ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

দুলালের স্বপ্ন

সুমাইয়া শারমিন রিয়া | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৬ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৪
দুলালের স্বপ্ন

দুই সন্তান দুলাল ও শানুকে নিয়ে সখিনার সংসার। একে তো দারিদ্র্য।

এ দারিদ্র্যকে আরো কঠোরভাবে সংসারে পুঁতে রেখে চলে গেছে দুলালের বাবা। রাজ্যের অভাব হাতছানি দিয়ে ডাকে। কী করবে ভেবে কূল-কিনারা করতে পারে না দুলালের মা। সখিনা দুলালকে খেতে ডাকে
—দুলাল, দুলাল, আরে ওই দুলাল, ঘরে আয়, ভাত খাবি।
—আইতাছি মা। দাও, জলদি কইর্যা ভাত দাও, খেলতে যামু।
—সারা দিন খেলা আর খেলা। আর কোনো কাম নাই। খেইল্যা বেড়াইলে প্যাট ভরব? যা হাত-মুখ ধুইয়্যা নে। বেলা হইল ভাত খাবি। আর শোন, ভাত খাইয়্যা গরুডারে চড়াইতে নিয়া যাবি। গরুডা বিহান থাইক্যা না খাইয়া আছে।
—আমি গরু চড়াইতে পারুম না।
—ক্যান, পারবি না ক্যান? খাইতে পারোস, আর গরু চড়াইতে পারোস না।
—হ, হ, পারুম না। কাম করতে ভালো লাগে না।
 —এই নবাবের পোলা, কাম করতে পারবি না ক্যান? তোর বাপ কি জমিদারি রাইখ্যা গেছে? কাম না কইর্যা বইয়্যা বইয়্যা খাবি!
 —আমি লেখাপড়া করুম। দবির দাদায় কইছে, আমারে শহরে লইয়্যা যাইব। হেখানে লেখাপড়া শিখাইব।
 —আমরা হইলাম গরিব মানুষ। তোরে লেখাপড়া করামু কেমনে। তুই কাম না করলে খাওন আইবো কই থাইক্যা। তোর বাপে তো মইর্যা বাঁচছে। এখন তুই যদি এমন করোস তাইলে আমরা বাঁচি কেমনে?
 —কইলাম না, আমি কোনো কাম করতে পারুম না। আমি অহন খেলতে যামু।
 —কি, মুখের ওপর চোপা করস? তোরে আইজ মাইর্যা ফালামু। সখিনা দুলালরে মারতে থাকে।
 —মইর্যা গেলাম গো, মা আমারে মাইর্যা ফ্যালাইলো গো!

এ সময় দবির মিয়া — কি হইলো দুলালের মা, ছেলেটারে ওমন কইর্যা মারতাছো ক্যান?
 —কি কমু দুঃখের কথা চাচা, কাম না কইর্যা পোলা লেখাপড়া করতে চায়। আমরা গরিব মানুষ, লেখাপড়া করার ট্যাকা পামু কই? আপনে তো সব কিছু জানেন, নতুন কইর্যা আর কী কমু চাচা!
 —জানি বইল্যাই তো কইছিলাম দুলালেরে শহরে আমার পোলার কাছে রাইখ্যা আসি। তোমার ছেলে সেখানে ভালোই থাকবে। তুমি তো আমার কথায় রাজি হইতাছ না।
 —ওর বাপে মরণের পর থাইক্যা পোলাডারে কোলে-পিঠে কইর্যা মানুষ করছি। এক দিনের লাইগ্যা চোখের আড়াল করি নাই। এখন কোন পরানে শহরে পাঠাই, আপনে কন চাচা।
 —সবই বুঝিরে মা। কী আর করবা, পোলাডারে মানুষ তো করতে হইব, তোমারেও বাঁচতে হইব। তাই কইছিলাম, তুমি আর অমত না কইর্যা দুলালেরে শহরে যাইতে দাও। কালই আমি ওরে শহরে আমার পোলার কাছে রাইখ্যা আহি। সেখানে আমার নাতি-নাতনি দুইডার লগে লেখাপড়া করব। তোমাদের জন্যও মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাইতে কমু আমার ছেলেরে।
 —ঠিক আছে চাচা। আপনের ওপর ভরসা করি দেখি কপাল ফিরাইতে পারি কি না!

