ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

একাত্তরে জলপথের যুদ্ধগাথা

ইমরুল ইউসুফ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৩
একাত্তরে জলপথের যুদ্ধগাথা

ঢাকা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। ভয়াল কালোরাত্রি।

নিরস্ত্র শান্তিপ্রিয় বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো পাকিস্তানি হানার বাহিনী ও তার দোসররা। তারপর নির্বিচারে হত্যা, নির্যাতন, ধষণ, লুণ্ঠন। এভাবে নয় মাস। ১৬ ডিসেম্বর। বাংলার আকাশে উড়লো লাল-সবুজ পতাকা। জয় হলো বাংলার, বাঙালির, বাংলাদেশের।

চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে সংযোজিত হয়েছিল নতুন একটি দেশ বাংলাদেশ। আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা। আমাদের এই অর্জন কারো একার নয়। আত্মত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা, গ্রামের সাধারণ মানুষ, স্থল বাহিনী, নৌপথে নৌ কমান্ডো সবাই এ স্বাধীনতা অর্জনের সমান ভাগীদার।      

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে স্থল বাহিনীর পর পরই নৌপথে যারা অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন তারা ছিলেন নৌকমান্ডো। বাংলাদেশের নৌপথে সৈন্য ও যুদ্ধ সরঞ্জাম পরিবহনের ব্যবস্থা ভণ্ডুল করার পাশাপাশি জাহাজ ও নৌযানগুলো ধ্বংস করাই ছিল এই বাহিনীর অন্যতম প্রধান কাজ। যদিও তারা আলাদা কোনো বাহিনী হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। আলাদা বাহিনীর স্বীকৃতিও ছিল না তাদের।

সমগ্র বাংলাদেশের নৌচলাচল, বন্দর এবং উপকূলীয় এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল ১০ নম্বর সেক্টর। তবে অন্য সেক্টরের মতো এই সেক্টরের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না। বিভিন্ন সেক্টরের সেক্টর কমান্ডাররা নিজ নিজ এলাকার সংশ্লিষ্ট উপকূল, বন্দর ও নৌ চলাচলে এসব কমান্ডোকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা  করতেন। তবে, নৌকমান্ডোরা তাদের অধীনে ছিলেন না। তারা মুজিবনগর হেড কোয়ার্টারের সরাসরি নির্দেশে দায়িত্ব পালন করতেন।

ভারতীয় সেনাবাহিনী ’৭১ এর ১৬ মে বিএসএফের কাছ থেকে বাংলাদেশে সামরিক তৎপরতা চালাবার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে। এক সপ্তাহ পর ২৩ মে ভাগিরথী নদীর তীরে একটি গোপন ক্যাম্প চালু করা হয়। ক্যাম্পটির অবস্থান ছিল পলাশীর স্মৃতি সৌধের পাশে। এর সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় ‘সি২পি’। ক্যাম্পের জন্য লোক সংগ্রহের জন্য ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিসাররা বিভিন্ন যুব শিবির সফরে বেরিয়ে পড়তেন। জুন মাসের মধ্যে ১৫০ জন স্বেচ্ছাসেবকের প্রথম দলটি বাছাই করে ‘সি২পি’ ক্যাম্পে পাঠানো হয়।

আগস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে তাদের লিমপেট মাইন, হ্যান্ড গ্রেনেড, রাইফেল, স্টেনগান, মেশিন গান চালানোর ট্রেনিং দেওয়া হয়। তাদের শেখানো হয় পায়ের পাতায় ফিন (এটি এক প্রকার পাখা যা পায়ের পাতায় পরে নিলে স্বচ্ছন্দে সাঁতার কাটা যায়) পরে পানিতে ঢেউ না তুলে কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটা যায়। ট্রেনিংয়ের এই পুরো ব্যপারটাই ছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর দায়িত্বে।

হাতে-কলমে এই শিক্ষার পাশাপাশি টিম লিডারদের অপারেশন পরিচালনার জন্য শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল গোপন একটি পদ্ধতি। তবে এই পদ্ধতি কমান্ডোদের কাছে জানানো নিষেধ ছিল। গোপন এই পদ্ধতিটি ছিল বিশেষ একটি সংকেত। তাদের নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে আকাশবাণী কলকাতা (ভারতের সরকারি রেডিও সার্ভিস)শোনার জন্য একটি করে রেডিও দেওয়া হয়েছিল।

