ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

তপুর স্বপ্ন

চন্দনকৃষ্ণ পাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৪
তপুর স্বপ্ন

এসব কি হচ্ছে? নিজের চোখকেই বিশ্বেস হয় না তপুর। তার চেহারাটা ছোট মাসীর মতোই।

কিন্তু ভীষণ মোটা। আর ঘাটলার শেষ দুটো সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। দাঁড়িয়ে আছেন বেশ কিছুক্ষণ। খুব একটা গুরুত্ব এতক্ষণ দেয়নি তপু। কিন্তু ওনার চিৎকারে চমকে তাকিয়ে দেখে দুটো ছোট হাত পানি থেকে মহিলার পা জাড়িয়ে ধরেছে। আর টানছে নীচের দিকে। কি ভয়ানক কাণ্ড!

মহিলা চিৎকার করে সাহায্য চাইছেন। তপু লাফিয়ে নীচে নেমে ছোট মাসীর মতো চেহারার মহিলার আঁচল ধরে ফেলে। প্রাণপণে টানতে থাকে ওপরের দিকে। ছোট হাত দুটো অনেক চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হয়ে যায় ঠিক তখনি পানি থেকে মাথা তুলে কড়া চোখে তপুর দিকে তাকায়। তপু অবাক হয়ে দেখে মেয়েটা পাশের বাড়ির খুকু। কি অদ্ভুত, খুকু তো সাঁতার জানে না। অথচ এই মেয়ে দিব্যি সাঁতার কেটে মাছ পুকুরের দিকে রওয়ানা দিয়েছে। বিশাল একটি বোয়াল মাছ পানি থেকে মুখ তুলে হা করে একটা ভেংচি কেটে মেয়েটার পিছু পিছু ছুট লাগালো।

মোটা মহিলা ‘বেঁচে গেছি , খুব বেঁচে গেছি, এ জন্মে এই রাক্ষুসে পুকুরে আর আসছি না’ বলে হাঁটতে শুরু করেছেন। তপু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। খুকুর মতো মেয়েটা আর বিশাল বোয়াল মাছটা এখন পুকুরের মাঝামাঝি...।

এ্যাই তপু, তপু। আরে ওঠ। বাড়ি যাবি না ? -এ্যা। মিশুর ডাকে ঘুম ভেঙে যায় তপুর। অবাক হয়ে মিশুর দিকে তাকায়। এতক্ষণ সে তাহলে স্বপ্ন দেখছিল। সারা শরীর ঘেমে পাকা সিঁড়িতে ঘামের দাগ লেগেছে। ঘাটলার শেষ সিঁড়ির দিকে তাকায়। কেউ নেই। মাঝ পুকুরের জলও নিথর। চাঁদ উঠেছে অনেকক্ষণ। চাঁদের ঝলমলে আলোতে বিশাল সাগর দীঘি উজ্জ্বল। তপু উঠে বসে। ওর বাদামের ডালা আর ছোট্ট দাঁড়িপাল্লাটা ঠিকই আছে। হাফ প্যান্টের পকেটে হাত দেয়। টাকাগুলো আছে।

আজ  বেশ তাড়াতাড়ি ওর বাদাম বিক্রি হয়ে যায়। ভাবছিলো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাবে। সাগর দীঘির পাশ দিয়েই রাস্তা। দীঘির কাছে আসতেই খুব ইচ্ছে করে বসতে। কিছুক্ষণ বসার পর ক্লান্তিতে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে ওর। সারা দিনের ভ্যাপসা গরমের পর দীঘি থেকে ওঠে আসা মিষ্ঠি ঠান্ডা বাতাস দারুণ লাগে তপুর কাছে। ও বাদামের ডালাটা একপাশে রেখে প্রশস্ত সিঁড়িতে শুয়ে পড়ে। আর কখন যে ঘুম নেমে আসে দু’চোখে বুঝতেই পারে না। শুয়ে আবার অবাক হত্তয়ার মতো একটা স্বপ্ন দেখে ফেলে ও। কেমন অদ্ভুত একটা স্বপ্ন। ওর কেমন ভয় ভয় লাগে।

মিশুকে সাথে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটে তপু। রাস্তার পাশের একটা বাড়ির রেডিও থেকে  সিনেমার গান ভেসে আসছে। বেশ নিরিবিলি হয়ে এসেছে রাস্তা। মাঝে মাঝে দু’একটা রিকশা ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে  তপুর। মাঝে  মাঝে  এমন হয়। প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় তপুকে। জন্মের পর থেকে বাবাকে কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ে না তপুর। বাবার একটা বাঁধানো ছবি ছাড়া অন্য কোনো চিহ্নও নেই বাড়িতে। মায়ের বিষণ্ন মুখটা একবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তপুর ।

