ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

বিড়াল ও ৬ টুকরা ইলিশ মাছ

মোঃ নুর আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১২
বিড়াল ও ৬ টুকরা ইলিশ মাছ

চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে সকালের ঘুম ভাঙ্গলো। ভাবির চেঁচামেচি ।

বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে টাইম দেখলাম, সাড়ে আটটা। অনেক রাতে ঘুমিয়েছি তাই ঘুম পুরোপুরি হয়নি। শুয়ে শুয়ে বুঝবার চেষ্টা করছি ব্যাপারটা কি। ভাবির গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, ‘এই বদমাইশটারে আর খাওয়ামুনা, বদমাইশ টারে খাওয়াইয়া কোনো লাভ নাই, আজকে যদি ওরে ঝাড়ু দিয়া না পিটাইছি আমার নাম............না.........ইত্যাদি ইত্যাদি। ’

আমার রুমে ঢুকে একেবারে মাথার কাছে এসে আমার পৌনে তিন বছরের ভাতিজা- চাচ্চু চাচ্চু উত্থ উত্থ, রওনক- আমার ভাতিজা। আমি আদর করে গুল্লি বলে ডাকি । এই বয়েসের বাচ্চাদের এতো কথা বলতে আমি কখনও শুনিনি। দিন-রাত শুধু কথা আর প্রশ্ন । প্রশ্ন আর কথা। ও এত বেশি কথা বলে যে ভাবি নিজেই মাঝে-মধ্যে বিরক্ত হয়ে যায়। আমি বেশিরভাগ সময় ওর কথা এঞ্জয় করি। এতো কিছু জানতে চায়, খুব ভালো লাগে আমার।

গুল্লি একেবারে আমার মাথের কাছে- চাচ্চু-চাচ্চু উত্থ-উত্থ। আমি চোখ মেলে তাকালাম- কিরে গুল্লি-বাবা কি হইসে?
ওকে টেনে বিছানায় তুলে নিলাম। চাচ্চু-বিড়ালটা না আমাদের সব মাছ খেয়ে ফেলেছে......গুল্লি বল্লো।

ভাবির গলা শুনা যাচ্ছে- নিজেরাই ঠিক মতো খায় না……. আবার বিড়াল পুশে…….. এত সোজা না……. বোবা জানোয়ার পুষলে খাবার দিতে হয়……..। না খাওয়াইয়া রাখলে বোবা জানোয়ার অভিশাপ দিবো... বিড়াল পুষে উনারা আর সাড়া বছর খাওন দেই আমি…… নিমকহারাম বিড়াল, তুই কেমনে আমার এতোগুলি মাছ খাইয়া ফালাইলি? তরে কি আমি জীবনেও মাছ দিয়া ভাত খাওয়াই নাই?

এতক্ষণে বুঝলাম ঘটনাটা কি। পাশের বাড়ির বিড়াল আমাগো মাছ খাইয়া ফালাইছে। মনে-মনে হাসলাম, ভাবিরে কতোবার কইছি ভাবি-অন্য মানুষের বিড়ালরে খাবার দিয়া তোমার লাভ কি? ভাবি বলে আরে- আর কইশনা, ওরা কি বিড়ালরে খাওন দেয় নাকি? সারা দিন দেখছনা আমাগো ছাদে ঘুর-ঘুর করে, যেই কিপ্টার-কিপ্টা, নিজেরাই ঠিক মতো খায় না আবার বিড়াল পুষে , আকেবারে খবিস......
 


