জানা গেছে, হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে নিউজিল্যান্ডের জনগণ একটি ক্ষেত্রে এসে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, সে সম্পর্কে জানার একটা সূত্র তৈরি করবে প্রস্তাবিত এই স্মৃতিস্তম্ভ। এ প্রসঙ্গে নিউজিল্যান্ড ফেডারেশন অব ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন’র (ফিনজ) সভাপতি মুস্তাফা ফারুক বলেন, বিশ্বাস ও ধর্মের তারতম্য সত্ত্বেও কিউইরা কীভাবে একসঙ্গে মিলিত হয়েছিল, তা অনুধাবন করতে পারবে।
মুস্তাফা ফারুক আরো বলেন, স্মৃতিস্তম্ভের জন্য এমন একটি স্থান হতে পারে, যেখানে এই ধারণা-পরিকল্পনাটি উদযাপন করা যাবে। বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা করা হবে। সেখানে কনফারেন্সের জন্য একটি জায়গা হতে পারে এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে বসতে ও চিন্তা-ভাবনায় সময় কাটানোর মতো জায়গা থাকতে পারে।
প্রস্তাবিত পরিকল্পনাটিতে দেখা গেছে, একটি বড়সড়ো শোভামণ্ডিত জলাধার ও একটি খেলার মাঠ এবং সম্মেলনকেন্দ্র এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ফারুক আশা করছেন, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী, ক্রাইস্টচার্চ সিটি কাউন্সিল ও কেন্দ্রীয় সরকার অর্থায়ন করবে। এতে কাজটি দ্রুত এগিয়ে নিতে তাদের সহযোগিতা হবে।
স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ধারণা-পরিকল্পনাটি সৌদি আরব, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েতের দূতাবাস কর্মীদের পাশাপাশি নিউজিল্যান্ডের ইহুদি, মরমন এবং অ্যাঙ্গলিকান নেতাদের যৌথ উপস্থিতিতে উত্থাপন করা হয়।
ক্যানটারবারি মুসলিম এসোসিয়েশনের সভাপতি শাগাফ খান বলেন, ডিজাইনটি আমার পছন্দ হয়েছে। তবে আমাদের অন্য কারো মতামত এখনো এসে পৌঁছেনি। কারণ মতামত জানার জন্য তেমন সময় দেওয়া হয়নি এবং কাজটিও খুব দ্রুত করা হয়েছে।
স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য আমরা শহরের কোনো একটি জায়গা নির্ধারণ করবো। আমাদের নির্বাচিত জায়গার ব্যাপারে সমর্থন পাওয়া গেলে ভালো, না হয় অন্যরা চিন্তা-ভাবনা করে দেখতে পারে এবং আমাদের মতামত জানাতে পারে।
ফারুক আরো জানান, তিনি অল্প সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডানকে নকশার ব্যাপারে জানানো হয়েছে। আর্ডান বলেন, স্মৃতিস্তম্ভের নকশার ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হইনি। তবে সম্ভবত সব পক্ষের মতামত ও তাদের সঙ্গে কথোপকথনের অপেক্ষা করা হচ্ছে। আমি মনে করি, শিগগির একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারবো।
ক্রাস্টচার্চের সেই দুই মসজিদ আক্রমণের পর তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। নারকীয় সে হত্যাকাণ্ডের শোকে মুষড়ে পড়ে গোটা নিউজিল্যান্ড। বেদনায় হত-বিহ্বল হয়েছে সমগ্র পৃথিবী। শোকে মুহ্যমান হয়েছে মুসলিম বিশ্ব। আল্লাহর পবিত্র ঘর মসজিদে এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড শুধু নিউজিল্যান্ডে নয়; পৃথিবীতেই নজিরবিহীন।
আরো পড়ুন: নিউজিল্যান্ডে মুসলিমরা যেমন আছে
মর্মন্তুদ এই নৃশংসতার পর নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডার্নের দরদী ও বিমর্ষ চেহারা দেখেছে বিশ্ববাসী। একদিকে হতাহতদের শোকার্ত পরিবারকে তিনি বুকে টেনে নিয়েছেন। অন্যদিকে মুসলিমসহ অভিবাসীদের আশ্বাস ও অভয় দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমরা তোমাদের শোকের সঙ্গী হয়তো হতে পারবো না। কিন্তু কথা দিচ্ছি, আমরা একসঙ্গেই চলবো। ’
আরো পড়ুন: নিউজিল্যান্ডে কোরআন তেলাওয়াতে সংসদ অধিবেশন শুরু
