ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

জিলহজ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ড. মুহাম্মদ ফরিদুদ্দিন ফারুক  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২২ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০২২
জিলহজ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

১২ মাসে বছর হয়। কিছু মাস নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।



পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে আল্লাহর কিতাবে মাসের সংখ্যা ১২। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩৬)
এই ১২ মাসের শেষ মাস জিলহজ । এ মাসের প্রথম ১০ দিনের ফজিলত কোরআন-হাদিসে গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণিত আছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ফজরের শপথ এবং ১০ রাতের শপথ। ’ (সুরা : ফজর, আয়াত : ১-২)

ইবনে আব্বাস (রহ.), মুজাহিদ ও ইকরামা (রহ.)-এর মতে, ১০ রাত বলতে জিলহজের ১০ রাতের কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে এ মাসের ১০ দিনের মর্যাদা প্রমাণিত।

জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আরো ইঙ্গিতবাহী আয়াত আছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘...তারা যেন নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। ’ (সুরা : হজ, আয়াত : ২৮)

প্রায় সব মুফাসসির মুহাদ্দিসের অভিমত হলো, এই দিনগুলো হলো জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন।

আর এই দিনগুলোর যেকোনো নেক আমল আল্লাহর বেশি পছন্দনীয়। মহানবী (সা.) বলেন, জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনে নেক আমল করা আল্লাহর কাছে যত প্রিয়, অন্য কোনো দিনের আমল তাঁর কাছে তত প্রিয় নয়। সাহাবিরা বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর পথে জিহাদও কি এর মতো প্রিয় নয়? তিনি বলেন, না, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে ওই ব্যক্তি ছাড়া, যে নিজের প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে আল্লাহর পথে বেরিয়ে গেছে আর কোনো কিছুই ফিরে আসেনি (যে শহীদ হলো)। (বুখারি : ১/৩২৯)
আরেক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘দুনিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ দিন জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন। ’ (মাজমাউজ জাওয়ায়িদ, হায়সামি : ৩/২২৫)

হায়সামি আরেকটি সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদার কোনো দিন নেই এবং নেক আমল করার জন্য এর চেয়ে বেশি প্রিয় দিনও নেই। তাই এই দিনগুলোতে তোমরা বেশি বেশি সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বলে তাসবিহ পাঠ করো। অন্য বর্ণনায় আছে, তাহলিল, তাকবির ও আল্লাহর জিকির করো। ’ (মাজমাউজ জাওয়ায়িদ : ২/৩৯)

আবার এ মাসের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখে আল্লাহর জিকির করতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে আল্লাহকে স্মরণ করো। তবে যে ব্যক্তি দুদিনে তাড়াতাড়ি করে তার জন্য কোনো পাপ নেই, আর যে বিলম্ব করে তার জন্যও কোনো পাপ নেই (উভয় অবস্থায়ই পাপ নেই) তার জন্য যে তাকওয়া অবলম্বন করে। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২০৩)
এ নির্দেশ অনুসরণ করতেই হজযাত্রীরা ৯ তারিখে আরাফায়, ১০ তারিখে মুজদালিফা ও মিনায় হজের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আল্লাহর জিকির সমাপনান্তে ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ বা ১১ ও ১২ জিলহজ মিনার প্রান্তরে অবস্থানপূর্বক আল্লাহর জিকির করেন। যাঁরা হজে যান না, তাঁদের ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজের আসর পর্যন্ত প্রতিটি ফরজ নামাজের পর ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ’ সশব্দে বলে আল্লাহর জিকির করতে হবে।
আর এই জিলহজ মাসের আরাফা দিবসে হিজরতের দশম বছরে মহান আল্লাহ ইসলামের পূর্ণতা ঘোষণা করেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বিনকে পূর্ণ করে দিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বিন হিসেবে মনোনীত করলাম। ’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৩)

জুমার দিনে, আরাফাতের ময়দানে, জাবালে রাহমাতের পাদদেশে অবতীর্ণ এই আয়াতের পর আর কোনো বিধি-বিধানের আয়াত নাজিল হয়নি।

জিলহজ মাসে হজ করতে হয়, যেটি ইসলামের চতুর্থ রুকন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ ও ওমরাহ পূর্ণ করো। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৬)

হজ এমন একটি ইবাদত, যার প্রতিদান একমাত্র জান্নাত। (বুখারি, হাদিস : ১৭৭৩, মুসলিম, হাদিস : ১৩৪৫)
আর এ মাসের ১০ তারিখ মুসলিম মিল্লাতের ‘ঈদুল আজহা’র দিন।

ঈদুল আজহার দিনে যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে তাদের আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহর পথে কোরবানি দিতে হবে। আদমপুত্র হাবিল ও কাবিল কোরবানির সূচনা করেন। আল্লাহ সে ঘটনা রাসুল (সা.)-কে স্মরণ করিয়ে বলেন, ‘আপনি তাদের কাছে আদমের দুই পুত্রের সংবাদ সত্যসহ পাঠ করুন। যখন তারা দুজন কোরবানি পেশ করেছিল, তাদের একজনের কোরবানি কবুল হলো, অন্যজন থেকে কবুল করা হয়নি। ’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ২৭)

হাবিল নির্ভেজাল ইখলাস ও আল্লাহ ভীতি সহকারে কোরবানি করেছিলেন আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে। তাঁর কোরবানি আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়। পক্ষান্তরে কাবিলের কোরবানিতে নিষ্ঠা ও তাকওয়ার অভাব থাকায় তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এই সূত্র ধরে যুগে যুগে সব জাতির ওপর কোরবানির বিধান দেওয়া হয়। আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক জাতির জন্য কোরবানি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যাতে তা জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে। ’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩৪)

এভাবে মহান আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মদির ওপর কোরবানির বিধান দিলেন কাউসার দানের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে কাউসার দান করেছি। তাই আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় করুন এবং কোরবানি করুন। ’ (সুরা : কাউসার, আয়াত : ১-২)

কোরবানির প্রধান উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আল্লাহ বলেন, ‘কোরবানির পশুর রক্ত-মাংস আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তোমাদের পক্ষ থেকে তাকওয়াই আল্লাহর কাছে পৌঁছায়। এভাবে জন্তুগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করো এ কারণে যে তিনি হিদায়াত দিয়েছেন। আর সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ জানিয়ে দিন। ’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩৭)
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তোমাদের আকৃতি ও সুন্দরের দিকে দেখেন না, বরং তোমাদের হৃদয় ও আমলের দিকেই দৃষ্টি দেন। ’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৭০৮)

সর্বোপরি জিলহজ মাস গোটা মুসলিম মিল্লাতের জাতীয় উৎসবের দিনগুলোর অন্যতম। ইবাদত-বন্দেগি করে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের মাধ্যমে আমরা এই মাস উদযাপন করতে পারি।

লেখক : অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ০৮১৯ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।