ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

মোহিত কামাল-এর গল্প

পাখির ঠোঁটে বাংলা কথা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০১৩
পাখির ঠোঁটে বাংলা কথা

‘আমার নাম ইলেকটার্চ প্যারোট!’ লাল-নীল-সবুজ রঙের বাহারি পাখিটির ঠোঁট নড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলো বাংলা কথা । শুদ্ধ বাংলা শুনে চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল ফুয়াদ।

পাখিটি আবার বলল, ‘এমন বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছ কেন?’

প্রশ্ন শুনে উত্তর না দিয়ে ফুয়াদও প্রশ্ন করল, ‘তুমি সত্যিই বাংলা বলতে পারো?’

‘বলছি তো! শুনছ না আমার কথা! সত্য মেনে নিতে হয়। আমি সত্যিই কথা বলছি। মেনে নাও। ’
‘মেনে নিলাম। তবে তোমার নামটা কঠিন। সহজ নামে তোমাকে ডাকা যায় না?’ প্রশ্ন করল ফুয়াদ।
‘আমার আদি বাড়ি পাপুয়া নিউগিনি। আমার নাম তোমার দেশে অপরিচিত। তাই কঠিন মনে হচ্ছে। ’
‘তোমার নামের অর্থ কী?’

‘প্যারোট’ অর্থ তোতা পাখি, জানো তুমি। আর ‘ইলেকটার্চ’ অর্থ জানি না আমি। তবে মনে হয় বিশেষ ধরনের তোতা পাখি আমি- এজন্য প্যারোটের পূর্বে ‘ইলেকটার্চ’ শব্দটি বসেছে। ’

“হ্যাঁ। মানলাম। বিশেষ ধরনের তোতা পাখি তুমি। বিশেষ গুণ আছে তোমার। তো, তোমার নাম মনজয়ী তোতা’ হলে ভালো হতো। ”

“বাহ্! ভালোই! ‘মনজয়ী তোতা!’ শুনতে ভালোই লাগছে!”

‘তোমার ভালোলাগাটা গ্রহণ করলাম। তবে কষ্ট হলেও আমার কঠিন নামটা বরণ করে নেওয়ার অনুরোধ করছি। কারো নাম বদলে ফেললে কষ্ট পাবে সে। আমাকে নিশ্চয় কষ্ট দিয়ে আনন্দ পেতে চাইবে না তুমি, কী বলো?’
‘হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ, আমার আনন্দ কিংবা ভালো লাগার জন্য তোমার নাম বদলানোর আবদার করা ঠিক হয়নি। তোমাকে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। বুঝতে পারছি এখন। ’
‘বুঝতে পারার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে। ’

ফুয়াদ বলল, ‘ধন্যবাদ দিও না। ধন্যবাদ দিলে বন্ধুত্ব হয় না, বন্ধুত্ব টেকে না। ’
‘আচ্ছা, ধন্যবাদ দিব না। কিন্তু, তোমার সঙ্গে রোজ কথা বলব। ’

মনজয়ী তোতা সত্যিই জয় করে ফেলল ফুয়াদের মনোজগৎ। খুশি মনে ফুয়াদ বলল, ‘তোমার কথা মেনে নিলাম। কিন্তু রোজ কথা বলতে পারব কিনা জানি না। ’

‘জানো না কেন?’ অভিমানী প্রশ্ন বেরিয়ে এলো তোতার ঠোঁট থেকে।

‘জানি না। কারণ আমার মায়ের কথামতো চলতে হয় আমাকে। সব সময় সব কাজে মা-মণি অনুমতি দেন না। তোমার সঙ্গে কথা বললে ভাববেন সময় নষ্ট করছি, পড়া ছাড়া অন্য কাজে মন দিলে অখুশি হন তিনি। পড়াশোনায় ছাড় কিছুতেই মানতে চান না মা-মণি। ’
‘নাহ্ ! এটা তোমার মা-মণির বড় ভুল। ’
‘মা-মণি কি ভুল করতে পারেন?’

‘পারেন। মায়েরা কেবল একমুখো চিন্তা করেন- পাড়াশোনা। সন্তানের পড়াশোনা ছাড়া  অন্যকাজেও মন দিক সে, মেনে নিতে পারেন না তারা। মনে আনন্দ পাওয়াও যে বড় কিছু পাওয়া, খেয়াল করেন না। এটাই তাদের বড় ভুল। ’

‘ঠিক আছে। মা-মণিকে বলব তোমার কথা। মনে আনন্দ পাওয়ার দিকেও যেন তারা খেয়াল রাখেন বুঝিয়ে বলব। ’
চিঁচিঁচিঁ!  মজার একটা  শব্দ বেরিয়ে এলো মনজয়ী তোতার মুখ থেকে।
ফুয়াদ প্রশ্ন করল, কী বললে, বুঝলাম না তো!

‘ওঃ! এটা পাখীদের ডাক। মনে আনন্দ এলে মনের ভেতর থেকে আপনাআপনি ‘চিঁচিঁ’ শব্দ বেরোয়। এখনো বেরিয়ে এসেছে শব্দ-ধ্বনি। আমার মনে আনন্দ ঢুকিয়ে দিতে পেরেছ তুমি। ’

তোতার কথা শুনে ফুয়াদের মনও ভরে উঠল আনন্দে। চিৎকার করে বলল, ‘তোমার আনন্দে আমার মনেও ঢুকে গেছে আনন্দ! বাহ্! মজা তো!  আনন্দ দেওয়া-নেওয়ার খেলায় শরীরের মধ্যে জোর বেড়ে গেছে, টের পেল ফুয়াদ। মনে খুশী এলে দেহেও বল বাড়ে টের পেয়ে বলল, প্রিয় ইলেকটার্চ প্যারোট তুমি কি জোর টের পাচ্ছ পাখায়?’

