ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

নারী সাহাবি উম্মে সুলাইমের অনন্য জীবন-আখ্যান

ইসলাম ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৯
নারী সাহাবি উম্মে সুলাইমের অনন্য জীবন-আখ্যান

রুমাইছা বিনতে মিলহান আল-আনসারিয়্যা (রা.)। তার উপনাম উম্মে সুলাইম। এ নামেই তিনি প্রসিদ্ধ। অনেক গুণ ও বৈশিষ্ট্যের আধার ছিলেন তিনি। ইসলাম গ্রহণে অগ্রগামী সাহাবিদের অন্যতম। রাসুল (সা.) জান্নাতে তার উপস্থিতির শব্দ শুনেছেন।

আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘স্বপ্নে আমি জান্নাতে প্রবেশ করি। হঠাৎ কারো নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পাই।

ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? তারা বললেন, রুমাইছা বিনতে মিলহান, আনাস ইবনে মালিকের মা। (মুসলিম, হাদিস: ২৪৫৬; মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১১৯৫৫; তাবাকাতে ইবনে সাদ: ৮/৪২৯)

জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখলাম জান্নাতে প্রবেশ করেছি। হঠাৎ দেখি আমার সামনে আবু তলহার স্ত্রী রুমাইছা। (বুখারি, হাদিস: ৩৬৭৯; মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৫০০২; ইবনে হিববান, হাদিস: ৭০৮৪; সুনানে নাসায়ি, হাদিস: ৮১২৪)

বৈবাহিক ও দাম্পত্য-জীবন
মালেক ইবনে নজরের সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছিল। সেই ঘরেই আনাস (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণ করায় ক্ষোভে স্বামী মালেক ইবনে নজর দেশত্যাগ করে সিরিয়ায় চলে যান। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে তিনি সাহাবি আবু তালহা (রা.) এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

উম্মে সুলাইমের দ্বিতীয় বিবাহ সম্পর্কে আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ইসলাম গ্রহণের পূর্বে হযরত আবু তালহা উম্মে সুলাইমকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। উত্তরে উম্মে সুলাইম (রা.) বলেন, আপনি কি জানেন, আপনি যে উপাস্যের পূজা করেন, তা জমি থেকে সৃষ্ট? তিনি বললেন, হ্যাঁ। উম্মে সুলাইম (রা.) বলেন, গাছ-গাছালির পূজা করতে আপনার লজ্জা করে না? আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আপনি যদি আমার ধর্মের অনুসরণ করেন, তবেই আমি আপনাকে বিবাহ করবো। আপনার ইসলাম গ্রহণ করাটাই আমার জন্য মোহর হবে। আমি এছাড়া আর কোনো মোহর চাই না। তিনি বললেন, ঠিক আছে। আমি ভেবে দেখি। তারপর তিনি ফিরে এসে বললেন, আমিও আপনার ধর্মের অনুসারী। কালিমা পড়ে তিনি মুসলমান হয়ে গেলেন এবং উম্মে সুলাইমকে বিবাহ করেন। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস: ৩৩৪০; মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস: ১০৪১৭)

আনাস (রা.)-এর যখন দশ বছর বয়স, তখন তার মা উম্মে সুলাইম তাকে নিয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে আগমন করে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার ছেলে আনাস, আজ থেকে সে আপনার খেদমত করবে। তখন থেকেই আনাস (রা.) নিয়মিত রাসুল (সা.)-এর খেদমত করেছেন। আনাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা আমার আম্মাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। তিনি আমাকে উত্তমভাবে লালন-পালন করেছেন। ’

যুদ্ধাহতদের সেবা-শুশ্রুষায় উম্মে সুলাইম
আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা.) উম্মে সুলাইম ও কিছু আনসারি নারীকে যুদ্ধে নিয়ে যেতেন। যাতে তারা যুদ্ধাহতদের সেবা-শুশ্রুষার পাশাপাশি পানি পান করাতে পারে।

হুনাইনের যুদ্ধে উম্মে সুলাইম খঞ্জর হাতে রণাঙ্গনের দিকে এগিয়ে যান। আবু তালহা (রা.) বলে ওঠেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এই যে উম্মে সুলাইম, তার হাতে খঞ্জর!’ উম্মে সুলাইম বললেন, ‘কোনো মুশরিক আমার নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করলে আমি এটা দিয়ে তার নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলব। ’

হাদিস, ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থগুলোতে তার বীরত্ব, সাহসিকতা, ধার্মিকতা, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার বহু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তবে তিনি কষ্ট-দুঃখের সময় ধৈর্য্যশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, ইতিহাসের পাতায় তার নজির খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন।

তার ধৈর্য্যশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার কথা...
ইমাম বুখারি (রহ.) তার বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ সহিহ বুখারিতে তার এই ঘটনার শিরোনাম করেছেন এভাবে, ‘মুসিবতের সময় যিনি তার দুঃখ-ব্যথা প্রকাশ করেন না। ’ তার সেই ঘটনার বিবরণ এরকম—

আবু তালহার সঙ্গে উম্মে সুলাইমের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাদের খুব সুন্দর ফুটফুটে একটি পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। তার নাম রাখা হয় উমাইর। তার ছোট একটি পাখিও ছিল, যার সঙ্গে সে খেলা করতো। রাসুল (সা.) মাঝে মাঝে উমাইরের সঙ্গে কৌতুক করতেন। তাকে বলতেন, ‘হে উমাইর! তোমার হয়েছে তোমার বুলবুলির!’