আমাদের পাশের বাড়ির বিড়াল। অধিকাংশ সময় আমাদের ছাদে ঘুড়া-ঘুড়া করে, ঘুমায়। ভাবির ভালোবাসায় আমাদের মাছ-মাংশের কাটা-হাড্ডি সব এই বিড়ালটার পেটেই যায় । মাঝে-মাঝে বেশি ম্যাও –ম্যাও করলে এক টুকরা মাছ দিয়ে – ঝোল দিয়ে ভাত মেখে দেয় ভাবি। আমি বলি ভাবি এই অকালের বাজারে তুমি এক টুকরা মাছ বিড়ালকে দিয়ে দিলে? ভাবি খুব খুশি হয়, আর বলে, কি করবো বল শুধু ম্যাও ম্যাও করছে, খুব খুদা লেগেছে মনে হয়। ওই বাড়ির মানুষ কি খাওয়ায় নাকি কিছু? শুধু বড় বড় কথা ......কিপ্টার কিপ্টা ......খাওয়াবি না তো বিড়াল পোষার দরকার টা কি.........

আমি জানি ভাবি বিড়ালটাকে এত পছন্দ করে কেনো। কারণ ওই বাড়ির মহিলাকে ভাবি একদম দেখতে পারেনা। আমাদের তুলনায় ওদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। এটাই হচ্ছে কারণ। সচ্ছলতার বহিঃপ্রকাশ মানুষের মধ্যে থাকবেই। পাশের বাড়ির মহিলা ও তার ব্যতিক্রম না।   বিড়ালের মালিককে পছন্দ না করার এটাই মূল কারণ আমার ধারনা।


দাঁত ব্রাশ করতে-করতে ভাবিকে বললাম ভাবি কি হইসে? ভাবি বল্লো- অন্য মাছ হইলে আমি কোনো কিছুই বলতাম না, আমার ৬ টুকরা ইলিশ মাছ খাইয়া ফালাইছে, আমি ছারমু না ওই মহিলারে, আমার ইলিশ মাছ কিন্না দিতে হইব...

আমি বললাম ভাবি বাদ দাও, মাছ খাইছে বিড়ালে , ওই বাড়ির মানুষে তো আর মাছ খায় নাই। আর বিড়ালটারে তো তুমিই লাই দিছ... তোমারে কতো দিন কইছি অন্য মানুষের বিড়ালরে খাওয়াইয়া লাভ কি? তুমি তো আমার কথা শুনো না। এবার মজা বুঝো।



আমি পরে গেলাম ঝামেলায়। আমাদের বাড়ি ভাইবোনদের প্রচেষ্টায় পাঁচ তলা পর্যন্ত হয়েছে। আমার নামে একটা ফ্ল্যাট আছে বটে, কিন্তু আমি একা মানুষ একটা ফ্ল্যাট দখল করে থেকে লাভ কি। তাই মেঝ ভাইয়ার সাথে থাকি। মেঝ ভাইয়ের সাথে থাকার আর ও কিছু কারণ আছে, ভাইয়া আমার ৬ বছরের বড় হলেও আমরা দুজন এক রুমে থেকেছি দীর্ঘদিন, যখন বাড়ি একতলা টিনশেড ছিল। বড় দু’ভাই থাকতেন আলাদা দু’রুমে, আর আমরা দু’ভাই থাকতাম এক রুমে। এজন্য অন্য দু’ভাইর তুলনায় মেঝ’র সাথে আমার জোগাজোগটা অনেক ভালো। ও আমার সব ব্যাপার খুব সহজেই বুঝে। মেঝর বিয়ের পর ভেবেছিলাম ভাবিটা না জানি কেমন হবে,  কিন্তু না, ভাবিতা আমার চমৎকার, ব্যবহারে এবং মনের দিক থেকেও। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার বড় বোন এ বাড়িতে থাকলে হইতো ঠিক এ যত্ন পেতাম। যাইহোক বড় আপা অস্টেলিয়াতে, খুব মিস করি, ভাবিকে দেখলে আবার ভুলে যাই ।

তাই মেঝ’র সাথেই থাকি। খুব ভালো লাগে, সবচাইতে ভাল লাগে গুল্লিকে। মেঝর একমাত্র ছেলে।



কেন জানি মনে হচ্ছে ঘটনাটা অনেক দূর গড়াবে। ভাবিকে জোর দিয়ে কিছু বলতেও পারছিন না। একবার শুধু বললাম –ভাবি বাদ দেন বিড়াল একটা অবুঝ প্রাণি, কি আর করবেন, বাদ দেন...
 
