ইসলাম উদযাপন-কেন্দ্রিক ও অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও কোরবানিসহ ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের বাহ্যিক নিয়ম-বিধান ও আচরণ-শৈলী রয়েছে।
বিত্তবান, সচ্ছল ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও প্রান্ত থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ হজ পালন করেন।
তাদের এই আমল—যাত্রা কিংবা ভ্রমণেই শেষ হয়ে যায় না। পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, হজের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আখিরাতের পাথেয় সঞ্চয় করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নির্দিষ্ট মাসে (শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজে) হজ অনুষ্ঠিত হয়। অতএব, এই মাসগুলোতে যার ওপর হজ ফরজ হয়, সে যেন (হজে গিয়ে) স্ত্রী সম্ভোগ, অনাচার ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত না হয়। তোমরা যেসব সৎ কাজ করো, আল্লাহ তা জানেন। আর (পরকালের) পাথেয় সংগ্রহ করো, নিশ্চয়ই তাকওয়া বা আল্লাহভীতি-ই হলো শ্রেষ্ঠ পাথেয়। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৭)
হাজিরা হজের মাধ্যমে তাওহিদ তথা আল্লাহর নিরঙ্কুশ একত্ববাদের স্বীকৃতি দেয়। এবং এরই আলোকে জীবন প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়। কাজেই হজ থেকে তাওহিদের দীক্ষা নিয়ে ফেরাটা গুরুত্বপূর্ণ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসুলের পক্ষ থেকে মহান হজের দিনে মানুষের প্রতি (বিশেষ) বার্তা হলো, আল্লাহর সঙ্গে অংশীবাদীদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং তার রাসুলের সঙ্গেও নেই। ’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ৩)
হজ কবুল হওয়ার নিদর্শন
যাদের হজ কবুল হয়, তাদের জীবনের মোড় ও কর্মের অভিযাত্রা ঘুরে যায়। ভবিষ্যতে গুনাহ থেকে বিরত থাকার আগ্রহ বাড়ে। আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি মানুষ যত্নবান হয়। হজ করার পর যার জীবনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি, তার হজ কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয়। (আপকে মাসায়েল, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ২৫)
এ বছর সর্বাধিক বয়সী হাজিকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে সৌদি-কর্তৃপক্ষ। ছবি: সংগৃহীত
মুসলিম মনীষীদের একটি বহুল আলোচিত বাণী এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তারা বলেছেন, ‘নেক কাজের প্রতিদান হলো, এর পরেও নেক কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। আর পাপ কাজের প্রতিদান হলো, এর পরেও পাপ কাজ অব্যাহত করে যাওয়া। ’
অনেকের হজ সন্দেহযুক্ত
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান হজে যান। কিন্তু কয়জনই বা নিষ্পাপ হয়ে ফিরতে পারেন?
দেশে গুণী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে; তবে সমাজের অনাচার কি কমছে? দেশ ও সমাজ তাদের মাধ্যমে কতটুকু উপকৃত হচ্ছে। তারাও কি যথাযথভাবে পরিশুদ্ধ হতে পারছেন? অনেকজনের হজ-ওমরাহ হানিমুন, শপিং, পর্যটন ও প্রমোদভ্রমণ উপলক্ষে দেশ-দেশান্তরে ছুটে চলার চেয়ে ভিন্ন নয়। মক্কা-মদিনার জিয়ারত ও পবিত্র সফর—তাদের শুভবুদ্ধি ও সুন্দর অনুভূতি জাগ্রত করতে পেরেছে? যদি না হয়, তাহলে তারা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। তাদের হজ কবুল হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ ভালো জানেন।
হজ থেকে ফেরার পর আমল