অবাক হয়ে প্যারোট বলল, ‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। তুমি কীভাবে টের পেলে বলো তো!’
‘নিজের দেহে আলাদা জোর পাচ্ছি, তাই বলতে পারলাম!’

‘ওঃ! আমিও পাচ্ছি!’ বলেই উড়াল দেওয়ার চেষ্টা করল মনজয়ী তোতা! কিছুটা উপরে উঠে জিগবাজি খেয়ে আবার নেমে বসল চিকন রডের ঝুলানো দোলনায়। পায়ের নখের চাপে দুলিয়ে দিল ঝুলন্ত দোলনা। পাখির দোল খাওয়া দেখে দুলতে লাগল ফুয়াদের মনও। দোল খাওয়া মনে হঠাৎ জেগে ওঠল আকাশে ওড়ার ইচ্ছা। মন খুলে বলে বসল, ‘ তোমার মতো আকাশে উড়তে ইচ্ছা করছে আমারও। কীভাবে উড়তে পারি আমি, বুদ্ধি দেবে?’

মনজয়ী তোতা বলল, ‘ভালো ইচ্ছা। সুন্দর ইচ্ছার জন্য তোমাকে জানাই আদর। আর এই আদরের কারণেই বলছি, মন যা চাইবে, তা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হলে চলবে না। ইচ্ছাটা নিজের জন্য মানানসই কিনা, নিজের যোগ্যতার সঙ্গে খাপ খায় কিনা, ভেবে দেখতে হবে। মানানসই হলেই সেই ইচ্ছাপূরণে চেষ্টা করতে হবে, নইলে ইচ্ছাটাকে অন্য উপায়ে পূরণ করার চেষ্টা করতে হবে। ’

‘অন্য উপায়টা কি? আকাশে ওড়ার অন্য উপায়ও থাকতে পারে?’

‘পারে। তুমি তো আমার মতো পাখি নও। তোমার পাখনা নেই। উড়তে পাখনা লাগে। তাই ওড়ার চেষ্টা না করে উড়ন্তযানে চড়ে আকাশের মেঘের কোলেও ঘুরে আসতে পারো তুমি। ’
‘ওঃ! বুঝেছি। বিমানে চড়ার কথা বলছ তুমি?’

‘ঠিকই ধরেছ। বিমানে চড়ে তোমার মতো মানুষেরা পুরো আকাশ জয় করতে পারে, চাঁদের দেশে যেতে পারে, কত কত দূরে যেতে পারে, পাখিরা এত দূর যেতে পারে না। ’
‘আমি শুনেছি শীতের সময় পাখিরা এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশ উড়ে যেতে পারে!’

‘পারে। তারা আকাশের সীমা ছাড়াতে পারে না। চাঁদের দেশে যেতে পারে না, মঙ্গলগ্রহে যেতে পারে না। তোমরা, মানুষেরা পারো, তোমাদের ক্ষমতা অসীম। ’

মনজয়ী তোতার বর্ণনা শুনে কল্পনায় চাঁদের দেশে চলে গিয়ে চোখ বন্ধ করল ফুয়াদ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আশ্চর্য! আমি তো চোখ বন্ধ করে এই মাত্র চাঁদের দেশ থেকে ঘুরে এলাম! কোনো বাহন লাগল না, পাখনা লাগল না!’
‘চিঁচিঁচিঁ চিঁচিঁচিঁ!’

মনজয়ী তোতার আনন্দধ্বনি শুনে ফুয়াদ জানতে চাইল, ‘এমন চিঁচিঁ করছ কেন?’
‘করছি। কারণ ইচ্ছাপূরণের উপায় পেয়ে গেছ তুমি। কল্পনায় পাখার চড়ে মুহূর্তে ঘুরে এসেছ চাঁদের দেশ থেকে। তুমি কি বুঝতে পারছ, কত শক্তি লুকিয়ে আছে তোমার মনের পুটলিতে?’
‘এখানে শক্তির কী দেখলে?’

‘কেবল শক্তি না, মহাশক্তি! তোমার এই ক্ষমতা আকাশের চেয়ে বড়, অনেক অনেক বড়! মনে মনেও উড়তে পারো আকাশে, তোমাদের মতো এমন মহাশক্তি পাখীদের নেই!’

মনজয়ী তোতার কথা শুনে নিজেকে শক্তিমান মনে হচ্ছে না। উল্টো ফল ফলল। দুর্বল লাগছে এখন নিজেকে। নিজের দুর্বলতার চিহ্ন ফুটে ওঠল মুখে।
‘আমার কথা শুনে ভয় পেয়েছ, বন্ধু?’

‘না। না। ভয় পাইনি। তবে কীভাবে যেন মুহূর্তে উড়ে গেছে নিজের দেহের জোর। ’ বলল ফুয়াদ।
‘এটাই দুর্বলতা। ভয় পেলে মনের জোর কমে যায়। দেহের জোরও কমে। তখন নিজের আসল ক্ষমতা টের পাওয়া যায় না, নিজেকে অযোগ্য মনে হয়। তোমার ক্ষমতা আছে, জয় করার যোগ্যতা আছে। সেটা মনের চোখ দিয়ে দেখে নিতে হয়। দেখতে পেলে জোর বাড়বে। নিজের প্রতি বিশ্বাস বাড়বে, নিজের ক্ষমতা টের পেয়ে যাবে। মনে তখন নতুন নতুন স্বপ্ন জাগবে, আশা জাগবে। ’

‘বাহ্ । তুমি তো অনেক কথা জানো, এত কথা শিখলে কীভাবে?’