নিহত মুসলিমদের প্রতি সংহতি জানাতে প্রথম থেকেই পোশাক-পরিচ্ছদে নিজেকে অনন্য প্রমাণ করেছেন জেসিন্ডা। নিজেদের সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে হিজাব পরে তিনি মুসলিম কমিউনিটিতে হাজির হয়েছেন। মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) তিনি নিহতদের স্মরণে সংসদের বিশেষ অধিবেশনে আরবিতে ‘আসসালামু আলাইকুম (আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক)’ বলে তার বক্তব্য শুরু করেন।
কেবল তা-ই নয়, আমন্ত্রিত মুসলিমদের জন্য সংসদে নামাজের ব্যবস্থাও করে দেন জেসিন্ডা। এরপর অন্য ধর্মের অনুসারীরা প্রার্থনা করেন। তারপর তিনি উঠে গিয়ে সংসদে আসা মুসলিমদের সমবেদনা জানান। মুসলিম নারীদের বুকে টেনে নেন তিনি।
আরো পড়ুন: নিউজিল্যান্ডের জাতীয় টেলিভিশন ও রেডিওতে জুমার আজান, খুতবা ও নামাজ সরাসরি সম্প্রচার
শুক্রবার (২২ মার্চ) ১টা ৩২ মিনিটে হামলার শিকার আল-নূর মসজিদের পাশে হেগলি পার্কে নীরবতার কর্মসূচিতে অংশ নেন জেসিন্ডা। মুসলিমদের প্রতি সংহতি জানিয়ে তিনিসহ শত শত কিউই নারী হিজাব পরে শোকানুষ্ঠানে হাজির হন। এতে প্রায় ২৫ হাজার নিউজিল্যান্ডের নাগরিক সমবেত হন। স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ৩০ মিনিটের দিকে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও রেডিওতে আজান প্রচার হয়। এরপরই দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
তার আগে শোকার্ত জনতাকে হাদিস শুনিয়ে প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা বলেন, ‘নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, পারস্পরিক ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বিশ্বাসীরা (মুমিন) সবাই একটি দেহের মতো। দেহের একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে, পুরো শরীর ব্যথা-যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ে। ’ এরপর তিনি বলেন, ‘নিউজিল্যান্ডবাসী আপনাদের মতোই শোকাহত। আমরা ঐক্যবদ্ধ। ’
আরো পড়ুন: শোকানুষ্ঠানে হাদিস শোনালেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে নিউজিল্যান্ডবাসী ঐক্যবদ্ধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের হৃদয় হয়তো ভেঙেছে, কিন্তু আমরা ভেঙে পড়িনি। আমরা বেঁচে আছি একসঙ্গে। আমাদের বিভাজিত করার সুযোগ কাউকে আমরা দেবো না বলে, এ ব্যাপারে নিউজিল্যান্ডবাসী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ’
এর আগে দেশের অস্ত্র আইনে পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়ে বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা জানান, হামলায় যে ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সেরকমসহ সব সামরিক স্টাইলের আধা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র জনসাধারণের জন্য নিষিদ্ধ করবে নিউজিল্যান্ড।
মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও দয়াদ্র দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জেসিন্ডা বিশ্বব্যাপী প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবর দুবাইয়ের বুর্জ খলিফার বাইরের দেয়ালে তার হিজাব পরিহিত একটি ছবি প্রদর্শিত হয়েছে এবং তাকে তার অবস্থান ও আচরণের জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।
আরো পড়ুন: নিউজিল্যান্ডের পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতাজুড়ে ‘সালাম’
ক্রাইস্টচার্চ নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ দ্বীপ এবং ক্যানটারবারি অঞ্চলের বৃহত্তম শহর। এখানে ৪ লাখ ৪ হাজার ৫০০ মানুষের বসবাস। এটি নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড ও ওয়েলিংটনের পর তৃতীয় বৃহত্তম জনবহুল শহর। নিউজিল্যান্ডে প্রায় ৫০ হাজার মুসলমান এবং প্রায় ৬০টি মসজিদ এবং ইসলামী কেন্দ্র রয়েছে।
ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৮ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৯
এমএমইউ