দবির মিয়া দুলালকে খুবই স্নেহ করেন, বিশেষ করে লেখাপড়ার প্রতি দুলালের আগ্রহে তিনি অবাক হন। মাঝে মাঝে দুলালের দিকে চেয়ে থেকে বলেন, আহারে! এই পোলাডা যদি বড়লোকের ঘরে জন্ম হইত, একটা সোনার টুকরার লাহান বড় হইত। বড় অফিসার হইত লেখাপড়া শিখা!

দুলালের বাপ গরিব ছিল ঠিক। কিন্তু খুব ভালো মানুষ ছিল। তাই তো গ্রামের অনেকে তাকে এখনো মনে করে, বিশেষ করে এই দবির মিয়া। আল্লাহ তারে দুই হাত ভরে দিয়েছে। তার সন্তানরা বিদেশ থাকে, একজন শহরে অনেক বড় অফিসার, যার কাছে সে দুলালকে নিয়ে যাচ্ছে। দুলাল এতক্ষণ ট্রেনের অদ্ভুত শব্দ ও গতি দেখছিল মনোযোগ দিয়ে। দবির মিয়াকে আনমনা দেখে সে বলে
 —দাদা, কি চিন্তা কর। দেহো, টেনের সাথে রাস্তার গাছগুলানও কী রকম দৌড়াইতাছে। আইচ্ছা, রাস্তার মানুষগুলাও এমন দৌড়ায় দাদা।
 —দবির মিয়া হেসে বলেন, তোর মতন এমন আদর কইরা কে আমারে দাদা ডাকবোরে দুলাল? তোরে তো এহন থেইক্যা ঢাকায় থাহন লাগব। মেলা বড় অফিসার হবি কিন্তু। দুষ্টামি করবি না, বেশি বেশি লেহাপড়া করবি। তোর মায়েরে আমি বড় গলায় কইছি। বুঝলি দাদু। দবির মিয়া দুলালের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সঙ্গে বিস্কুট ও পানি ছিল, দুলালকে খাইতে দেয়, নিজেও খায়।
দবির মিয়া দুলালকে নিয়ে তাঁর ছেলে হাসানের বাড়িতে আসেন। কলিং বেলের শব্দ পেয়ে দবির মিয়ার নাতনি মিতুল দৌড়ে এসে বলে—
 —কে? (দরজা খোলার পর)—ও দাদু যে, এসো দাদু, ভিতরে এসো।
 —কেমন আছো দাদুরা?
 —ভালো আছি দাদু।
হাসান সাহেব বলেন —কে রে মিতুল, কে এসেছে?
 —আব্বু-আম্মু, তোমরা এদিকে এসো। দেখো দেশ থেকে দাদু এসেছেন। সঙ্গে একটি ছেলেকেও এনেছেন।
হাসান সাহেবের স্ত্রী সাথী শ্বশুরকে সালাম দেয়
 —আসসালামু আলাইকুম।
 —ওয়ালাইকুম সালাম। তোমরা কেমন আছো বউমা?
 —আমরা ভালো আছি। আপনার শরীর ভালো তো আব্বা?
 —এই আছি আর কী, বয়স হয়েছে। আগের মতো শরীরে বল পাই না।
 —কত করে বললাম, দেশে থেকে তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। ঢাকায় চলে এসো। আমরা একসঙ্গে থাকি। তুমি তো কোনো কথাই শুনতে চাও না।
 —যে কদিন বেঁচে আছি সে কদিন তোর মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে দেশের বাড়িতেই কাটিয়ে দেব। শোনো বউমা, তোমরা তো একটা কাজের ছেলের কথা বলেছিলে, তোমাদের জন্য ছেলেটাকে এনেছি।
 —খুব ভালো করেছেন বাবা। কাজের লোক না থাকায় আমাদেরও খুবই অসুবিধা হচ্ছে।