‘কীভাবে শিখলাম? জানি না তো! প্রকৃতিই বোধ হয় শিখিয়ে দেয় সব। প্রকৃতির দিকে চোখ মেলে তাকাতে হয়। ওই যে দেখো বাইরে, বাগানে কত ফুল ফুটেছেÑ জারুল, সোনালু, রাধাচূড়া, কনকচূড়া, কাঠগোলাপ, কুরচি, মধুমঞ্জুরিলতা, হিমচাঁপা। একেক ফুলের একেক রঙ! একেক বৈশিষ্ট্য, প্রত্যেকটা আলাদা রঙের খেলাÑ এই খেলাটার দিকে তাকাতে হয়, মন দিয়ে দেখতে হয়, দেখবে সৌন্দর্য কাকে বলে, ওই সৌন্দর্য তোমার মনও রাঙিয়ে দেবে। সুন্দর করে তুলবে। ’

মনজয়ী তোতার কথা শুনে খুশি হয়ে গেল ফুয়াদ। সোনালু ফুলের রঙে রঙিন হয়ে ওঠল। রাধাচূড়ার রঙ মেখে নিল মনে। রঙিন মনে আনন্দের ঢেউ এলো। ঢেউ সামলে বলল, ‘তুমি কি অংক কষতে জানো!’
ওরে বাবা! তোমাদের মতো এতো ক্ষমতাবান নয় আমাদের বুদ্ধি। অংক বুঝি না। সহজ-সরলতা বুঝি কেবল।
‘এত সুন্দর করে বাংলা বলতে পারছ তুমি, অথচ বুদ্ধির ক্ষমতা নিয়ে  ভুল ধারণা করছ?’
‘ভুল নয়, সত্য। সহজ অংক পারি আমি, অংকের কঠিন গিঁট খুলতে পারি না। ’

‘‘কঠিন গিঁটটা’ কী?” প্রশ্ন করে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে পারল না ফুয়াদ। জোরে একটা চিৎকার দিয়ে বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে ছিটকে সরে গেল দূরে। বারান্দার পিলার বেয়ে লেজ নেড়েচেড়ে হেলেদুলে এগিয়ে আসছিল একটা টিকটিকি। চোখ পাকিয়ে চেয়েছিল ফুয়াদের দিকে। মনে হচ্ছিল চোখের ভেতর থেকে ঘনকালো শীতল বিষের পিচকি ছুঁড়ে দেবে আর চোখে। অবশ করে আক্রমণ করবে তাকে! চিৎকার শুনে লেজ বাকিয়ে মাথা ঘুরিয়ে থমকে গেল টিকটিকিটি। ফুয়াদের কাণ্ড দেখে অস্থির হয়ে ইলেকটার্চ প্যারোট বলল, ‘কী হলো, এমন চিৎকার দিলে কেন?’

প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না ফুয়াদ। ভয় পাওয়া বড় বড় চোখের ইশারায় দেখিয়ে দিল টিকটিকিটি। ওটা তো একটা নিরীহ জীব। মানুষের ক্ষতি করে না। উপকার করে। ঘরের পোকামাকড় খেয়ে মানুষকে নিরাপদ রাখে। ’  বলল মনজয়ী তোতা।

তোতার কথায় সাহস বাড়ল না। ভয় কমল না। ভয়ে কুঁকড়ে গেল ফুয়াদের দেহ।

মনজয়ী তোতা খেয়াল করে দেখল ফুয়াদকে। তারপর সাঁই করে উড়াল দিয়ে টিকটিকির মাথা কামড়ে ধরল। কুটকুট করে খেতে লাগল নরমদেহ।

তোতার আচমকা আক্রমণ দেখেও সাহস বাড়ল না। বরং মনপুকুরে ঢিল পড়ল। টিকটিকিটির জন্য নিজের মনে টের পেতে লাগল  মায়ার টান।

মুহূর্তেই খেয়ে তৃপ্তি নিয়ে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গেল তোতা। অপরাধী গলায় প্রশ্ন করল, ‘এভাবে

তাকিয়ে রইলে কেন? তুমিই তো বললে, ওটা তোমাকে ভয় দেখিয়েছে। ’
‘হ্যাঁ। ভয় দেখিয়েছে। তাই বলে খেয়ে ফেলবে তুমি?’
‘বাহ্! আমার খাবার হচ্ছে টিকটিকি। আমার খাবার আমি খাব না?’
‘তাই বলে জ্যান্ত টিকটিকিটি খেয়ে ফেলবে?’
‘হ্যাঁ। জ্যান্ত টিকটিকিই খেতে পছন্দ আমার। ’
‘না। ঠিক করোনি। অন্যায় করেছ তুমি। ’