সংকেতটি ছিল পুরোনো দিনের বিশেষ দুটি গান। ১. আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুর বাড়ি। ২. আমি তোমার শুনিয়ে ছিলাম যত গান/তার বিনিময়ে চাইনি কোনো প্রতিদান। প্রথম গানটি শোনার পর বুঝতে হবে ওই সময় থেকে ২৪ ঘণ্টা পর রাত ১টা থেকে ২টার মধ্যে অপারেশন সারতে হবে। আর দ্বিতীয় গানটি শোনার পর বুঝতে হবে ওই রাতের ১টা থেকে ২টার মধ্যে তারা পাকিস্তানি জাহাজসমূহে হামলা চালাবে। তবে এসব অপারেশন নির্ভরশীল ছিল অনুকূল আবহাওয়া, জোয়ার-ভাটা, বাতাসের গতিবেগ প্রভৃতি বিষয়ের ওপর।

২৮ জুলাইয়ের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় ১৪ আগস্ট অর্থাৎ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে পাকিস্তানের নৌঘাঁটি বা নদীবন্দরগুলোর ওপর আক্রমণ চালানো হবে। সেই লক্ষ্যে ৯ আগস্ট পলাশীর হরিনা ক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু হয়। কমান্ডো দলের এই অভিযানের সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন জ্যাকপট’। পরিকল্পনা মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে তারা একসঙ্গে পৌঁছে যাবে নিজ নিজ এলাকায়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডোদের প্রথম ব্যাচকে মোট ৪টি দলে ভাগ করা হয়েছিল।

৬০ জনের দুটি ও ২০ জনের দুটি দল। সাবমেরিনার এ ডাব্লিউ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৬০ জনের প্রথম দলটিকে পাঠানো হয়েছিল প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে।

সাবমেরিনার আমানউল্লাহ শেখের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দলটিকে পাঠানো হয়েছিল খুলনার মংলা বন্দরে। সাবমেরিনার বদিউল আলামের নেতৃত্বে ৩য় দলটিকে পাঠানো হয়েছিল কুমিল্লার চাঁদপুরে। এবং সাবমেরিনার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ৪র্থ দলটিকে পাঠানো হয়েছিল নারায়ণগঞ্জে। তবে সুদূর পলাশী থেকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে কিংবা পথের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার কারণে এসব অভিযান দুএকদিন দেরি হয়ে যায়।

তাদের সবার কাছ ছিল লিমপেট মাইন, একজোড়া ফিন ও শুকনো খাবার। প্রতি তিনজনের কাছে ছিল একটি করে স্টেনগান। সার্বিক দায়িত্বে নিযুক্ত গ্রুপ কমান্ডারকে আরও দেওয়া হয় একটি করে রেডিও। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য ছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও কলকাতা কেন্দ্রের প্রতিটি সংগীতানুষ্ঠান তাকে খুব মন দিয়ে শুনতে হবে। কারণ আগেই বলা হয়েছে রেডিওতে কোন গান শুনে কোন দিন কোন সময় অপারেশন চালাবে নৌকমান্ডোরা।

নৌকমান্ডোরা প্রথম অপারেশন চালায় ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে। ওই দিন রাতে লিডার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর (এ ডাব্লিউ চৌধুরী) নির্দেশ মতো ১১ জন কমান্ডো নেমে পড়লেন কর্ণফুলী নদীতে। অতি গোপনে তারা ১১ জন ১১টি জাহাজের গায়ে লিমপেট মাইন লাগিয়ে আবার কূলে ফিরে আসে। রাত ১টা ৪০ মিনিট। একটির পর একটি মাইন বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে উঠল চট্টগ্রাম বন্দর নগরী। পাকিস্তানি নিরাপত্তা প্রহরীরা দিশেহারা হয়ে গুলি ছুড়তে থাকে চারদিকে। নিমিষেই অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ডুবে গেল এমভি হরমুজ, আল আব্বাস, ওরিয়েন্ট বার্জসহ আশপাশের বার্জ এবং জাহাজগুলো।

সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে ১৮ জন কমান্ডো ১৫ আগস্ট চাঁদপুরে আক্রমণ চালান। তিনি তার দলকে তিনজন করে মোট ৬টি অংশে ভাগ করে অভিযান চালিয়েছিলেন। এই অভিযানে লিমপেট মাইনের বিস্ফোরণে ধ্বংস হয় ২টি স্টিমার, গমবাহী একটি বড় জাহাজসহ কয়েকটি নৌযান। ১৯৭১ সালের ১লা নভেম্বর গোয়ালন্দ ফেরিঘাটে অভিযান চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় কমান্ডো মোহাম্মদ ফারুকের ওপর। তার দলে ছিলেন মোট চারজন কমান্ডো এবং আটজন গাইড। ওই দিন ভোর ৪টার দিকে পানিতে নেমে তেলের ট্যাংকার এবং ফেরীতে মাইন সংযোগ করে এক চরে গিয়ে অবস্থান নেন তারা। মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে মাইন বিস্ফোরিত হলে ট্যাংকার ও ফেরি ডুবে যায়।

১২ নভেম্বর অপারেশন চালানো হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে। অপারেশনের স্পট ছিল ডেমরা ও তারাবো ফেরিঘাট। টার্গেট ছিল নারায়ণগঞ্জ বিশ্ব গোডাউনের পাশে শীতলক্ষ্যা নদীতে নোঙর করা ৪টি জাহাজ। এবং মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে নোঙর করা পাক হানাদার বাহিনীর অস্ত্র বোঝাই একটি জাহাজ। রাত আনুমানিক একটা। ডেমরা ও তারাবো ফেরি দুটি ধ্বংস করে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে স্থলপথে যাতায়াতের পথ বিচ্ছিন্ন করার জন্য নৌকমান্ডোরা একসঙ্গে পানিতে নামেন। ঘাটে গাড়ি না থাকায় ফেরি পারাপার কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকে। এই সুযোগে তারা দ্রুত ডুব সাঁতার কেটে জাহাজ ও ফেরিতে মাইন সংযোগ করে সরে পড়েন। আধাঘণ্টা পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে জাহাজ ও ফেরি পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে।

চট্টগ্রাম বন্দরে তৃতীয়বারের মতো নৌকমান্ডো অভিযানের জন্য এ ডাব্লিউ চৌধুরীকে পুনরায় দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবং শাহ আলম চৌধুরীকে সাব কমান্ডার করে ২২ সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়। দলটি ১৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে নিঃশব্দে পানিতে নেমে পড়েন। তারা বন্দরে নোঙর করে রাখা এম ভি সুরাইয়া, এম ভি টেকনাফ এবং এম ভি কম্পা নামের তিনটি জাহাজের তলদেশে পৌঁছান। তারপর গামছা দিয়ে বুকে বাঁধা মাইন খুলে জাহাজের গায়ে সংযোগ করে দেন। আধা ঘণ্টার মধ্যেই একে একে মাইনগুলো বিস্ফোরিত হলে জাহাজগুলো ডুবতে শুরু করে।

পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য বহন করা অস্ত্র, খাদ্যসামগ্রী ও তেলজাতীয় পণ্যবাহী জাহাজগুলো যখন নৌকমান্ডোরা একের পর এক ডুবিয়ে দিতে থাকে তখন বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে তাদের বীরত্ব অবলোকন করছিল। আর তারা অবাক হবেই বা না কেন; ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নৌকমান্ডোরা জাহাজ, স্টিমার, গানবোট, ফেরিসহ ডুবিয়ে দিয়েছিল মোট ৩৬টি জলযান।

নৌকমান্ডোদের এমনি আক্রমণের ফলে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এক নতুন গতি সঞ্চার করে। সংযোজন করে নতুন এক অধ্যায়। ফলশ্রুতিতে ত্বরান্বিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা।

বাংলাদেশ সময়: ০০৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।