ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

ছোটদের ভাবনা

অপেক্ষা

মেহনাজ আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১০
অপেক্ষা

আমার কাছের বন্ধুদের মধ্যে সানি অন্যতম। অনেকবার সে তার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া কথা বলেছিল।

কিন্তু ব্যস্ততার কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অবশেষে গত বছর ওর বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাই সানিকে না জানিয়ে ওকে চমকে দেবো এই ভেবে চলে গেলাম রায়পুরে।

সাড়া পথ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে কেটে গেলো। বাস থেকে নেমে ভ্যান দিয়ে গ্রামের পথ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখছিলাম সবুজ ধানক্ষেত। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। মন পাগল করা এই সবুজ দেখে আমার মন ভরে ওঠে। তবে সবচেয়ে কষ্টের কাজ ছিল সানিদের বাড়ি খুঁজে বের করা। অনেক কষ্ট হয়েছে ওর বাড়ি খুঁজতে।

সানি আমাকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরে। বন্ধুর দেখা পেয়ে সব কষ্ট দুর হয়ে যায়। দুপুর বেলা হওয়ায় খুব ুধা পেয়েছিল। সানি ওদের পুকুর থেকে মাছ ধরে, মুরগি জবাই করে রান্নার ব্যবস্থা করলো। সানির মায়ের হাতের রান্না অত্যন্ত চমৎকার। রান্নার স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। খাওয়া শেষ হলে আমি অনেকক্ষণ বিশ্রাম নেই। রাতে দুই বন্ধু মিলে জমিয়ে আড্ডা দিলাম। ঘুমানোর আগে পরদিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে সানিকে জানিয়ে দিলাম।

নতুন জায়গা ছিল বলে ঘুম আসতে দেরি হল। সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে ক্যামেরা নিয়ে দুই বন্ধু বেরিয়ে পরলাম গ্রামটা ঘুরে দেখার জন্য। আসলে গ্রামে না গেলে প্রকৃতির সৌন্দর্য্যটা কাছ থেকে দেখা যায় না। গ্রামের ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে দুই বন্ধু মিলে অনেক হাঁটলাম।

দু’জন মিলে পুকুর থেকে মাছও ধরেছিলাম। মাছ ধরার মাঝে যে অন্যরকম এক আনন্দ আছে সেটা সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম। বাড়ি ফেরার জন্য আমরা হাঁটলাম গ্রামের পথ দিয়ে। হঠাৎ এক বৃদ্ধ মহিলা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। সে আমাকে সবুজ নামে ডাকছিল। বৃদ্ধ মহিলা আমাকে বলছিল, ‘এতদিন কোথায় ছিলাম। ’ আমার উপর তিনি অভিমান করে আছেন। কেন তার খোঁজ নেইনি আমি। সানি অনেক কষ্টে আমাকে বৃদ্ধ মহিলাটির কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল। বাড়ি ফিরে এসে সূর্যাস্ত দেখলাম। ক্যামেরায় ছবি তুললাম। সে সময় বারবার আমার সেই বৃদ্ধ মহিলাটির আবেগ আপ্লুত কথাগুলো মনে পরছিল।

রাতে খাওয়ার শেষে সানিকে বৃদ্ধ মহিলাটির কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। সানি আমাকে বৃদ্ধ মহিলাটির সম্পর্কে জানায়। বৃদ্ধ মহিলাটির দুই ছেলে ছিল। এক ছেলের বয়স ছিল ১৩। আরেক ছেলের বয়স ২৬। মুক্তিযুদ্ধের সময় বড় ছেলেটা যুদ্ধে চলে যায়। আর তাই দেখে ছোট ছেলেও জেদ ধরে যুদ্ধ করার জন্য। বয়স কম থাকায় মুক্তিবাহিনীরা তাকে তথ্য আদান প্রদানের কাজে নিয়োগ করে।

গ্রামের কিছু খারাপ লোক পাকবাহিনীকে ছোট ছেলেটির কাজের খবর জানিয়ে দেয়। খবর পেয়ে পাকবাহিনী বৃদ্ধ মহিলাটির চোখের সামনে ছোট ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। এসব দেখে মহিলাটি পাগল হয়ে যায়। এরপর সে অপেক্ষা করতে থাকে কবে তার বড় ছেলে বাড়ি ফিরবে।

যুদ্ধ শেষে অনেকেই বাড়ি ফিরে আসে কিন্তু বৃদ্ধ মহিলাটির বড় ছেলে আর বাড়ি ফিরে আসে না। ছেলে ফিরে আসবে এ আশায় সে দিনরাত গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। আর তার ছেলের মত বয়সের মানুষকে দেখলেই নিজের ছেলে বলে জড়িয়ে ধরে।

বীর ছেলেদের মায়ের এই অবস্থা দেখে আমার খুবই কষ্ট লেগেছিল। ঘরবাড়ি নেই। পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। মানুষ তাকে দয়া করে খাবার দেয়। তাকে তো সবার সম্মান করা উচিত। এ ঘটনা জানার পর সানির বাড়িতে আর বেশিক্ষণ থাকতে মন চাচ্ছিল না। পরদিন ওই বৃদ্ধ মহিলাটির জন্য সানির হাতে কিছু টাকা তুলে দিলাম। চলে এলাম ঢাকায়।

পাঠকের কাছে এটি শুধুই একটি গল্প। কিন্তু আমরা যদি আমাদের চারপাশে তাকাই তাহলে এরকম অনেক মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদের পরিবার পাবো যারা আজ সমাজে অতি কষ্টে জীবন-যাপন করছে। আমরা চাইলেই তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারি। এতে যদি তাদের প্রতি আমাদের ঋণ কিছুটাও শোধ করা যায় তাতে খারাপ কি?

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।