শুক্রবার (১৮ মে) বিকেলে নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে কেসিসি নির্বাচন নিয়ে ‘খুলনা সিটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অবস্থান সম্পর্কে আমার কিছু কথা’ শীর্ষক একটি বক্তব্য পোস্ট করেন। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হল।
জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রেস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি লিখেছেন, খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোট বিপর্যয়ে আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত। গত দুটো দিন আমার কেটেছে দূর্বিসহ যন্ত্রণার মধ্যে। খুলনা মহানগর জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দের একান্ত অনুরোধে আমি মহানগর সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেটা করা হয়েছিল, মহানগরের সংগঠনের মধ্যে ঐক্য সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য। কিন্তু আমার কথা ছিলো, আহ্বায়ক হিসেবে শুধুমাত্র আমার নামটা রাখা যাবে, কোনো দায়িত্বের মধ্যে আমি থাকতে পারবোনা। যেহেতু আমাকে কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। মহানগরের নেতৃবৃন্দ এই শর্তে রাজি হয়ে আহ্বায়ক কমিটি পাস করিয়ে নেন। এই কমিটিতে একজনকে দায়িত্বপ্রাপ্ত আহ্বায়কও করা হয়। তিনি অন্য দলে চলে গেলে তালিকার ক্রমানুসার অনুযায়ী সৈয়দ খায়রুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয়। তারপরও আহ্বায়ক হিসেবে আমার নামটা থাকায় আমি নিজে সিটি নির্বাচনে ভোট বিপর্যয়ের জন্য একা আহ্বায়কের পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের কাছে আবেদন করলাম। কিন্তু চেয়ারম্যান এবং মহাসচিব মহোদয় আমার আবেদন গ্রহণ না করে খুলনা মহানগরের গোটা কমিটি ভেঙে দিলেন এবং আমার অনুরোধে মহানগরের থানা কমিটিগুলো বহাল রাখলেন।
তিনি লিখেন, নির্বাচনে ভোট বিপর্যয় কেনো হলো তার নেপথ্যের কিছু কথা এখানে বলতে চাই। যিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি বছর দেড়েক আগে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। খুলনা মহানগরের কয়েকজন নেতা এই প্রার্থী মুশফিকুর রহমানকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন। তার ইসলামী পোশাক-আশাক দেখে প্রথম দর্শনে চমকিত হয়েছিলাম। তাই তাকে পার্টি চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করিয়ে দিয়েছি। চেয়ারম্যান মহোদয়ও আমার মতো তার কথায় ও পোশাকে বিভ্রান্ত হয়ে তাকে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করাতে সম্মত হলেন। মুশফিক যোগদানের আগে আবদার করলেন যে, আগামী খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে তাকে মেয়র প্রার্থী করতে হবে।
চেয়ারম্যান তাতে সম্মত হয়ে যোগদান অনুষ্ঠানেই মুশফিককে খুলনার মেয়র প্রার্থী করার ঘোষণা দিলেন। এরপর চেয়ারম্যান মহোদয় খুলনা গিয়েও সাংবাদিক সম্মেলনে মুশফিককে খুলনায় জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে আসলেন। এই অবস্থায় কী করার ছিলো? যদি ঘোষণা অনুযায়ী মুশফিককে প্রার্থী করা না হতো তাহলে তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠতো যে, সাবেক রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু এরশাদ কথা দিয়ে কথা রাখেন না। আমি জানতাম, এই প্রার্থীকে দিয়ে আমরা ভালো ফল করতে পারবো না।
এরচেয়ে মোল্লা শওকত হোসেন বাবুল ভালো প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু চেয়ারম্যানের কথার সম্মান রক্ষার স্বার্থে এই প্রার্থীকে মেনে নিয়েছিলাম এবং মহানগরের সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম নির্বাচনে তার হয়ে কাজ করার জন্য। কিন্তু খুলনার পার্টির অধিকাংশ নেতা-কর্মী-সমর্থকরা তাকে মেনে নিতে পারছিলেন না। আমরা ভুল করেছিলাম প্রথমেই। মুশফিককে আমরা সঠিকভাবে চিনতে পারি নাই। তার ধর্মীয় লেবাসটা দেখেছি- ভিতরের মানুষটার আসল চেহারা দেখি নাই। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। আমরা যারা না-বুঝে তাকে দলে নিয়েছি সেই ভুলের মাশুল এতোটা হবে বুঝতে পারি নাই। যারা তাকে নিয়ে এসেছিলেন তাদের ভর্ৎসনা করেছি। তারাও নিজের মাথার চুল নিজে টেনেছেন। এতোকিছুর পরেও যা হবার হয়ে গেছে ভেবে আমি খুলনায় গিয়ে বিক্ষুব্ধ সব নেতা-কর্মীকে একসাথে বসিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে কাজ করার ব্যাপারে সবাইকে সম্মত করিয়েছিলাম।
কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব শফিকুল ইসলাম মধুকে আহ্বায়ক এবং মহানগরের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক সৈয়দ খায়রুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে নির্বাচন পরিচালনা কমিটিও গঠন করে দিয়েছিলাম। সবাইকে নিয়ে আমি প্রচারেও নেমেছি। কিন্তু মুশফিক সেই কমিটিকে কোনো প্রকার পাত্তা না দিয়ে নিজে নিজের মতো কাজ করেছেন। তার পোস্টার নাই, প্রচার নাই। আমি জানতে চেয়েছিলাম এজেন্ট ঠিক করা হয়েছি কিনা? তিনি বললেন, সব ঠিক আছে। অথচ কোনো কেন্দ্রে একজন এজেন্টও দেয়া হয়নি। তাহলে ভোট আসবে কিভাবে? খুলনায় মুশফিকের থাকারও কোনো জায়গা ছিলো না। তাকে সোনাডাঙ্গায় আমার এক ভাই সোমনাথের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। নির্বাচনের পুরো সময়টা তিনি সপরিবারে সেখানেই ছিলেন।
তিনি আরও লিখেন, নির্বাচনের পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে এবং খুলনার নেতা-কর্মীদের কথা শুনে আমি প্রার্থীকে বারবার অনুরোধ করেছি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার জন্য। কারণ, এটা কেন্দ্রের নির্দেশ ছিলো। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। আমাকে বোঝালেন যে, তিনি ২০ থেকে ৩০ হাজার ভোট এনে দেবেন। তার সাথে যারা ছিলেন তারাও আমাকে বোঝালেন যে, অবশ্যই লাঙ্গল প্রতীকে ২০ থেকে ৩০ হাজার ভোট আসবে। আমারও জানা আছে যে, খুলনা সিটিতে বিপুল সংখ্যক এরশাদ-অনুরাগী মানুষ আছেন। কিন্তু বুঝতে ভুল হয়েছে যে, খুলনা জাতীয় পার্টির ক্ষতি করতেই এই মেয়র প্রার্থীর অনুপ্রবেশটি ঘটেছিলো। তবে মানুষ যদি ভোট দিতে যেতে পারতো কিংবা গিয়ে যদি দেখতেন যে, তাদের নামে বরাদ্দকৃত ব্যালটটি আছে- তাহলে অন্তত লাঙ্গলে আরো কিছু ভোট আসতো। লাঙ্গল প্রেমীরা প্রার্থীর দিকে তাকাতেন না। জাতীয় পার্টির কাউন্সিলর প্রার্থীরা মোট যে ভোট পেয়েছেন- তার সমষ্টি মেয়র প্রার্থী পাননি।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে সুনীল শুভ রায় লিখেছেন, কেন্দ্রের অনুরোধ উপেক্ষা করে প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করা, কেন্দ্রকে ভুল তথ্য দেয়া, নির্বাচন করতে অসামার্থ্য, নির্বাচন পরিচালনা কমিটিকে এড়িয়ে যাওয়া এবং নির্বাচনের পর অসংলগ্ন বক্তব্য, বিবৃতি প্রদান, শীর্ষ নেতৃবৃন্দের প্রতি অশালীন কথা বলা ইত্যাদি কারণে পার্টির মহাসচিবের প্রস্তাবে চেয়ারম্যান সম্মতি দিয়ে মুশফিককে পার্টির প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পদ পদবি থেকে অব্যাহতি প্রদান করেছেন। আমার বিশ্বাস, খুলনা মহানগর জাতীয় পার্টি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। এখানে জাতীয় পার্টির অবস্থান এতোটুকু বিবর্ণ হয়নি একটি ধাক্কা লেগেছে মাত্র। এখান থেকে আগামীতে শিক্ষা নিতে হবে। তবে খুলনা মহানগরের কোনো সাংগঠনিক দায়িত্বে আর আমি থাকতে চাই না। মহানগরের নেতৃবৃন্দের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে- নতুন কমিটি গঠনের ব্যাপারে তারা যেনো কোনোভাবে আমাকে সম্পৃক্ত করতে না চান। স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে খুলনা মহানগরে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে উঠবে। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি গোটা খুলনা বিভাগ এবার এমপি শূন্য হয়ে পড়লেও রংপুর বাদে যেসব জেলা বা বিভাগে একাধিক সংসদ সদস্য আছেন তার তুলনায় খুলনা বিভাগের সাংগঠনিক অবস্থান এখনও সুদৃঢ় আছে। এই বিভাগের ১০ জেলার প্রত্যেকটিতে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি হয়েছে।
‘আমি খুলনা জেলারও আহ্বায়ক ছিলাম। শহীদ হাদিস পার্কে খুলনা জেলা জাতীয় পার্টির যে সুশৃঙ্খল এবং সুবিশাল সম্মেলন হয়েছে চেয়ারম্যান সেটাকে এখনও জাতীয় পার্টির একটি আদর্শ সম্মেলন হিসেবে বর্ণনা করেন। জাতীয় পার্টি আমার প্রাণ, পল্লীবন্ধু এরশাদ আমার হৃদয়। এই পার্টি এবং প্রিয় নেতাকে ভালোবেসে নিজেকে উজাড় করে আমি যা করেছি, তা আমার পর্যায়ের আর কেউ দেখাতে পারবেন না। ’ (সংক্ষেপিত)
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৮
এমএ/