পুরনো একটা সেলাই মেশিন নিয়ে খুব কষ্টে দিন চালিয়ে আসছেন মা। দুই ভাই-বোনের খাবার, কাপড়-চোপড়, স্কুলের বইপত্রের খরচ দিতে মাকে হিমশিম খেতে হয়।    তপু সব বোঝে। কিন্তু ও তো ছোট মানুষ। মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ে। আর একটু বড় হলে হয়তো ভালো কোনো কাজ করে বেশি রোজগার করতে পারতো। এখন এই বাদাম বিক্রি  ছাড়া অন্য কোনো উপায় তো নেই।  
-কিরে চুপচাপ যে একেবারে। মিশুর কথায় বাস্তবে ফিরে আসে তপু।
-না এমনিতেই। শরীরটা কেমন জানি করছে।
- বাড়িতে গিয়ে খেয়ে ঘুম লাগা। ভোরবেলা দেখবি শরীর ঠিক হয়ে যাবে।
-তাই করবো।  
বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে দু’জন। মিশুরা আরো দু’তিনটা বাড়ি পরে থাকে। তপু বাড়ির উঠানে পা রাখে। কালো রঙের প্রিয় কুকুরটা এসে পায়ের কাছে কুই কুই করে আদর জানায়। তপু কুকুরটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মাকে ডাকলে মা দরজা খুলে দেন।
-এতো দেরি হলো বাবা। মার কণ্ঠে উদ্বেগ।
-এমনিতেই মা।
-তোর চোখ এতো ছল ছল করছে কেন?
মা গায়ে হাত দিয়ে চমকান। বেশ গায়ে জ্বর তপুর।
-গায়েতো জ্বর। হঠাৎ করে জ্বর এলো কেন?
-কি জানি। বিকেল থেকে শরীরটা কেমন জানি করছে।
-পানি দিচ্ছি। হাত মুখ ধুয়ে কিছু খা। খেয়ে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়। মায়ের মুখে একটা ভয়ের ছাপ পড়ে।
তপু হাত মুখ ধুয়ে ঘরে আসে। রুম্পা ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ করে মনে পড়ে রুম্পার জন্য টিপ আনা হয়নি। আজ  বাজারে যাবার সময় রুম্পা বারবার টিপ আনার জন্য বলেছিল। মনটার যে কি হয়েছে বুঝেনা তপু।

চৌকির ওপর আরাম করে বসে তপু। মা একটা গ্লাসে করে গরম পানি ও একটা ট্যাবলেট আর দুখানা টোস্ট আনেন। একটা টোস্ট খেয়ে পানি আর ওষুধ খায় তপু। তার পর শুয়ে পড়ে। মা মাথার কাছে বসে হাত বুলিয়ে দেন মাথায়, মুখে। চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসে তপুর।


মাঝ রাতে ঘুম ভাঙে তপুর। ঘামে গায়ের শার্ট ভিজে গেছে। জ্বর কমেছে বোধ হয়। মা শুয়ে আছেন ওর পাশে। হারিকেন খুব সামান্য আলো ছড়াচ্ছে ঘরে। মায়ের ক্লান্ত মুখটা দেখে তপু। বিষণ্ন। বুকের ভেতরে একটা কষ্টের স্রোত বয়ে যায়। বাবা যে কোথায় গেলেন। কেউ জানে না। মাকে বলে ছিল তপু। মা বলেন বাবা নিশ্চয় বেঁচে আছেন। একদিন ফিরে আসবেন। অবশ্যই ফিরে আসবেন। কিন্তু কবে? ততোদিন টিকে থাকতে পারবেতো তপুরা।

ভোরবেলা জানালার খোলার শব্দে ঘুম ভাঙে তপুর। রুস্পা জানালা খুলছে। ভোরের বাতাসে রুম্পার কোঁকড়ানো চুল উড়ছে। মায়ের দিকে তাকায় তপু। মা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
-ঘুম ভেঙেছে বাবা?
-হ্যাঁ মা, জ্বরও কমে গেছে।
মায়ের মুখ থেকে বিষণ্নতা কেটে যায়। তপুর কপালে ভীষণ আদর করে একটা চুমু খান মা। মাকে জড়িয়ে ধরে তপু।

ইচ্ছেঘুড়িতে লেখা পাঠান এই মেইলে: ichchheghuri24@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৮২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।