‘তুমি ভুল বুঝছ। আমার চাওয়া-পাওয়ার বিষয়ে ধারণা নেই তোমার। কোনো বিষয়ে জানা না থাকলে, জেনে মতামত দিতে হয়। না জেনে মত প্রকাশ করলে ভুল হয়। ভুল হলে দুজনের সম্পর্ক ভালো হয় না। ’
‘সম্পর্ক ভালো হয় না’Ñ কথাটা শুনে নরম হয়ে গেল ফুয়াদের মন। কোনোমতেই সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না সে। ইলেকটার্চ প্যারোটের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়তে চায়। যে টিকটিকি দেখে ভয় পেল, ভয় পাওয়ার পর তার জন্য কেন মায়া লাগল, বুঝতে না পারলেও মেনে নিল তোতার কথা। পুরোপুরি বোধ হয় মানতে পারেনি। মুখ দেখে বুঝে

তোতা প্রশ্ন করল, ‘তুমি চিকেন খাও না?’
‘খাই। ’
‘গরুর গোস্ খাও না?’
‘খাই। ’

‘জীবিত গরু ও মোরগ তো জবাই করে গোস্ খাও তোমরা। এটা নিয়ম। যার জন্য যেটা খাওয়া ঠিক করা আছে, সেটা খাওয়া কি অপরাধ?’

প্রশ্ন শুনে কমে গেল ফুয়াদের মনের চাপ। আবার ঝলমল করে ওঠল মুখ। হাসি ছড়িয়ে গেল চোখে- মুখে। হঠাৎ খুশিতে চিৎকার করে উঠলÑ ‘ওই যে দেখো সবুজ ঘাস ফড়িং উড়ে এসে বসেছে পাতাবাহার গাছের রঙিন পাতায়!’

কোনো কোনো পাতা সবুজ। আবার কোনোটা লাল। কালো ডোরাকাটা লাল পাতার ওপর বসেছে সবুজ ঘাস ফড়িং। পিটপিট করে দেখল তোতা।
‘খাবে না? এটা কি তোমার প্রিয় খাবার নয়?’ প্রশ্ন করল ফুয়াদ।

‘হ্যাঁ। প্রিয় খাবার। কিন্তু এখন আর খেতে পারব না। খাবারের চাহিদা পূরণ হয়ে গেছে। চাহিদা পূরণ হলে অতিরিক্ত খেতে নেই। তোমার বেলায়ও একই কথা মনে রাখতে হবে। ’
‘প্রিয় খাবার দেখেও লোভ সামলাতে পারলে! আমি তো পারি না। ’

‘পারতে হবে। প্রয়োজন মিটিয়ে খেতে হবে। প্রয়োজনের বাইরে খেলে মোটাসোটা নাদুশনুদুস হয়ে যাবে। মোটা বাচ্চা কি দেখতে ভালো লাগে? খাবারের বাড়তি লোভ সামাল দিতে হবে। লোভ সামাল দিতে না পারলে অনেক ক্ষতি হয়। ’

‘মনজয়ী তোতার কথা শুনে আবারও খুশি হয়ে গেল মন। খুশিতে টই টই হয়ে ঘাসফড়িংটি ধরতে এগিয়ে গেলে পা টিপে চুপিসারে। চাপ দিয়ে দু’আঙুলের ফাঁকে যেই না ধরতে গেল, ওমনি উড়াল দিল ঘাসফড়িং। পেছনে ছুটতে গিয়ে ইটের সঙ্গে পায়ের ধাক্কায় আছড়ে পড়ল ফুয়াদ।
চিঁচিঁচিঁ ! ডাক দিলো তোতা পাখি।

তেমন ব্যথা লাগেনি। উঠে দাঁড়িয়ে ফুয়াদ প্রশ্ন করল, ‘চিঁচিঁচিঁ করে কী ভাষায় কথা বললে?’
‘বিপদের সময় সবাই নিজের আসল ভাষায় কথা বলে। আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা করে। ভয় পেয়ে আমিও আমার নিজস্ব ভাষায় তোমার জন্য দোয়া করেছি। ’

‘ওঃ! বিপদে আমরাও আল্লাহ’র কথা স্মরণ করি। অন্য সময় তেমন স্মরণ করি না। ’ বলল ফুয়াদ।
‘ঠিক বলেছ তুমি? বিপদে না পড়লে সৃষ্টিকর্তার কথা মনে থাকে না। বিপদে আমাদের কাছাকাছিই থাকেন মহান আল্লাহ। বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য নিজেদের অজান্তে মনের অতল থেকে তাঁর দয়ার ওপরই ভর করি আমরা। ’

কথা-বার্তার সময় পায়ের ব্যথা টের পায়নি ফুয়াদ। কথা থেমে যাওয়ার পর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকিয়ে বুঝল শক্ত চোট লেগেছে, নখ কালো হয়ে যাচ্ছে। ব্যথা হচ্ছে। ব্যথাটা বাড়ছে।

ফুয়াদের পায়ের দিকে তাকিয়ে মনজয়ী তোতা বলল, ‘তোমার কষ্টটা তোমার মতো অনুভব করছি আমি। চামড়া ছিঁড়ে গেছে কিনা দেখো তো। ’

‘না। ছিঁড়েনি। ফুলে যাচ্ছে। কালো হয়ে যাচ্ছে। ’

‘দ্রুত এক কাজ করোÑ ঠান্ডা পানিতে পায়ের আঙুল ভিজিয়ে রাখো, ফোলা কমে যাবে। ব্যথাও কম টের পাবে। ’
‘দুখ্ লাগবে না? মা-মণিকে বলতে হবে না?’

