ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

স্মৃতির মিনার গড়েছি আমরা

ইমরুল ইউসুফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৩
স্মৃতির মিনার গড়েছি আমরা

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর শুধু আমাদের নয়। একুশ এখন পৃথিবীর সব মানুষের, সব ভাষাভাষী জনগণের।

২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্বব্যাপী পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাবতেই মন আনন্দে নেচে ওঠে। কিন্তু এর পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। যে ইতিহাস রক্তে মোড়ানো। তাইতো আমাদের ভাষার রং লাল,  ইতিহাস লেখা অক্ষরগুলো রক্তাক্ত। এ ইতিহাস দুঃখের কিংবা শোকের হলেও গর্বের।

sohid-minarবুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে তাই আমরা বলি, আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই শহীদদের স্মরণ করার দিন। ফুল হাতে নিয়ে শহীদ মিনারে যাওয়ার দিন।

বন্ধুরা, তোমরা সবাই জানো এদেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অনেক শহীদ মিনার। আমাদের ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে শহীদ মিনার নির্মাণও ছিল সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ভয় পেতো শহীদ মিনারকে। তাইতো তাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বাংলার দামাল ছেলেরা নির্মাণ করেছিল দেশের প্রথম শহীদ মিনার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল গেটের পাশে ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু শাসক গোষ্ঠীর পোষা পুলিশ ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঐ স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। বন্ধুরা, তোমাদের সঙ্গে এখন প্রথম স্মৃতির মিনার বা শহীদ মিনার ভাঙাগড়ার গল্প করবো।

২১  ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় গাজীউল হকের সভাতিত্বে সভা শুরু হয়। এই সভাতেই ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ছাত্রছাত্রীরা দলে দলে মিছিল নিয়ে এগোতে থাকে। পুলিশ এ সময় কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে। পরে সবাই জড়ো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে।
sohid-minar
বিকেল ৪টায় ১০ জন করে এক একটি দল মেডিকেলের গেট দিয়ে রাস্তায় নামতে থাকে। এসময় পুলিশ মিছিলের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। গুলিতে আবদুল জব্বার (৩০), আবুল বরকত (২৫), শফিউর রহমান (৩৪) এবং রফিকউদ্দিন আহমদ (২৬) শহীদ হন। ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালনের পর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে গড়ে তোলা হয় দেশের প্রথম শহীদ মিনার।

তোমরা জেনে আশ্চর্য হবে এই মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে নির্মাণ সমাপ্তি পর্যন্ত সব কৃতিত্ব মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের একার। বিশিষ্ট চিকিৎসক সাঈদ হায়দারের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়- অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল বা বিদ্যায়তনের কর্মী বা ছাত্ররা এর সঙ্গে যুক্ত ছিল না। মেডিকেলের ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তা-চেতনার প্রকাশ; তাদের সম্মিলিত শ্রমের ফসল এই মিনার।
এর প্রাথমিক নকশা তৈরিতে মেডিকেলের সাঈদ হায়দার ও বকরুলের সম্পৃক্ততাই সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া তাদের সঙ্গে আরও যারা সক্রিয়ভাবে ওইদিন অংশ নিয়েছিলেন তারা হচ্ছে-আজমল, আহমদ রফিক, আজগর, সিরাজ জিন্নাত, তাহের চৌধুরী, সালাম, কবির, হাই, গোলাম মাওলা ও শরফউদ্দিন।
sohid-minar
ছাত্ররা হাতে হাতে ইট বয়ে এনেছিল হাসপাতাল সম্প্রসারণের কাজের জন্য রাখা স্তুপ থেকে। ঠিকাদারের গুদাম থেকে বয়ে এনেছিল সিমেন্ট, বালি। মাত্র দুজন মিস্ত্রির নিপুণ হাতের সহায়তায় এক রাতেই এই অসাধ্য সাধন করেছিল তারা। ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শুরু করে রাত্রির মধ্যে তা সম্পন্ন করা হয়। পরদিন সকালে, অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ শফিউরের পিতা মৌলবী মাহবুবুর রহমানকে এনে মিনার উদ্বোধন করা হয়। ২৬ তারিখ পুনর্বার এই একই মিনার উদ্বোধন করেন পাকিস্তান সরকারের সদ্য পদত্যাগকারী অ্যাসেম্বলি সদস্য ও ‘আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন।

