ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

ফরিদপুরে সংরক্ষিত মহানবী (সা.) ও সাহাবিদের পবিত্র নিদর্শন!

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০২২
ফরিদপুরে সংরক্ষিত মহানবী (সা.) ও সাহাবিদের পবিত্র নিদর্শন!

ফরিদপুর: ফরিদপুর সদর উপজেলার গেরদা দরগাবাড়ি জামে মসজিদের একটি কক্ষে সংরক্ষিত আছে দুষ্প্রাপ্য ও মহামূল্যবান কিছু সম্পদ।

সেখানে নাইট্রোজেন গ্যাসভরা কাচের জারে রাখা আছে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র দাঁড়ি মোবারক, হজরত আলী (রা.)-এর গোঁফ মোবারক, হজরত ইমাম হাসান (রা.) ও হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কানের দুপাশের দাঁড়ির ওপরের অংশের চুল।

এ ছাড়ার সুরক্ষিত আছে বড় পীর হজরত শেখ সাইয়েদ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর জামা ও হজরত শাহ মাদার (রহ.)-এর ফতুয়া। আছে হজরত শাহ আলী বাগদাদি (রহ.)-এর পাগড়ি, জায়নামাজ, তসবিহ (মাছের দাঁতের তৈরি) ও খাবার খাওয়ার থালা-বাটি (চন্দন কাঠের তৈরি)।

কথিত আছে, ইসলামের  চার খলিফার অন্যতম হজরত আলী (রা.) - এর ছেলে ইমাম হোসাইনের বংশধর হজরত শাহ আলী বাগদাদি (রহ.) ইসলামের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে ৯০০ হিজরির দিকে (প্রায় ৫৫০ বছর আগে) বাগদাদ থেকে ভারতের দিল্লিতে আসেন।

সেখান থেকে বাংলাদেশে আসার সময় এই দুষ্প্রাপ্য সম্পদগুলো সঙ্গে এনেছিলেন। এর পর থেকে পবিত্র নিদর্শনগুলো ফরিদপুর সদর উপজেলার গেরদা দরগাবাড়ি জামে মসজিদের বিশেষ রুমে সংরক্ষিত আছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুরোনো মসজিদের অখণ্ড পাথরের তৈরি পিলার বা স্তম্ভসহ অনেক নিদর্শন এখনো অক্ষত। নতুন মসজিদের দুই প্রবেশপথে অখণ্ড পাথরের চারটি পিলারের অংশবিশেষ শোভা পাচ্ছে।

এছাড়া নতুন মসজিদের প্রদর্শনী কক্ষের সামনে পাথরের একটি ফলকে ফারসি ভাষায় লেখা, ১০১৩ হিজরি ও সুরা জুমার আয়াত।

এর থেকে অনুমান করা যায়, শাহ আলী বাগদাদি (রহ.)-এর মৃত্যুর পর এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। ফলকটি বর্তমানে নতুন মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে লাগানো আছে।

শিলালিপিতে ফার্সি ভাষায় লেখায় যা বলা হয়েছে: পরম করুণাময় আল্লাহর নামে। ‘হে মুমিনগণ, যখন জুমার দিন নামাজের আহ্বান করা হয়, তখন আল্লাহর স্মরণের দিকে দ্রুত যাও এবং বেচাকেনা ত্যাগ কর। ’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে আল্লাহর জন্য একটি মসজিদ বানায়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানান। ’ রহমানি দরগার বান্দা বাহাদুর খান সোলতানি, তারিখ ১০১৩।

নতুন মসজিদের সামনে আরেকটি ফলকে বাংলায় লেখা—‘হজরত শাহ আলী বাগদাদি (রঃ) কর্তৃক আনিত রাসূলে করিম হজরত মুহাম্মদ (দ.), হজরত আলী (রা.), হজরত ইমাম হাসান (রা.), হজরত ইমাম হুসাইন (রা.), হজরত শেখ আবদুল কাদের জিলানী (র.) এবং অন্যান্য পূণ্যাত্মাদের পবিত্র নিদর্শনাদি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে গেরদায় নির্মিত মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সদস্য প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান। ’ তারিখ লেখা আছে ‘৭ই এপ্রিল ১৯৭৮ সাল’। সৈয়দ আলী আহসান তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ছিলেন।

ফরিদপুরে এই নিদর্শনগুলো সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ফরিদপুর মুসলিম মিশনের সাধারণ সম্পাদক, রাজেন্দ্র কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক আবদুস সামাদ বলেন, ‘মহানবী (সা.)-এর দাড়ি মোবারকসহ অনেক বরকতময় নিদর্শন হজরত শাহ আলী বাগদাদি (রহ.) সঙ্গে নিয়ে আসেন। আমি ১৯৭৩ সালে এই নিদর্শনগুলো প্রথম দেখি। তার বংশধরগণ নিদর্শনগুলো অত্যন্ত যত্নসহকারে যুগ যুগ ধরে সংরক্ষণ করে আসছেন। এরপরও অনেকবার সেখানে গিয়েছি এবং হুজুরের আওলাদের সান্নিধ্য নিয়েছি। বংশপরম্পরায় তারা শাহ আলী বাগদাদি (রহ.)-এর রেখে যাওয়া এসব নিদর্শন তিনি যেভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, সেভাবেই বিশ্বাস করে আসছেন।