‘মা-মণিকে বলবে, ঠিক আছে। আগে আমার পরামর্শ শোনো। পরে না হয়, ওষুধ লাগলে খাবে। সব ব্যথার জন্য ওষুধ খাওয়ার দরকার নেই। ছোটবাবুদের জখম-টকম দ্রুত সেরে যায়। হাড় না ভাঙলেই হলো। ’
ফুয়াদ বোঝাল তোতা পাখিটিকে- ‘না, আঙুলের হাড় ভাঙেনি। ভাঙলে আরও বেশি ব্যথা হতো। হাঁটতে পারতাম না। তোমার সঙ্গে পরে কথা বলব। এখন তোমার পরামর্শ পালন করে আসি। ’

কথা শেষ করে ভেতরের রুমে ঢুকল ফুয়াদ। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে একটা ঘামলায় ঢেলে পায়ের ডান বুড়ো আঙুল ভিজানোর সঙ্গে সঙ্গে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। চট করে আঙুল জ্বলা শুরু করেছিল বরফ শীতল পানির স্পর্শে। সমস্যা টের পেয়েও কাজ থেকে পেছাল না। বরং বুদ্ধি করে ফুয়াদ স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি মিলাল শীতল জলের সঙ্গে। তারপর আবার আঙুল ডোবাল। ওয়াও! খুশি হলো মন। এবার ভালো লাগল। আরামবোধ করল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল খেলার মাঠের কথা। মাঠে খেলতে গিয়ে আঘাত পেলে বড়দের বরফ দিতে দেখেছে আঘাতের স্থানে। বরফ দেওয়ার কারণ বুঝতে পারল দশ মিনিট পর। পানি থেকে পা তুলে দেখল ফোলা কমে গেছে, ব্যথাও উধাও হয়ে  গেছে। খুশি মনে বাইরে এসে তোতা পাখিটিকে খুঁজে না পেয়ে উধাও হয়ে গেল খুশি খুশি ভাব। মন খারাপ করে একা একাই বলতে লাগল, ‘কোথায় তুমি, ইলেকটার্চ প্যারোট?’
উওর পেল না। তোতার উত্তর না পেয়ে চট করে চোখ গিয়ে পড়ল বারান্দায় রাখা জবাফুল গাছের টবের ওপর। মা-মণি ইনডোর প্ল্যান্টের চাষ করেন। বারান্দায় এমন স্থানে রেখেছেন টবটি যেন দিনের বেশির ভাগ সময় রোদ পায়। দিনে একবার তিনি পানি দেন টবে, তিন মাস পর পর টবের উপরের মাটি খুঁচিয়ে সারমাটি দেন। সারা বছর গাছটির যতœ নেন মা-মণি, সারা বছরই ফুল ফোটে। মায়ের সঙ্গে সেও যতœ করে টবটির। বেশ কয়েকদিন পর
এখন দেখছে গোলাপি রঙের ছাতার মতো পাঁচ পাপড়ি খুলে তাকিয়ে আছে ফুলটি। তোতার খোঁজ না পেয়ে মন খারাপ হলেও ফুল দেখে আবার ভালো হতে লাগল মন। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল মালয়েশিয়ার কথা, হাওয়াই দ্বীপের কথাÑ গত বছর দু’বার মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল সে। সুন্দর দেশটি ঘুরে  এসেছে। মালয়েশিয়ার জাতীয় ফুলের নাম জবা। আর হাওয়াই দ্বীপের মেয়েরা খোপায় পড়ে জবাফুল। তাকে সমুদ্র-সৈকতে হাঁটতে দেখে একটি মেয়ে শিশু এগিয়ে এসেছিল তার দিকে। মেয়েটির আসার ভঙ্গি দেখে ভয় পেলেও তার হাতে ফুল দেখে কেটে গিয়েছিল  ভয়ের অনুভব। মেয়েটি ভাঙা ভাঙা ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করে বলেছিল, ‘ওয়েল-কাম টু ইউ ইন হাওয়াই দ্বীপ!’

অতিথিদের প্রতি দ্বীপের লোকজনের অভ্যর্থনার ধরন দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল ফুয়াদ। জবা ফুল গাছের কাছে এসে এখন সে আবারও টের পেল সেই ভালো লাগা। পাপড়ি দল ছুঁয়ে দিল ফুয়াদ। মালয়েশিয়ার জবাফুলের অধিকাংশ পাপড়ি টকটকে লাল হলেও তাদের টবে এসেছে গোলাপী পাপড়ি। একবার দেশে পূজোমণ্ডপে বেড়াতে গিয়ে দেখেছিল টকটকে জবাফুলের ব্যবহার। হিন্দুরা জবাফুল দিয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন। এই মুহূর্তে পাপড়িদল ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিরতির করে ছড়িয়ে পড়ল ফুলের রেণু। আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য স্থান থেকে সাঁই করে উড়ে এসে ইলেকটার্চ প্যারোট ঠোঁট দিয়ে টুকটুক করে তুলে নিল পুষ্পরেণু।

 তোতার আচরণ দেখে অবাক হয়ে গেল ফুয়াদ। কিছুক্ষণ নীরবে দেখল পাখির রেণু খাওয়ার দৃশ্য, তারপর প্রশ্ন করল, ‘ফুলের রেণু কি তোমার প্রিয় খাবার?’

‘হুঁম। ছোট্ট করে জবাব দিয়ে পিটপিট করে তোতা পাখিটি তাকাল ফুয়াদের দিকে। ’
‘কোথায় গিয়েছিল?’
‘পালিয়েছিলাম। ওই যে এই দেয়ালের আড়ালে। ’
‘কেন পালালে? শত্রু এসেছিল?’