বাইরে কারফিউকে উপেক্ষা করে নির্মিত প্রথম ঐ শহীদ মিনারে স্থাপত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে হয়তো কোনো শৈল্পিক ব্যঞ্জনা বা ভাব ছিল না। কিন্তু এক রাতে গড়া ঐ মিনারটিই হয়ে উঠেছিল ভাষা আন্দোলনের এক অনন্য শক্তির প্রতীক। তখনই শহরময় শহীদ মিনার তৈরির এ খবর ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে ছুটে আসতে থাকে মানুষ। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোর কেউই বাদ যায়নি সেদিন। রাতেই শহীদ মিনারের পাদদেশ ভরে ওঠে মানুষের পদভারে। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসা অসংখ্য মানুষের আগমনে ঢাকা মেডিকেলের হোস্টেল প্রাঙ্গণ যেন পরিণত হয়েছিল এক পবিত্র তীর্থক্ষেত্রে।
sohid-minar
ফুলে ফুলে ঢেকে গিয়েছিল প্রতিবাদের প্রতীক সেই প্রথম মিনার। কিন্তু সন্ত্রস্ত সরকার ভীত হয়ে ওইদিনই অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শহীদ মিনারটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। সরিয়ে ফেলে এর শেষ চিহ্নটুকুও। সেই শহীদ মিনারের উত্তরসুরি আজকের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে আছে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে। আজকের যে শহীদ মিনার তা নির্মিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে। শিল্পী হামিদুর রহমান ছিলেন বর্তমান শহীদ মিনারের স্থপতি বা ডিজাইনার।

১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই বাঙালিরা ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও শহীদদের সম্মানার্থে স্মৃতিসৌধ তৈরির আন্দোলন করে আসছিলেন। ১৯৫৬ সালে শিল্পী হামিদুর রহমান প্যারিস থেকে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৫৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান পিউব্লিউডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার এমএম জব্বারকে নতুন শহীদ মিনারের পরিকল্পনা ও বাস্তাবায়নের দায়িত্ব দেন। আহ্বান করা হয় শহীদ মিনারের মডেল বা ডিজাইন। সাতটি মডেলের মধ্য থেকে হামিদুর রহমানের মডেলটি নির্বাচিত হয়। মিনার তৈরির কাজ শুরু হয় ৫৭’র নভেম্বরে। ১৯৫৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহীদ মিনারের প্রথম পর্বের ভিত্তি, মঞ্চ এবং ৩টি স্তম্ভ নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এবং এর পুরাপুরি নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৬২ সালে।

স্থপতি হামিদুর রহমান মিনারের সবচেয়ে উঁচু স্তম্ভটির দুই পাশের ছোটো স্তম্ভগুলোকে যুদ্ধ ও শান্তি, ভালোবাসা ও মর্মপীড়া এবং কান্না ও সান্তনার একক নীরব প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেন। আর এর মধ্যবর্তী সবচেয়ে উঁচু কলাম দুটিতে মা তার সন্তানকে মাথা নিচু করে আশীর্বাদ জানাচ্ছে এমন ভাবনা দেখান তার করা নকশায়। হামিদুর রহমানের ডিজাইনের এই শহীদ মিনার মায়ের প্রতীকী ভাবনা গোটা দেশের ‘আমার মায়ের মুখ’ হয়ে ওঠে।
sohid-minar
’৫২ সালের পর থেকে সাড়ম্বরে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে। কিন্তু ’৫৬ সালের আগ পর্যন্ত শহীদ দিবস সাংবিধানিক কোনো স্বীকৃতি পায়নি। পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সর্বপ্রথম শাসনতান্ত্রিকভবে স্বীকৃতি পায়। যার ধারাবাহিকতায় ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। এদেশের প্রতিটি জাতীয় সংকটের মুহূর্তে এবং প্রতিটি গণআন্দোলনে এই মিনার আমাদের উজ্জীবনী শক্তি জোগায়; হয়ে ওঠে প্রেরণার উৎস। এবছর আমাদের ভাষা আন্দোলনের ৬১ বছর পূর্ণ হবে। বন্ধুরা এসো, আজ আমরা সবাই সমস্ত ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।