ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

বিশেষজ্ঞ আলেমের প্রয়োজন খুব বেশি: ড. আফম খালিদ হুসাইন

ইসলাম ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৯
বিশেষজ্ঞ আলেমের প্রয়োজন খুব বেশি: ড. আফম খালিদ হুসাইন

ড. আফম খালিদ হুসাইন। খ্যাতিমান ইসলামী স্কলার, লেখক-গবেষক ও সম্পাদক। চট্টগ্রাম ওমরগণি এম. ই. এস কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন দীর্ঘ ২৭ বছর। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন প্রকল্পে সম্পাদনা পর্ষদেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

শিক্ষা, ধর্মতত্ত্ব ও নৈতিকতার প্রচার-প্রসারে সারা দেশে চষে বেড়ান বছরজুড়ে। আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশ নিতে বিভিন্ন দেশে সফরও করেছেন।

তার সাক্ষাৎকারমূলক জীবন-বৃত্তান্ত উঠে এসেছে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায়। তার নিজের ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে জীবন-আখ্যান ও অন্যান্য কিছু—

জন্ম ও বেড়ে ওঠা
আমার জন্ম ১৯৫৯ সালে। ঈদুল ফিতরের দিন আপন মাতুলালয়ে। ছেলেবেলা কেটেছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার বাবুনগর গ্রামে। বাবুনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার পড়া-লেখার সূচনা। সেখানে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করি। এরপর সাতকানিয়া আলিয়া মাহমুদুল উলূম মাদরাসায় যাত্রা করি। এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস আল্লামা সা্ইয়েদ আসগর হোসাইন মিয়া সাহেব (রহ.)। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা শায়খুল হিন্দ আল্লামা মাহমুদুল হাসান (রহ.)-এর নামে এই মাদরাসার নামকরণ।

আমার শৈশব ও কৈশোরের সোনালি দিনগুলো কেটেছে মাদরাসার সবুজ-সজীব পরিমণ্ডলে। আলহামদুলিল্লাহ, আলিয়া ও কওমিধারার বহু প্রাজ্ঞ উস্তাদের সামনে বসে আমি ইলমে দ্বীন হাসিল করার সৌভাগ্য অর্জন করি।

অনার্স ও পিএইচডি অর্জন
১৯৬৯-৭১ সালে পটিয়া আল জামিয়াতুল ইসলামিয়ায় পড়ালেখা করি। ১৯৭৫ সালে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে হাদিস শাস্ত্রে কামিল ডিগ্রী অর্জন করি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সাথে ১৯৮২ সালে বিএ (অনার্স) ও ১৯৮৩ সালে মাস্টার্স ডিগ্রীপ্রাপ্ত হই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ২০০৬ সালে আমাকে গবেষণা কর্মের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত স্কলারশিপ নিয়ে ইংরেজিতে (The Sermons of the Prophet Muhammad (SAW): A socio-cultural Study) শিরোনামে ডক্টোরাল অভিসন্দর্ভ রচনা করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের লাখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞ প্রফেসরগণ অভিসন্দর্ভ মূল্যায়ন করেন। এই বিষয়ের ওপর গোটা বিশ্বে (আমার জানা মতে) ডক্টোরাল পর্যায়ে আর কোনো গবেষণা কর্ম হয়নি।

প্রথম লেখা ছাপা হয় যখন...
কিশোর বয়সে মাদরাসায় অধ্যয়নকালে আমি লেখালেখি শুরু করি। পটিয়া আল-জামেয়া ইসলামিয়া থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘আত-তাওহীদ-এ ১৯৭০ সালে আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়। বিষয় ছিল ‘হযরত উমর ফারুক (রা.)-এর জীবন ও কর্ম’। পরবর্তীকালে লেখালেখিতে মা-বাবা ও শিক্ষকদের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছি।

যাদের মাধ্যমে লেখালেখি ও উচ্চ শিক্ষায় প্রাণীত হয়েছি
পটিয়া আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়ার বর্তমান মহাপরিচালক আল্লামা মুফতি আবদুল হালিম বুখারী (দা.বা.) আমার কিশোর বয়সের উস্তাদ। তার তীক্ষ্ণমেধা ও বহুমাত্রিক প্রতিভার প্রভাব রয়েছে আমার উপর। আমি তার মাধ্যমে লেখালেখি ও উচ্চ শিক্ষায় প্রাণীত হয়েছি। তিনি দাওরায়ে হাদিস, মাদরাসা বোর্ড থেকে কামিল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

আরেকজন উস্তাদের কথা না বললে নয়। তিনি ছিলেন শাহজাদা আহমদ সগীর (রহ.)। তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে লেখাপড়া করেন তার বাবা মাওলানা শাহ আহমদুর রহমান (রহ.)-এর কাছে। তিনি উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ পড়াশোনা করেন। এছাড়াও তিনি সাইয়েদ আসগর হোসাইন মিয়া সাহেব (রহ.)-এর খলিফা। শাহজাদা আহমদ সগীর (রহ.) হাদীস শাস্ত্রে কামিল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ। বাংলা, আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষায় ছিলেন প্রাজ্ঞ। ১৯৭০ সালে তিনি চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

কর্মজীবন ও বর্তমান
১৯৮৭ সালে সাতকানিয়া আলিয়া মাহমুদুল উলুম ফাযিল মাদরাসায় আরবি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে আমার কর্মজীবনের সূচনা হয়। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম ওমরগণি এম. ই. এস কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম।