কে শুনে কার কথা । আমাকে ধমক দিয়ে বললেন তোর কি ইলিশ মাছের দাম সম্বন্ধে কোন আইডিয়া আছে? তোর ভাই ৮০০ টাকা দিয়া ইলিশ মাছটা কিনা আনছে... আরে বিড়ালের তো দোষ না, দোষ হইল অই মহিলার (আগে ভাবি ওই মহিলাকে ভাবি বলেই ডাকতো , কি গণ্ডগোল হয়েছে জানিনা, এখন শুধু “অই মহিলা” বলে ডাকে) ওই মহিলা যখনই বিড়ালটার খুদা লাগে তখনি আমাদের ছাদে পাঠাইয়া দেয়। ওই মহিলা একটা বদ।

ওই মহিলাকে ভাবি ডাকা বন্ধ করছে আমি মনে মনে খুশি হইছি। যার মেয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স করছে, আমার ভাবি কেন তাকে ভাবি ডাকবে, আমার ভাবির ছেলের বয়স মাত্র পোনে তিন বছর। আমার ভাবি তাকে ডাকবে খালাম্মা,  আমিও সুযোগ পেলে খালাম্মা ডাকবো। দু’একবার ডেকেছিও। ডাকব না, মেয়ে যে অত্যাধিক সুন্দরি...



আমরা ৫ তলায় থাকি। ৫ তলার অর্ধেকটায় রুম করা হয়েছে, বাকি অর্ধেকটা ফাঁকা । ফাঁকা হওয়াতে ভালই হইছে, কিছু টব রাখা যাচ্ছে, বিকেল বেলা একটু ঘুরাঘুরি করা যাচ্ছে, গুল্লি-আমার ভাতিজা দৌড়া-দৌড়ি করতে পারছে, ঢাকা শহরে এর চাইতে বর পওনা আর কি? আমাদের বাড়ির ডানে এবং বায়ে দু’টো এপার্টমেন্ট। আমরা যেহেতু ৫ তলাই থাকি বাম বাসের এপার্টমেন্টে ৫ তলায় যারা ফ্ল্যাট কিনে এসেছে, প্রথম-প্রথম আমার ভাবির সাথে তাদের খুব খাতির ছিল। আজ তাদের বিড়াল আমার ভাবির ৬ টুকরা ইলিশ মাছ খেয়ে ফেলেছে। আগের সেই সু’সম্পর্ক থাকলে ভাবি হয়তো বলতো, থাক ভাবি বিড়াল সামান্য কয়টা মাছ খেয়েছে তাতে কি হয়েছে... কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন, বিড়াল মাছ খেয়েছে, বিড়াল এর মালিকের চোদ্দ-গুস্টি উদ্ধার হবে......অনেক দিনের ঝাল মিটাবে ভাবি......



একদিন আমি ছাদে গাছে পানি দিচ্ছি-বিকেলে, গুল্লি আমার সাথে ঘুর-ঘুর করছে। ওই ছাদ থেকে কে জেনো ডাকল এই বাবু, এই বাবু এইদিগে এসো......তাকালাম, দেখি ওই ৫ তলার মেয়েটা হাত ইশারা করে গুল্লিকে ডাকছে, বেশ সুন্দরি তো। গুল্লি আমার দিগে তাকালো – আমি বললাম – যাও চাচ্চু- আন্টি ডাকছে তোমাকে- যাও ......
তোমার নাম কি বাবু? গুল্লিকে জিজ্ঞেস করলো ওই মেয়ে...
লওনক আমার নাম...তোমার নাম কি? গুল্লিও জিজ্ঞেস করলো......
আমার নাম পম্পা- মেয়েটি বলল, গুল্লি আবার জিজ্ঞেস করল কি ? মেয়েটি বলল পম্পা—পম্পা...
তোমার আম্মু কই?
আমার আম্মু ঘরে, গুল্লি বলল, মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করল তুমি কি করছ?
গাছে পানি দেই, গুল্লি বলল, ওইটা তোমার কে হয়? আবার জিজ্ঞাস করলো মেয়েটি...।

আমার চাচ্চু............

