ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

অদ্ভুত পাঠক এক আসিয়াছে মেলায়!

তানিম কবির, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৩
অদ্ভুত পাঠক এক আসিয়াছে মেলায়!

বইমেলা থেকে: তিনদিনে প্রায় তিনশ বই কিনে ফেলেছেন মেলায় আগত এক পাঠক! এ তিনদিনে বাংলা একাডেমীর পুস্তক বিক্রয় কেন্দ্র, ঐতিহ্য, শুদ্ধস্বর ও শ্রাবণসহ বেশ কিছু স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে একটির পর একটি বই প্যাকেট করতে বলে উপস্থিত স্টলকর্মী, অন্যান্য ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের রীতিমতো হীনমন্যতায় ফেলে দিয়েছেন তিনি।

এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছেন মেলা প্রাঙ্গণে।

বিভিন্ন স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন প্রয়োজনীয় বইটি। অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনযোগে নিজ শহর হবিগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসা এই বিস্ময়কর পাঠকের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের।

হবিগঞ্জ জেলা থেকে আগত ‘পাঠক’ (ছদ্মনাম)-এর সঙ্গে কথা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “জনপ্রিয় ধারার কিছু উপন্যাস ছাড়া সাম্প্রতিক সাহিত্যের কোনো প্রকাশনা নিজের জেলা শহরে পৌঁছায় না। তাই বলে নিজের পাঠের ক্ষুধা আর সাহিত্যের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ রচনাটি তো আর না পড়ে থাকতে পারি না! তাই প্রতি বছরই ছুটে আসি বইমেলায়। ”

দুইদিনে প্রায় তিনশ বই কিনে ফেলা এই পাঠককে প্রাথমিক বিবেচনায় ধনাঢ্য বলে মনে হতে পারে। পরপর বই কিনে নেয়ার দৃশ্যে এও মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে তিনি অফিস কিংবা ঘরের বুক সেলফ ভরানোর তাগিদেই বইগুলো সংগ্রহ করছেন। কিন্তু বিস্তারিত আলাপে উঠে এলো অন্য গল্প।

জানা গেল, টিউশন করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। পয়সা খরচ করে বিলাসিতার কোনো সুযোগ নেই। বিপুল সংখ্যক বই কেনার ঘটনাটিকেও তিনি বিলাসিতা নয়, বরং অন্যান্য জৈবিক চাহিদার মতোই একটি অনিবার্য প্রয়োজনবোধ ও তার মীমাংসা-তাগিদের সঙ্গে তুলনা করতে চান।

বললেন, “বই আমার রোজকার নিঃশ্বাস গ্রহণের মতোই একটি অনিবার্য ঘটনা। প্রতিদিন দু’বেলা ভাত খাওয়ার মতোই ‘জৈবিক প্রয়োজন’। ফলে এর যোগান যে কোনোভাবেই হোক আমাকে নিশ্চিত করতে হয়। আমি সারা বছর টিউশনের প্রাপ্ত আয় থেকে বইমেলায় আসবার ও পর্যাপ্ত বই কিনে নিয়ে যাওয়ার টাকা জমাই। ”

জানা গেল অমর একুশে গ্রন্থমেলার বিভিন্ন স্টল থেকে প্রায় তিনশ বই কিনতে পাঠককে এখন পর্যন্ত গুনতে হয়েছে বাইশ হাজার টাকা। ২৭ বছর বয়সী এই তরুণ পাঠক বই কেনার জন্য যে পরিমাণ অর্থ বাজেট করেছেন, একই বয়েসের অন্য অনেকেই এ পরিমাণ টাকায় বই কেনা নয়, বরং বই ছাপার কথা ভাবেন!