২০০৭ সাল থেকে পটিয়া আল জামিয়াতুল ইসলামিয়ার ধর্মীয় ও সাহিত্য বিষয়ক মুখপত্র মাসিক ‘আত-তাওহীদ’ এর সম্পাদক ও হালিশহর এ-ব্লক হজরত উসমান (রা.) জামে মসজিদে খতিব হিসেবে দায়িত্বরত আছি।

পটিয়া আল জামিয়াতুল ইসলামিয়ায় ৪ বছর ও চট্টগ্রাম দারুল মাআরিফ আল ইসলামিয়ায় এক বছর ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম ক্যাম্পাসে দেড় বছর অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।

সাংবাদিকতায় যখন ছিলাম
ছাত্রজীবনে (১৯৭৩-৭৯৮৪) দৈনিক সংবাদ, দৈনিক বাংলার বাণী ও The Bangladesh Times এর পটিয়া মহকুমা সংবাদদাতা এবং The New Nation এর বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও অন্যান্য
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামী বিশ্বকোষ, সীরাত বিশ্বকোষ, দৈনিক কালের কণ্ঠ, দৈনিক সমকাল, বাংলাদেশ প্রতিদিন, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক সময়ের আলো, দৈনিক পূর্বকোণ ও মক্কাস্থ রাবেতা আলমে ইসলামীর মুখপত্র The Muslim World League Journal এ ইতোমধ্যে আমার দুই শতের বেশি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ইসলামী বিশ্বকোষ দ্বিতীয় সংস্করণের ৩ থেকে ৯খণ্ড পর্যন্ত সম্পাদনা করি।

প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা
ইতোমধ্যে আমার লিখিত ও অনুদিত ছোটবড় ২০টি গ্রন্থ ছাপা হয়ে বেরিয়েছে। বর্তমানে সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) ও শায়খ পীর জুলফিকার নকশবন্দি (দা.বা.)-এর গ্রন্থ অনুবাদ করে যাচ্ছি। ৪টি জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত লেখালেখি করছি।

বিভিন্ন উপলক্ষে বিদেশ ভ্রমণ
ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, আরব আমিরাত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ভ্রমণ করি ।

তরুণ চিন্তাশীল মাদরাসাশিক্ষার্থীদের প্রতি...
আমি তরুণদের ‘ক্যারিয়ার’ গড়ার ওপর জোর দিতে চাই। জীবনের লক্ষ্য আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন; ‘ক্যারিয়ার’ তার উপলক্ষ। লক্ষ্যবিহীন ‘ক্যারিয়ার’ গন্তব্যহীন পথিকের ন্যায় ভবঘুরে।

তরুণরা আমাদের আশা ভরসার প্রতীক। প্রবীনরা বিদায় হয়ে যাবেন, নবীনরা হাল ধরবে—এটাই পৃথিবীর চিরন্তন নিয়ম। নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে প্রচুর পড়ালেখা ছাড়া কেউ ভালো শিক্ষক, লেখক ও গবেষক হতে পারেনি। এ জন্য তরুণদের পড়ালেখায় অধিকতর মনোনিবেশ করতে হবে।

যিনি বড় মাপের লেখক নিঃসন্দেহে তিনি আরো বড় মাপের পাঠক। সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে যেন প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় ছেদ না পড়ে। সাধনায় সিদ্ধি মেলে। দুনিয়ায় কোনো শ্রম বৃথা যায় না।

জীবন অত্যন্ত মূল্যবান; হেলায় অবহেলায় যেন তা নষ্ট না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তরুণদের একটা সমস্যা হলো, লেখা প্রকাশ না হলে তারা আর লিখতে চায় না। এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। তরুণ অবস্থায় প্রত্যেককে এ অবস্থার মুকাবেলা করতে হয়। অবিরত লিখে যেতে হবে—ছাপা হোক আর না হোক। নিরন্তর এ সাহিত্য চর্চা ও সাধনার ফলে স্বীকৃতি একদিন পদচুম্বন করবেই করবে।

মাদরাসাশিক্ষার্থীদের অবশ্য মাতৃভাষা বাংলা, ধর্মীয় ভাষা আরবি ও আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজির ওপর পারঙ্গমতা অর্জন করতে হবে। সময় ও সুযোগ নিয়ে আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে বুযুর্গানে দ্বীনের সান্নিধ্যে সময় কাটাতে হবে।

বিশেষজ্ঞ আলিমের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি
আলিমগণ বিশাল সামাজিক শক্তি। তবে সমাজের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা আরও মজবুত হওয়া প্রয়োজন। ইলমে দ্বীন হাসিল করার পর যদি আলিমগণ শিক্ষকতা, ইমামত, ওয়ায ও নসিহত, সাংবাদিকতা, মিডিয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমাজসেবা ও সমাজ উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হন—তাহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেতে পারে। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি ক্যাডারভুক্ত হতে পারলে, এটা হবে সোনায় সোহাগা। বর্তমানে আমরা সীমিত পরিসরে বৃত্তবন্দি হয়ে পড়েছি।  

আল্লামা ড. খালিদ মাহমুদ, আল্লামা ড. হাবিবুল্লাহ মুখতার, আল্লামা ড. ওয়াজেহ রশিদ নদভী, বিচারপতি আল্লামা তকি উসমানী, মাওলানা সাজ্জাদ নদভী, মাওলানা সাইয়েদ সালমান নদভী, ড. মাওলানা আকরাম নদভীর বর্ণাঢ্য জীবনধারা আমাদের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা ও প্রশ্ন পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ২১২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৯
এমএমইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।