‘ঠিক শত্রু বলা চলে না তাকে। তবে মজা করতে গিয়ে বা কৌতূহলের কারণে আমার দিকে ঢিল ছুড়েছিল সে। ’
‘সে কে?’

‘তোমার পাশের বাড়ির ঝুনঝুনি। ’

‘ঝুনঝুনি তোমাকে আক্রমণ করেছিল? এত বড় সাহস তার!’
‘না। সে সাহসী না। কৌতূহলী। সব কিছুতেই জানার আগ্রহ রয়েছে তার। ঢিল মেরে পরখ করে দেখতে চেয়েছিল, কী করি আমি। ’

‘এরকম বিপদজনক পরখ করা কি ঠিক?’

‘না। ঠিক নয়। কিন্তু ঠিক-বেঠিক বোঝার  বয়স হয়নি ঝুনঝুনির। এজন্য ওর ওপর রাগ করা উচিত নয়। ’
‘কেউ তোমাকে মেরে পেট গুলিয়ে দেবে, তারপরও তাকে দোষ দেবে না?’

‘না। দেব না। যে দোষ-গুণ বোঝে না, তাকে আগে বোঝাতে হবে নীরিহ কাউকে আক্রমণ করা ঠিক নয়।   তার নিরাপরাধ কাজ যে আমার মৃত্যুর কারণ হতে পারে, জানা নেই তার। রাগ করো না। তাকে একদিন বাসায় ডেকে বুঝিয়ে বোলো। ’

‘বুঝিয়ে বলব না। তার দিকে একটা ইট মেরে শিখিয়ে দেব, ইট মারার মজা টের পেয়ে যাবে তখন। ’
‘না। না। খবরদার। এমন কাজ কখনো কোরো না। কারও প্রতি রাগ দেখালে, কারও দোষ ধরতে লাগলে, জয় করা যায় না তাকে। বন্ধুও বানানো যায় না। ভালো ব্যবহার করে শিক্ষা দিতে হবে খারাপ আচরণের। দোষ ধরলে নিজের ঘাটতি টের পাবে না কেউ। নিজেকে দোষী ভাবতে চাই না আমরা। সবাই ভাবি অন্য দোষী। নিজের কোনো ভুল নেই। সমালোচনা করে ভুল ধরিয়ে দেওয়া যায় না। ভুলটা তুলে ধরতে হবে কৌশলে। ’
‘কৌশলটা কি?’

‘আগে ঝুনঝুনির সঙ্গে বন্ধুত্ব কোরো। বন্ধু হলে তাকে বুঝিয়ে বললে, বুঝবে। বন্ধু না হয়ে শুরুতেই সমালোচনা করলে তোমার শত্রু হয়ে যাবে সে। ’

তোতার কথা শুনে ঝুনঝুনির ওপর থেকে রাগ কমে গেল। কাউকে শত্রু বানাতে চায় না, ঝুনঝুনিকে তো না-ই। বন্ধু বানানো কিংবা শত্রুকে জয়ের কৌশল শিখে তৃপ্ত হয়ে ফুয়াদ বলল, ‘দেখো, আঙুলের ফোলা কমে গেছে। কালো রঙ পালিয়ে গেছে। ব্যথাও টের পাচ্ছি না এখন। ’

শুনে খুশি হলো ইলেকটার্চ প্যারোট। তারপর ফুয়াদকে অভিবাদন জানিয়ে উড়াল দিয়ে ঢুকে গেল বারান্দায় রাখা তার জন্য নির্ধারিত খাচার ভেতর।

২.  ইঞ্জিনের শব্দ নেই। জানালা দিয়ে জাহাজের বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল ফুয়াদ। নীল সাগরের পানি নীল- ছোট ছোট ঢেউয়ের বুক কেটে এগিয়ে চলছে জাহাজ। দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়, গাছগাছালি। নীল পানির তলদেশ থেকে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মালয়েশিয়ার সুন্দর দ্বীপ, লংকাউই। আন্দামান সাগরের বুকে অসংখ্য দ্বীপের মধ্যে লংকাউই হচ্ছে সৌন্দর্যের পরী, সাগরকন্যা।

‘দ্বীপ আবার কন্যা হয় কীভাবে? পরী হয় কীভাবে? ‘ফুয়াদ প্রশ্ন করল বাপিকে।
প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গেলেন বাপি। উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘ভালো প্রশ্ন। প্রশ্নের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। ’
‘প্রশ্নের জবাব দাও বাপি। ধন্যবাদ দিচ্ছ কেন? ধন্যবাদ দিয়ে কী হবে?’