আপনার যাচাই-বাছাই ও কেনায় কোন ধরনের বই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কবিতা, গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ ও লিটলম্যাগসহ প্রায়. সব ধরনের বিষয়েই আমি সমানভাবে আগ্রহী। তবে এবারের বইগুলোয় অনুবাদ ও কবিতারই উপস্থিতি বেশি। ”

মেলা থেকে কেনা কয়েকটি বইয়ের নাম জানতে চাইলে তিনি ‘ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার নির্বাচিত কবিতা : রক্ত ও অশ্রুর গাথা’ (অনুবাদ : সাজ্জাদ শরীফ), ‘গিয়োম আপোলিনেরের কবিতা : অশ্রু চোখে করাঘাত’ (অনুবাদ : মনজুরুল হক ও হায়দার আলী খান), ‘অরুন্ধতী রায়ের : দ্যা ব্রোকেন রিপাবলিক’ (অনুবাদ : লুনা রুশদী), ‘সিলভিয়া প্লাথের উপন্যাস : দ্য বেল জার’  (অনুবাদ : মোস্তাক শরীফ), ‘হেনরি মিলারের : ভাবনাগুচ্ছ’ (অনুবাদ : আলম খুরশেদ), ‘মানুষ জীবনানন্দ’ (ল্যাবণ্য দাশ), ‘মনসুর হাল্লাজের কবিতা’ (অনুবাদ : জাভেদ হুসেন), ‘হাওয়াকাঠের ঘোড়া’ (গ্যাব্রিয়েল সুমন), রাষ্ট্রবিরোধী গিটার (সাইয়েদ জামিল), ‘পালক ভরা সূ্র্যাস্ত’ (এমরান কবির), ‘কবিতার অন্ধনন্দন’ (কুমার চক্রবর্তী), ‘রবীন্দ্রনাথ ইয়েটস গীতাঞ্জলী’ (খোন্দকার আশরাফ হোসেন), ‘আহমদ ফারাযের উর্দু কবিতা : বধ্যভুমির উৎসব’ (অনুবাদ : জাবেদ হুসেন), ‘প্রতিবিহার’ (তানভীর মাহমুদ), ‘দিওয়ানা জিকির’ (জুয়েল মাজহার), ‘খুব গাল হলো, চলো’ (চঞ্চল আশরাফ), ‘ত্রিভুজাসম্ভাষ’ (মুজিব মেহদী), ‘সনেট সমগ্র’ (আল মাহমুদ), ‘গোধুলিগুচ্ছ’ (পিয়াস মজিদ), ‘জরাথ্রুস্টের সন্ধানে’ (মূল : পলক্রিসবাসজেক, অনুবাদ : মোস্তফা আরিফ), ‘আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প’ (অনুবাদ : ফজল হাসান), ‘লব্ধসর’ (শান্তনু চৌধুরী), ‘খড়ের কাঠামো’ (তালাশ তালুকদার) ‘লোক’ (প্রথম সংখ্যা থেকে ষষ্ঠ সংখ্যা), ‘ব্যাস’ (শাহজাদ ফিরদাউস), ‘টেরি ঈগলটন সাহিত্যতত্ত’ (অনুবাদ : খোন্দকার আশরাফ হোসেন), ‘আব্দুল মান্নান সৈয়দের শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ‘গোরখোদকের গান’ (মাহমুদ শাওন), ‘ফুলচাষি মালি যাই বলো’ (মাহবুব কবির), ‘তীর্থতল’ (নওশাদ জামিল) ও ‘কাপালিকের চোখের রঙ’ (নির্ঝর নৈঃশব্দ্য) বইগুলোর নাম উল্লেখ করেন।

পাঠকের আপত্তি ও আত্মসম্মানবোধের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রতিবেদনে তার নাম ও বিস্তারিত পরিচয় গোপন রাখতে হলো। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “নাম পরিচয় বা ছবি উল্লেখ করে দিলে আমার ওপর সহমর্মিতা ও করুণার যৌথ আক্রমণ বর্ষিত হতে পারে। বলা যায় না কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান হয়তো বই কেনার জন্য প্রতি বছর আমাকে তিরিশ হাজার টাকা স্পনসর করবার ঘোষণা দিয়ে বসতে পারে! আত্মমর্যাদাশীল পাঠক হিসেবে কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের লোগো সংবলিত জার্সি পরে মেলায় ঘোরাঘুরির ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে। ”

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।