বুলগেরিয়া পর্বত, নদনদী ও সমভূমির দেশ। বুলগেরিয়ার পূর্ব-পশ্চিম দিকে বলকান পর্বতমালা প্রসারিত।
ইসলামের আগমন
ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী সর্বপ্রথম আব্বাসি খলিফা হিশাম ইবনে আব্দুল মালিক কাস্পিয়্যান দ্বীপে অভিযান পরিচালনা করেন। তারপর খলিফা হারুনুর রশিদ ৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে কয়েক দফা অভিযান পরিচালনা করেন। শেষ পর্যন্ত ৮২৫ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা পূর্ণাঙ্গভাবে কাস্পিয়্যান অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ফলে প্রাথমিকভাবে তখন থেকে কাস্পিয়্যান দ্বীপের উপকূল এলাকা, বুলগেরিয়া ও বলকানের আশপাশের অঞ্চলগুলোতে ইসলামের আলো ছড়াতে থাকে।
৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন রাশিয়ার ইহুদি সম্রাট সেখানকার মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করে বসেন। কিন্তু চার বছর অতিক্রমের আগেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তার সঙ্গে প্রচুর সংখ্যক জনগণও ইসলাম গ্রহণ করে।
কিন্তু ১০১৬ খ্রিস্টাব্দে তার ও অন্যান্যদের ওপর রাশিয়ার পরবর্তী সম্রাট মস্তিস্লাভ বাইজেন্টাইন সরকারের সহযোগিতায় অতর্কিত হামলা চালায়। ফলে সে দ্রুত কাস্পিয়্যান সাগরের কিছু দ্বীপ দখল করে নেয় এবং ব্যাপক গণহত্যা চালায়। বেঁচে থাকা নাগরিকরা তখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। এতে কাস্পিয়্যান অঞ্চল পুরোপুরি অর্থোডক্স খ্রিস্টান দেশে পরিণত হয়।
বুলগেরিয়ানদের কাছে ইসলামের আগমন ঘটে কাস্পিয়্যানদেরও আগে। ওসমানি সম্রাট প্রথম মুরাদের সময়কালে। ৭৭৪ সালে তিনি বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়া ও তার আশপাশের এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে তার পুত্র সুলতান বায়েজিদ এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন। ফলে মুসলমানদের ক্রমাগত দাওয়াতের কারণে প্রচুর পরিমাণ বুলগেরিয়ান নাগরিক ইসলাম গ্রহণ করেন। এমনকি ৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের ছেলে পবিত্র হজও আদায় করেন।
বুলগেরিয়া, ভলগা ও ককেশাস উপকূলে ইসলাম পৌঁছার পর কিছু কাল পরে সেখানে গোত্রকেন্দ্রিক যুদ্ধ বাঁধে। ফলে যুদ্ধ থেকে বাঁচার জন্য অনেকে দলে দলে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে যায়। বুলগেরিয়ার ইহুদি প্রেসিডেন্ট সাইমন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পর বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি ও দানিয়ুবের আশপাশের এলাকায় ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে তার সন্তানরাও পিতাকে অনুসরণ করের। এতে বুলগেরিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে খ্রিস্টান দেশে পরিণত হয়। কিন্তু চরম নির্যাতন সত্ত্বেও বেশ কিছু সংখ্যক বুলগেরিয়ান নাগরিক ইসলাম ধর্মে অটল থাকে। তাদের উপর নেমে আসে অর্থনৈতিক মন্দা ও অপাঙক্তয়ের দাগ।
১৩ শতাব্দীতে মুঘলরা বুলগেরিয়াতে যুদ্ধ পরিচালনা করে। ফলে বুলগেরিয়া ও ককেশাসের আশপাশের অঞ্চলে আবার ইসলামের আলো ছড়াতে শুরু করে। মুসলমানরাও ভালো অবস্থানে পৌঁছতে আরম্ভ করে। শেষ পর্যন্ত ১৪ শতাব্দীতে ওসমানি খলিফা মুরাদ প্রথম বুলগেরিয়া দখল করে নেন। তখন ব্যাপকহারে বুলগেরিয়ায় ইসলাম ছড়াতে থাকে।
ওসমানিদের শাসন
ইতিহাস অনুযায়ী বুলগেরিয়ায় মৌলিকভাবে ইসলামের আগমন হয় তুর্কি সম্রাট প্রথম মুরাদের শসনামলে। ১৩৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি এড্রিনা দখল করেন এবং তুর্কি সাম্রারাজ্যের রাজধানী ঘোষণা করেন। এরপর ১৩৮৩ খ্রিস্টাব্দে বুলগেরিয়াল রাজধানী সোফিয়া ও আশপাশের এলাকায় কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। স্থানীয় বুলগেরিয়ান মুসলিমদের সহায়তায় বাইজেন্টাইন অত্যাচারী শাসককে রাজধানী থেকে বিতাড়িত করেন। এ সময়ে খুব দ্রুত গতিতে বুলগেরিয়া, দানিয়ুব ও বলকান অঞ্চলে মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করে।