আমি আবার তাকালাম মেয়েটার দিকে, নামটা যেন ভুলে না যাই তাই তিন-চার বার বললাম পম্পা-পম্পা-পম্পা।
চম্পা থেকে পম্পা। আজকাল এরকম হচ্ছে। টাকা পয়সা হয়ে গেলে নাম কিছুটা পরিবর্তন হয়ে যায়। কে জানে হইতো এই পম্পার আগে নাম ছিল চম্পা। যাইহোক ফেসবুকে সার্চ করে দেখতে হবে অ্যাকাউন্ট আছে কিনা, ঢাকা ইউনিভার্সিটির কেউ ফেসবুক থাকার কথা...



অনেক খোজা-খুজি করে শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল পম্পাকে। শুধু নিকনেম দিয়ে ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া আসলেই খুব মুশকিল । যাইহোক খুঁজা-খুঁজি করে পেয়ে গেলাম, প্রফাইলে ওর ফটো ছিল বলে। পুরা নাম ইস্মাত জামান পম্পা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । কেমিস্ট্রি । ২য় বর্ষ । পম্পাকে খুঁজে বের করতে অত পরিশ্রম আর সময় লেগেছে যে, খুঁজে পাওয়ার সাথে সাথে কোন কিছু চিন্তা না করেই রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিয়েছি।
 
আজ প্রায় ১ সপ্তাহ যাবৎ ছাদে যাই না, ভয়ে, সুজগ পেলেই মোবাইলে ফেসবুকে লগইন করি। কিন্তু না ও একসেপ্ট করছে না। ও তো ফেসবুকে নিয়মিত ঢুকে, প্রতিদিন কোন না কোন স্ট্যাটাস দেখি। ও কি আমাকে চিনতে পারছে না? নাকি ঢাকা ইউনিভার্সিটি বলে একটু ভাব নিচ্ছে? আমি কি ওর চাইতে কম নাকি? জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি, এন্থ্রোপোলজি, ফাইনাল ইয়ার। ছাদে যেতে পারছি না, গাছগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে মনে হয়, পানি দেয়া দরকার, লজ্জায় যেতে পারছিনা।   এখন মনে হচ্ছে রিকোয়েস্ট পাঠানোটাই ভুল হইছে। একসেপ্ট না করলে ইজ্জত এর ব্যপার।



ভাবির চিৎকার চেচামেচিতে পম্পার মা এসে পড়েছে ওদের ছাদে । আর যাই কোথায়, ভাবি আমার সারা বছরের ঝাল একেবারে মিটাচ্ছে। ছোট-লোক, কুঞ্জশ, ইত্যাদি  ইত্যাদি বলে একেবারে হুলুস্থুল কান্ড... যতই বলি- ভাবি থামো- অনেক হইছে, ভাবি আমাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়- তুই কি জানিস ৬ টুকরা মাছের দাম কত? একদম কথা বলবিনা, এগুলি হইলো ছোট লোকের লক্ষণ, বিড়ালকে ঠিক মতো খাবার দেয় না, আবার বিড়াল পুষে...

আমি গুল্লিকে নিয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লাম, ভাবিকে থামানো সম্ভব না, কারণ এইটা ভাবির অরেক দিনের রাগ.... আমি ফেসবুকে ঢুকলাম একছসপ্ট করেনি পম্পা, হঠাৎ কি মনে করে পম্পার ওয়াল ভিজিট করলাম......পম্পা ৩ মিমিট আগে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে, ও ওয়ালে...
‘৬ টুকরা ইলিশ মাছের জন্য যাদের এই আচরণ , তাদের ফ্রেন্ড-রিকোয়েস্ট কি একসেপ্ট করা উচিৎ?’


বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ ‍আল সায়ার / আরিফুল ইসলাম আরমান, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।