‘ভালো কাজে ধন্যবাদ প্রশ্নকারীর মনে আগ্রহ তৈরি করে। উৎসাহ জোগায়। ভালো কাজটি করতে নিজের মনে আগ্রহবোধ করে। ’

‘উত্তর পেতে চাই। তোমার সুন্দর সুন্দর কথা শুনতে চাই না। ’

ফুয়াদের সরাসরি কথার পিঠে কথা বাড়াতে না পেরে বাপি বললেন, ‘এটা রূপক কথা। ‘কন্যা’ বা ‘পরী’ সৌন্দর্যের উদাহরণ হিসেবে লংকাউই দ্বীপের গুণ তুলে ধরছে। ’

জাহাজ যতই কাছে ভিড়ছে, ততই ফুয়াদের মনে হলো, কোনো পরী নয়, সামনে এগিয়ে আসছে গাছগাছালি ভরা বিরাট এক পাহাড়। কোথাও কোথাও গাছপালা নেই, উদোম গায়ে পাথরবুক খুলে বিকট চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দৈত্যের মতা আকাশছোঁয়া পাহাড়। মনে হলো দুম করে পাহাড়ের চূড়া ভেঙে পড়তে পারে জাহাজের ওপর। আনন্দ ও ভয়  একসঙ্গে ঢুকে গেল ফুয়াদের মনে। মনের এক পাশে দোলা দিচ্ছে সুন্দর দৃশ্য, অন্যপাশে দাপিয়ে উঠছে ভয়।

দ্বীপে নেমে বাপির হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ফুয়াদ। নীলপানির কোমল ঢেউ, বিকট পাহাড়ের বুকে জেগে ওঠা মানুষের আকৃতির, নাক-মুখ, চোখ প্রকৃতিরই সৃষ্টি। বুঝতে না পেরে বাপিকে প্রশ্ন করল, ‘ওই বড় নাক, চোখ কি পাহাড় কেটে তৈরি করেছে কোনো মানুষ, শিল্পী?’

‘না বাবা। মানুষের তৈরি নয়। এই সুন্দর প্রকৃতির সবকিছুই এমনি এমনি জেগে উঠেছে সমুদ্রের তলদেশ থেকে। এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার বছর ধরে। ’
‘এ গুলো ভেসে যায় না। ঝড়তুফানে ডুবে যায় না?’

‘না। সুনামির ঢেউও কাবু করতে পারে না দ্বীপকে। দ্বীপের কোনো ক্ষতি হয় না। উপরে শক্ত পাথর-দানবের মতো পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকলেও পাহাড়েরর তলে খোল রয়েছে। এগুলোকে বলে গুহা। বিশাল সব গুহার ভেতর ঢুকব আমরা, অপেক্ষা করো। ’
‘গুহায় কি আলোবাতাস থাকে, বাপি?’

‘দিনের বেলায় ঘুটঘুটে অন্ধকার না থাকলেও, অন্ধকারই গুহার আসলরূপ। রাতের ঝিকঝিক আঁধারের ভয় এবং রূপেও মুগ্ধ হয় মানুষ, শুনেছি। ’
‘আমরা কি ওই গুহায় ঢুকব?’
‘অবশ্যই। ’
‘দিনে না রাতে?’

‘না। রাতে না। দিনে। ইঞ্জিনবোটে দ্বীপের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা খালের মধ্য দিয়ে ঘুরে বেড়াব আমরা, দেখব ম্যাঙগ্রোভ। আর ঢুকব খালের পাশে পাহাড়ের গুহায়। ’  
‘ম্যাঙগ্রোভ কি আব্বু?’

‘ম্যানগ্রোভ হচ্ছে জলের তলে মাটি থেকে বেড়ে ওঠা গাছগাছালির সারি, গরান গাছ।   খাল-নদীর ধার ঘেঁষে এই প্রজাতি গাছের জন্ম। কেবল শিকড়গুলো অক্টোপাসের মতো আঙুলের থাবা গেড়ে বসে থাকে ভেজা-মাটিতে। জোয়ার এলে ডুবে যায়। ভাটির টানে জেগে ওঠে। ’

‘ওগুলো তো আমাদের দেশেও আছে। কুয়াকাটা, সুন্দরবনে দেখেছি। ’

‘হ্যাঁ দেশেও আছে। তবে দেশে দেখার জন্য যাতায়াত আর থাকার ব্যবস্থা ভালো নয়। মালয়েশিয়ায় ব্যাবস্থা ভালো। তাই সবাই ছুটে চলে সেখানে। ’

বাপির কথা শুনে কৌতূহল বাড়ে। ম্যাঙগ্রোভ আর গুহায় ঢোকার আগ্রহ জাগে। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে সুন্দর দ্বীপটির দিকে ।

ইঞ্জিনচালিত বোটে উঠে বন্ধুত্ব হয়ে গেল কমবয়সী বোট চালকের সঙ্গে। চালক একবার গতি বাড়াল। আবার কমাল একবার। বোট পাক খেয়ে এক চক্কর ঘুরে গেল। ইঞ্জিনের গুরগুর আওয়াজে সঙ্গে ঘূর্ণি ঢেউ উঠল পানিতে। সেই সঙ্গে পূর্বে কেটে রাখা মুরগীর চামড়ার টুকরো ছেড়ে দিলো ঘূর্ণিজলে। চামড়ার টুকরো ছড়িয়ে গেল চারদিকে। স্পিডবোটটি দূরে সরে গেল। অ™ভুতকাণ্ড। শত শত ঈগল পাখি উড়ে এলো পাশের ঘন ঝোপঝাড় থেকে। ঝুপ করে ঝাপ দিচ্ছে পানিতে। মুরগীর চামড়ার টুকরো পায়ের আঙুলের থাবায় নিয়ে উড়াল দিচ্ছে আকাশে। ঈগলখেলা দেখে  প্রাণ জুড়িয়ে গেল ফুয়াদের।

ইঞ্জিন বোটটি গুহার কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক বানর ছুটে এলো জলের ধারে। চিপসের প্যাকেট খুলে ছুড়ে দিল সে বানরগুলোর দিকে। ছোট, হালকা বানরগুলো পানিতে ঝাপ দিয়ে টুকটুক করে মুখে পুরে নিচ্ছে খাবারে টুকরো। মোটাসোটা বানরগুলো নামাতে পারছে না পানিতে। যত জোরেই তাদের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে চিফ, ততই বাতাসের গতির কারণে শুকনো জায়গায় ফেলতে পারছে না।

ফুয়াদ বলল, ‘মোটা বানরগুলো কি আমার দেওয়া খাবার খাওয়ার সুযোগ পাবেন না, বোটভাই!’