হজ থেকে ফিরে এসে নিকটস্থ মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নাত। হজরত কাব বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন মসজিদে (নফল) নামাজ আদায় করতেন। ’ (বুখারি শরিফ) হজ থেকে ফিরে শুকরিয়াস্বরূপ গরিব-মিসকিন ও আত্মীয়স্বজনকে খাবারের দাওয়াত দেওয়া বৈধ। ইসলামী ফিকহের পরিভাষায় সে খাবারকে ‘নকিয়াহ’ বলা হয়।
জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘রাসুল (সা.) যখন মদিনায় এসেছেন, তখন একটি গরু জবাইয়ের নির্দেশ দেন। জবাইয়ের পর সাহাবিরা তা থেকে আহার করেছেন। ’ (বুখারি) তবে অহংকার, লোকদেখানো ও বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে এমন দাওয়াতের ব্যবস্থা করা ইসলাম অনুমোদন করে না। (ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া, খণ্ড: ৭, পৃষ্ঠা: ১৮৫)
ঘরে ফিরে দুই রাকাত নামাজ
হজ থেকে দেশে ফেরার পর ঘরে পৌঁছে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা মুস্তাহাব। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যখন তুমি ঘর থেকে বের হবে, তখন দুই রাকাত নামাজ পড়বে। সেই নামাজ তোমাকে ঘরের বাইরের বিপদাপদ থেকে হেফাজত করবে। আর যখন ঘরে ফিরবে, তখনো দুই রাকাত নামাজ আদায় করবে। সেই নামাজ তোমাকে ঘরের অভ্যন্তরীণ বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করবে। ’ (মুসনাদে বাজ্জার)
হজযাত্রীদের অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা
যারা হজ করে আসছেন, তাদের অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানানো, তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, মুসাফাহ ও কোলাকুলি করা এবং তাদের দিয়ে দোয়া করানো মুস্তাহাব। কিন্তু ফুলের মালা দেওয়া, তাদের সম্মানার্থে স্লোগান ইত্যাদি দেওয়া সীমা লঙ্ঘনের অন্তর্ভুক্ত। এসব কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। (আপকে মাসায়েল আওর ইনকি হল, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৬২)
জমজমের পানি পান করানো
হজে গেলে হজযাত্রীরা জমজমের পানি সংগ্রহ করেন। বাড়িতে আসার সময় নিয়ে আসেন। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। জমজমের পানি নিয়ে এসে লোকদের পান করানো মুস্তাহাব। অসুস্থ রোগীদের গায়ে ব্যবহার করাও বৈধ। (মুয়াল্লিমুল হুজ্জাজ, পৃষ্ঠা: ৩০৩)
আয়েশা (রা.) জমজমের পানি সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন এবং বলতেন, ‘রাসুল (সা.) জমজমের পানি সঙ্গে নিয়ে যেতেন। ’ (তিরমিজি, হাদিস: ১১৫)
হজযাত্রীদের হাদিয়া-উপহার
আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-পড়শী ও যে কাউকে হাদিয়া-তোহফা দেওয়া সুন্নত। কিন্তু মনের আগ্রহ ছাড়া দেওয়া অনুচিত। কারণ শুধু প্রথা পালনের জন্য কোনো কাজ করা শরিয়তসম্মত নয়। হাজিদের উপহার দেওয়া ও তাদের থেকে হাদিয়া নেওয়া এক ধরনের প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এটা নামের জন্য বা চক্ষুলজ্জার কারণে দেওয়া হয়। তাই এসব কাজ বর্জন করা উচিত। (আপকে মাসায়েল, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ১৬১)
‘হাজি সাহেব’ বা ‘আলহাজ’
বস্তুত মানুষ ইবাদত-বন্দেগি করে একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য। কেউ নিয়মিত ঠিকভাবে নামাজ পড়লে তাকে কেউ ‘নামাজি সাহেব’ বলে না অথবা এ ধরনের কোনো উপাধী ব্যবহার করা হয় না। তেমনি হজ করলেই ‘হাজি সাহেব’ বলা নিয়ম নয়। ‘হাজি সাহেব’ বা ‘আলহাজ’ হওয়ার জন্য হজ পালন করা অবৈধ।
তবে মানুষজন যদি সম্মানার্থে ‘হাজি সাহেব’ বলে ডাকেন, তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজের নামের সঙ্গে ‘হাজি’ বা ‘আলহাজ’ ব্যবহার করা অসঙ্গত। পাশাপাশি কেউ এ বিশেষণটি উল্লেখ না করলে, মনঃক্ষুণ্ন হওয়াও গর্হিত। (মুকাম্মাল মুদাল্লাল মাসায়েলে হজ ও ওমরাহ : ৩২১)
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০২২
এসআই