আবু তালহা (রা.) তাকে অত্যধিক ভালবাসতেন। একদিন উমাইর অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবু তালহা (রা.) এ নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এমনকি অস্থির হয়ে পড়লেন। তার অভ্যাস ছিল, প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছে আসা-যাওয়া করতেন। এক বিকেলে তিনি ঘর থেকে বের হলেন। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থতার কারণে তার ছেলের মৃত্যু হয়। এ দিকে উম্মে সুলাইম (রা.) মৃত্যুর পর ছেলেকে গোসল করান। কাফন পরিয়ে তার গায়ে সুগন্ধি মাখেন। কাপড়-চোপড় দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিয়ে ঘরের এক কোণে সুন্দরভাবে শুইয়ে রাখেন। এরপর আনাস (রা.)-কে পাঠিয়ে আবু তালহা (রা.)-কে ডেকে পাঠান। তবে তাকে বলে দিলেন, আবু তালহাকে যেন ছেলের মৃত্যুসংবাদ না জানায়।

আবু তালহা (রা.) সেদিন রোজা রেখেছিলেন। উম্মে সুলাইম (রা.) তার জন্য খাবার তৈরি করেন। তিনি ঘরে ফিরেই সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করেন। উম্মে সুলাইম বললেন, সে এখন আগের চেয়ে শান্ত। ক্লান্ত-শ্রান্ত স্বামীকে পুত্রের মৃত্যুসংবাদ তৎক্ষণাৎ জানালেন না। ঘরের লোকদেরও নিষেধ করে রেখেছিলেন। তিনি ছাড়া অন্য কেউ যেন এ সংবাদ তাকে না জানায়।  

আবু তালহা (রা.) তার কথা শুনে ভেবেছিলেন, ছেলে সুস্থ হয়ে ঘুমিয়ে আছে। তাই তিনিও নিশ্চিন্ত মনে রাতের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিলেন। ভোররাতে গোসলও করলেন।

আবু তালহা (রা.) ঘর থেকে বের হওয়ার আগে উম্মে সুলাইম (রা.) তাকে বললেন, ‘বলুন কেউ যদি কারো কাছে কোনো কিছু আমানত রাখে, অতঃপর তার কাছে তা ফেরত চায়; তবে তার কি অধিকার আছে—তা ফেরত না দিয়ে নিজের কাছে আটকে রাখার? আবু তালহা (রা.) বললেন, না তার এ অধিকার নেই। উম্মে সুলাইম (রা.) এবার শান্ত কণ্ঠে বললেন, আপনার পুত্রের ব্যাপারে সবর করুন। আল্লাহ তাআলা তাকে আমাদের কাছে আমানত রেখেছিলেন। এখন তিনি ফিরিয়ে নিয়েছেন।

আবু তালহা (রা.) এতে রাগান্বিত হলেন। রাতের আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে স্ত্রীর নামে অভিযোগ করেন। রাসুল (সা.) তাদের ঘটনা শুনে বিমুগ্ধ হয়ে দুআ করলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের এ রাতে বরকত দান করুন। ’ তারপর আল্লাহ তাআলা তাদের আবদুল্লাহ নামে আরেকটি পুত্র সন্তান দান করেন। সেই আবদুল্লাহ ইবনে আবু তালহাকে পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা সাত পুত্র দান করেন, যাদের প্রত্যেকেই কোরআনের আলেম হয়েছেন। (বুখারি, হাদিস: ১৩০১; মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১২০৮; ফাতহুল বারি: ৩/২০১; তবাকাতে ইবনে সাদ ৮/৪৩১-৪৩২)

হাদিস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়
প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) এই হাদিস থেকে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় উল্লেখ করেছেন। প্রথমে তিনি উম্মে সুলাইমের বৈশিষ্ট্য ও মহত্ব বর্ণনা করে বলেন, তিনি উক্ত ঘটনার মাধ্যমে তার প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, সহিষ্ণুতা ও উত্তম গুণাবলির পরিচয় দিয়েছেন।

এছাড়া শুরুতেই স্বামীকে পুত্রের মৃত্যুসংবাদ না জানিয়ে নিশ্চিন্তে রাত্রিযাপনের সুযোগ দিয়েছেন। সন্তানের মৃত্যুকে আমানত ফেরত নেওয়ার উদাহরণ দিয়ে শোকার্ত স্বামীকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। আবার আল্লাহর ফয়সালাকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা যখন তার উদ্দেশ্য ও নিয়তের সততা সম্পর্কে জানলেন, তার মর্যাদা বৃদ্ধি করলেন। তিনি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর বরকতের দোয়া লাভ করলেন।

ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা ও প্রশ্ন পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৯
এমএমইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।