“আমার নাম ‘বোটভাই’ না, জানেমান। ”
‘বাহ্ ! তোমার নাম তো খুব সুন্দর!’
‘শুনে খুশি হলাম বাংলাদেশী বন্ধু। ’
‘তুমি খুশি হলে চলবে, মোটা বানরটাকে তো খুশি করতে পারলাম না। ’

‘ওরা হচ্ছে পুরুষ বানর। পুরুষ বানর সাতার কাটতে পারে না। সাঁতরে এসে টুরিস্টদের কাছ থেকে ওরা খাবার খেতে পারে না, পুরুষগুলোর জন্য বনেজঙ্গলে অনেক খাবার রয়েছে। ওরা সেই খাবার খেতে দেয় না মেয়ে বাদরদের। ’
‘তাহলে তো মেয়ে বাঁদরদের খাবার দিয়ে ভালোই করেছি আমি, কী বলো। জানেমান?’
‘হ্যাঁ, ভালো করেছে। ’

‘সামনে গিয়ে বোট থেকে নামব আমরা। তখন আরো বিস্ময় দেখতে পাবে। অন্ধকার গুহার ভেতর ঢুকব সবাই। ’
কৌতূহল বাড়লেও ‘অন্ধকার’ শব্দটা ভয় জাগিয়ে দিলো। ঢিবঢিব বুক নিয়ে বোট থেকে নেমে এগিয়ে যেতে লাগল গুহার ভেতর।

ভেতরে ঢোকার জন্য তৈরি করা হয়েছে কাঠ বসানো সরু সড়ক। ভেতরে ঢুকে ভয় উড়ে গেল, জেগে উঠল আনন্দ! উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল বিশাল পাহাড়ের মধ্য খোলের মতো অনেক উঁচু ফাঁকা জায়গা। ঘুটঘুটে অন্ধকারের পরিবর্তে ওই স্থানে রয়েছে আলো আধারের অপরূপ রূপ! এত উপরে আলো ঢুকল কোত্থেকে? তাহলে কি পাহাড়চূড়া থেকে সরু কোনো ফুটো দিয়ে ঢুকছে রোদ? রোদ পেয়ে আঁধার হয়ে উঠেছে এমন সুন্দর!

আচমকা বাতাসের ঝাপটা খেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল ফুয়াদ। ভেবেছিল অন্ধকার থেকে তাকে আক্রমণ করেছে কালো ভূত। আসলে গুহার দখিনের বাকে ঘুটঘুটে আঁধার থেকে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে এসেছে কয়েকটি বাদুড়। আঁধারের মধ্যে ঝুলে আছে আরও অসংখ্য বাদুড়। বাদুড়ের আক্রমণ দেখে আচমকা চিৎকার দিয়ে জানেমান বলল, ‘ফুয়াদ বসে পড়ো, গুহার আলোর দিকে মুখ রাখো। ’

জানেমানের চিৎকার শুনে আলোর দিকে তাকাল ফুয়াদ। মুখে আলো এসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উড়ে আসা বাদুরগুলো আবার ঢুকে গেল অন্ধকারে।

হঠাৎ চিঁচিঁচিঁ শব্দ শুনতে পেল ফুয়াদ।
এযে মনজয়ী তোতার ডাক ! চোখ খুলে ফুয়াদ দেখল জানালার পাশে বসে ইলেকটার্চ প্যারোট তার দিকে তাকিয়ে চিঁচিঁ করছে। তোতাকে দেখে প্রশ্ন করল, ‘সে কি? আমি কি মালয়েশিয়ার লংকাউই দ্বীপে যাইনি এখন?’

তোতো বলল, ‘না, তুমি তো ঘুমোচ্ছ বাংলাদেশে, নিজের ঘরে। এতক্ষণেও উঠছ না দেখে তোমার সঙ্গে কথা বলার লোভে জানালার পাশে বসে দেখছিলাম তোমার ঘুমন্ত মুখ। ভয় পাচ্ছিলে! কেমন যেনÑ গোঁ গোঁ শব্দ বেরুচ্ছিল তোমার মুখ থেকে। ’

বড় করে শ্বাস নিল ফুয়াদ। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ। মজার একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। মালয়েশিয়ায় বেড়ানো কাহিনি স্বপ্নে এসে দখল করেছিল আমাকে। ’

‘তাহলে তো বিরক্ত করলাম! মধুর স্বপ্ন থেকে ঠেলে জাগিয়ে দিলাম তোমাকে!’

‘না। না। মধুর না। যখন ভূত বেশে বাদুড় এসে আক্রমণ করল, তখনই বন্ধুর মতো পাশে এসেছ তুমি, জাগিয়ে দিয়ে প্রকৃত বন্ধুর মতোই কাজ করেছ। তুমি সত্যিই মনজয়ী তোতা, আমার বন্ধু, তোতা পাখি। ’ তোমার মুখের মধুর বাংলা কথা প্রাণ জুড়িয়ে দেয় আমার। ’

বাংলাদেশ সময়: ২০১৬ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।