পরবর্তীতে সুলতান মুরাদের পুত্র সুলতান বায়েজিদ বিভিন্ন দিকে বিজয়-অভিযান অব্যাহত রাখেন। ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি পুরোপুরি বুলগেরিয়া নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। কিন্তু এর কিছুদিন পর মুসলমানদের বিপক্ষে ক্রুসেড যুদ্ধের আয়োজন শুরু হয়। ফলে ১৪০২ খ্রিস্টাব্দে আঙ্কারার যুদ্ধে সম্রাট বায়েজিদ সম্রাট তৈমুর লঙ্গের কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজয় বরন করেন। বুলগেরিয়ার নিয়ন্ত্রণ চলেও যায় অন্যের হাতে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতে সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতেহর আমলে বুলগেরিয়া আবার মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
১৪ শতাব্দীতে বলকান অঞ্চলে মুসলমানদের বিজয়ের ধারা অব্যাহত থাকলে প্রচুর পরিমাণ তুর্কি মুসলমান সেসব দেশে হিজরত করেন। তাদের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখের মতো ছিল। তাদের সিংহভাগ সোফিয়া, রোডেশিয়া ও ম্যাসেডোনিয়ায় বসবাস করতে শুরু করেন। ওসমানি সাম্রারাজ্যের পতনের পর ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে জোরপূর্বক তাদেরকে তুরস্কে ফিরে আসতে বাধ্য করা হয়। তখন বলকান অঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকা রাশিয়া ও তার মিত্ররা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে নেয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, তখন মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র পাঁচ লক্ষে নেমে আসে।
মুসলমানদের সংখ্যা ও বর্তমান অবস্থা
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মুসলমানরা বুলগেরিয়াতে মোটামুটি ভালো অবস্থানে আছে। নিজেদের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার ফিরে পেয়েছে। বিশেষত বুলগেরিয়া স্বায়ত্ব শাসিত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হওয়ার পর এবং ২০০৭ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার পর থেকে মুসলমানদের মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে।
ইতিহাসের পরম্পরায় যুদ্ধ-বিগ্রহ ও লড়াইয়ের ফলে মুসলমানদের সংখ্যা কমে আসে। মুসলমানরা সুন্নি সম্প্রদায়ের। তবে কিছু শিয়া সম্প্রাদয়েরও রয়েছে। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মুসলমানের সংখ্যা ৫ লাখ ৭৭ হাজার ১৩৯ জন। যা দেশের মোট জন সংখ্যার আট ভাগের কাছাকাছি। কিন্তু ২০১৭ সালে পরিচালিত পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি জরিপে বলা হয়, ১৫% বুলগেরিয়ান নাগরিক মুসলিম। অধিকাংশ মুসলমান যুগোস্লাভিয়া, গ্রিসের সীমান্তবর্তী অঞ্চল, ইস্ট ডুরপাস, কাতরলোয়া, লুডুগুরিয়া ও স্লানিক এলাকায় বসবাস করে। বুলগেরিয়ান মুসলমানদের ৬০% তুর্কি। বাকি ২৫% স্থানীয় নাগরিক।
মসজিদ ও বিভিন্ন ইসলামি সংস্থার সংখ্যা
এক সময় ১২ শ বা তার চেয়ে বেশি মসজিদ থাকলেও এখন মসজিদের সংখ্যা নিতান্ত কম। সর্ব সাকুল্যে ১০ টির মতো হবে।
বুলগেরিয়ার মুসলমানদের সার্বিক অবস্থা তত্ত্বাবধানের জন্য কয়েকটি ইসলামি সংস্থা রয়েছে। ১. দারুল ইফতা, ২. সুপ্রিম ইসলামিক কাউন্সিল, ৩. চ্যারিটি ফর দ্যা ডেপলপমেন্ট অব কালসার। এছাড়াও কোরআন শেখার বিভিন্ন মাদরাসা ও শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে।
সুপ্রিম ইসলামিক কাউন্সিল ইসলামী শিক্ষার যাবতীয় দিক দেখভাল করে। বিশাল পরিকল্পনা করে কর্তৃপক্ষ একটি ইসলামিক একাডেমিও নির্মাণ করছে। যেখান থেকে বৃহৎ পরিসরে ইসলামী কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এছাড়াও বুলগেরিয়ার দারুল ইফতা মুসলমানদের জরুরি বিধান-হুকুম প্রণয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন দীক্ষামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৯
এমএমইউ/