ফরিদপুর বাকিগঞ্জ ইসলামিয়া ফাজিল (বিএ) মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা রেশাদুল হাকিম এ বিষয়ে বলেন, ‘মসজিদটি সম্পর্কে আমি জানি। অনেকবার সেখানে গিয়েছি। সেখানে অনেক পাথর ইয়েমেন থেকে আনা হয় বলে ওস্তাদদের কাছে শুনেছি। সেখানে সংরক্ষিত মহানবী (সা.), সাহাবিসহ বুজুর্গদের বরকতময় নিদর্শনগুলো আমাদের সম্পদ। ’

গেরদা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ‘মসজিদটি সম্পর্কে বংশপরম্পরায় অবগত আছি। আমার পূর্বপুরুষেরা কয়েক দশক ধরে গেরদার গণ্যমান্য পরিবার। গত সপ্তাহেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব, ফরিদপুরের এডিসি ও এসিল্যান্ড মসজিদ পরিদর্শনে আসেন। আমি তাদের মূল্যবান নিদর্শনগুলো পরিদর্শন করাই। ’

ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) তাসলিমা আলী বলেন, ‘বিষয়টি আমি শুনেছি। তবে সেখানে যাওয়ার এখনো সুযোগ হয়নি। জেলা প্রশাসক মহোদয় দেশের বাইরে আছেন। তিনি দেশে ফিরলে তার সঙ্গে কথা বলে এই বরকতময় ও মূল্যবান নিদর্শনগুলো কীভাবে আরও ভালোভাবে সংরক্ষণ করা যায়, তা দেখব। ’

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি রুহুল আমীন বলেন, ‘ফরিদপুরের গেরদায় মহানবী (সা.)-এর কোনো স্মৃতিচিহ্ন আছে কি না তা আমার জানা নেই। তবে সে এলাকায় প্রকৃত সৈয়দ বংশের (সৈয়দ বংশ হলো মহানবীর বংশ) লোকজন বসবাস করেন, এটা আমার জানা আছে। ’

হজরত শাহ আলী বাগদাদি (রহ.) - এর বাংলাদেশে আগমন নিয়ে গবেষণামূলক বই লিখেছেন ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে গবেষক ড. মোহাম্মদ আলী খান।

তার বই ‘বর্ণে শব্দে চিত্রে ফরিদপুর’-এ উল্লেখ রয়েছে, সুলতানি আমলে বাংলাদেশে যে কয়েকজন মুসলিম সুফি-সাধকের আগমন ঘটেছিল, তাদের অন্যতম হজরত শাহ আলী বাগদাদি (রহ.)। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ থেকে তিনি ৪০ জন (মতান্তরে শতাধিক) আত্মীয়, ধর্মীয় সাধক, শিষ্যসহ দিল্লি হয়ে ফরিদপুরের (ফতেহাবাদ) গেরদায় এসেছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ঢোলসমুদ্র হিসেবে খ্যাত ছিল নদী তীরবর্তী জঙ্গলময় স্থান গেরদা। নদীর তীরেই অবস্থান করতেন শাহ আলী (রহ.) এবং সেখানেই একটি ঘরে ওই নিদর্শনগুলো রেখেছিলেন। তার আগমনের কারণে গেরদা বিশেষ স্থানের মর্যাদা পায়। তার সম্মানে মুঘল সম্রাটের নির্দেশে বাংলার তৎকালীন সুলতান ফরিদপুরের ঢোলসমুদ্র এলাকার ১২ হাজার বিঘা ভূমি করমুক্ত ঘোষণা করেছিলেন।

এ ইতিহাসের সঙ্গে একমত পোষণ করে গেরদা দরগাহবাড়ি জামে মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সেলিম আলী বলেন, শাহ আলী বাগদাদি (রহ.) এসব জিনিস সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি এখানেই থাকতেন। নিদর্শনগুলো স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে রেখে দাওয়াতি কাজে ঢাকার মিরপুরে যান, সেখানে অবস্থান করেন। তিনি মিরপুরে ইন্তেকাল করেন। সেখানেই হজরত শাহ আলী বাগদাদি (রহ.)-এর মাজার।

শাহ আলী বাগদাদি (রহ.)-এর বংশধর সাবেক অধ্যক্ষ সৈয়দ আবু সালাম মো. আলম বলেন, ‘এগুলো (স্মৃতিচিহ্ন) বছরে পাঁচবার সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা, শবে মিরাজ, ফাতেহা ইয়াজদাহম ও ঈদে মিলাদুন্নবীর দিন দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এসব বরকতময় জিনিস দেখতে আসেন। ’

তিনি আরও বলেন, এ ছাড়া বিশেষ কেউ এলে কিংবা আগে থেকে মসজিদ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে স্মৃতিবহ জিনিসপত্রগুলো দেখার সুযোগ মেলে। মাঝেমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা দেখতে আসেন। তখন এই পবিত্র নিদর্শনগুলো তাদের দেখানো হয়।

জানা যায়, শাহ আলী বাগদাদি (রহ.) নদীতীরবর্তী স্থানে পাথর দিয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তার মৃত্যুর ১০০ বছর পর সেই মসজিদের ভগ্নাবশেষের ওপর আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করা হয় হিজরি ১০১৩ সনের দিকে। বাংলার সুলতান বাকের শাহের উদ্যোগে পাথর দিয়ে মসজিদটি বানানো হয়েছিল। কালের আবর্তনে সেই মসজিদটিও বিলীন হয়ে যায়। আগের মসজিদের কিছু পাথর ব্যবহার করে ১৯৭৮ সালে নতুনভাবে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এর নাম ‘ঐতিহ্যবাহী গেরদা দরগাহবাড়ি জামে মসজিদ’।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০২২
এসএএইচ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।