও ঐতিহাসিক রজার জি. নিউটনসহ অনেকে ইবনে ইউনুসের অবদানের কথা তাদের বইয়ে উল্লেখ করেছেন।

ইবনে ইউনুসের কিতাব ‘আল-জাইব’ বা ‘সাইন ট্যাবলেট’ হলো ত্রিকোণমিতির ওপর লেখা একটি বই। বইটিতে ইবনে ইউনুস ত্রিকোণমিতির বেশ কিছু জটিলতার সমাধান দিয়েছেন।

লগারিদম উদ্ভাবনের আগে ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপ যে চারটি ফর্মুলা ব্যবহার করতো, তার মধ্যে ইবনে ইউনুসের একটি ফর্মুলা ছিল অন্যতম। জার্মানির বার্লিনের আহলওয়ার্ডাট লাইব্রেরিতে কিতাব আল-জাইব বইটি সংরক্ষিত আছে।

উল্লেখিত বইগুলো ছাড়াও ইবনে ইউনুস আরো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বই রচনা করেন। প্রপরশন বা অনুপাত এবং সিমিলার আর্ক বা সমরূপী বৃত্তচাপের ওপর দুটি বই রচনা করেছেন তিনি। তার বই দুইটির ল্যাটিন অনুবাদ হয়েছে অনেক আগে। তার প্রপারশন বইটি ইউরোপীয় রেনেসাঁয় গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

ইবনে ইউনুস গ্রিক বিজ্ঞানী মেনিলাসের ত্রিভুজ খণ্ডন করে উপপাদ্য, আলকুয়াট্টা ও সেক্টর ইত্যাদি নিয়েও আলোচনা করেন। লাইডেন ও অক্সফোর্ডে ইবনে ইউনুসের হাকিমি জিজ সংরক্ষিত আছে। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ডি পারসিভাল ফরাসি অনুবাদসহ বইটি প্রকাশ করেন। কার্ল স্কয়ও বইটি অনুবাদ করেন এবং বইটির সূর্যঘড়ি ও বৃত্তাকার ত্রিকোণমিতি সংক্রান্ত কয়েকটি অধ্যায় বিশ্লেষণ করেন।

সম্মাননা ও মৃত্যু
ইবনে ইউনুসের নামে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে চাঁদের একটি গহ্বরের নামকরণ করা হয়। ১৪ দশমিক ১ ‘এস’ দ্রাঘিমাংশ এবং ৯১ দশমিক ১ ‘ই’ অক্ষাংশে এই গহ্বরের দৈর্ঘ্য ৫৮ দশমিক শূন্য পাঁচ কিলোমিটার।

১০০৯ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতকালে ইবনে ইউনুসের মৃত্যু হয়।

সূত্র: কিসসাতুল ইসলাম, ইবনে ইউনুস ওয়া আসারুহু; স্বর্ণযুগের মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার, সাহাদাত হোসাইন

বাংলাদেশ সময়: ০০১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৮
এমএমইউ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।