 —ছেলেটা আমার দুরসম্পর্কের আত্মীয় বটে। তোমরা ছেলেটার প্রতি লক্ষ রেখো, যাতে করে কাজের ফাঁকে ফাঁকে লেখাপড়াও করতে পারে। ছেলেটার লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছা। আর মাসে মাসে ওর মার নামে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিও।
 —ঠিক আছে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আব্বা।
 —বাবা হাসান, আমি কিন্তু আজ বিকেলের ট্রেনেই বাড়ি চলে যাব।
 —কী বলো, কটা দিন থেকে গেলে ভালো হতো না বাবা?
 —বাড়িতে কেউ নেই। আজকে যেতে পারলে ভালো হতো।
দবির মিয়ার দুই নাতনি মিতুল ও রিতু পাশে এসে দাঁড়ায়। রিতু বলে
 —দাদু, তুমি আজ যেও না দাদু।
 —না, দাদু আজই চলে যাব।
 —এখানে কিছুদিন থাকো না দাদু। দেশের বাড়িতে পরে যেও!
 —হ্যাঁ দাদু, এক সপ্তাহ থেকে যাও।
 —মাসখানেক পরে এসে কয়েক দিন থাকব দাদুরা। ঠিক আছে।
মিতুল ও রিতু দুজনেই মাথা ঝাঁকিয়ে দাদুর কথা মেনে নেয়।
বিকেলে মিতুল ও রিতু স্কুলের ব্যাগ নিয়ে প্রাইভেট পড়তে যায়। যাওয়ার সময় দাদুর পা ছুঁয়ে সালাম করে বিদায় নেয়।
ততক্ষণে হাসানও অফিস থেকে ফেরে। সে স্টেশনে এসে বাবাকে ট্রেনে তুলে দেয়। দবির মিয়া ছেলের হাত ধরে বলে
—ছেলেটা লেখাপড়া করার জন্য ব্যাকুল। তুই একটু দেখিস বাবা। বউমাকে বলিস যেন এদিকটা একটু লক্ষ রাখে। আর গ্রামের ছেলে, ভুল করতে পারে। বেশি বকাবকি না করে তোরা বুঝিয়ে বলিস, দেখিয়ে দিস। তাহলে বোধ হয় সমস্যা হবে না।
 —বাবা তুমি এ নিয়ে চিন্তা কোরো না।
 —বউমা, আসি তাহলে। ছেলেটাকে মানে দুলালকে রেখে গেলাম। খেয়াল রেখো মা। তুমি খুব বুদ্ধিমতী। বেশি কিছু বলবার দরকার মনে করি না।
 —বাবা, এ নিয়ে আপনি ভাববেন না। সব কিছু ঠিকমতো হবে।
 —দুলাল, দাদু এদিকে আয় দেখি। ওমা, কাঁদে না। এই যে, এরা তোর দাদার চেয়েও তোকে বেশি আদর করবে। ঠিক আছে। ঠিকমতো থাকিস। কোথাও বের হবি না। না বলে কোনো দিকে যাবি না। কথা শুনবি। দুলালের মাথায় হাত বুলিয়ে দবির মিয়া বলেন
 —আমি যাই দাদু।
 —চোখভরা পানি নিয়ে দুলালও বলে, আচ্ছা দাদু। মায়েরে দোয়া করতে কইবেন।

সখিনার আট বছরের মেয়ে শানু ওঠানে দড়ি লাফ খেলছে।
 —এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ...।
সখিনা মেয়েকে ডাকে, কই গেলিরে মা শানু? এই দিকে আয় তো একবার।
 —আয়তাছি মা। কী কইবা জলদি কও। খেলতে যামু।
 —হেই খেলার লাইগ্যা তোর ভাইরে সেই দিন কি মাইরডা না মারছিলাম। না জানি পোলা আমার শহরে গিয়া কী করতাছে, কী খাইতেছে! তোর ভাইয়ের কথা মনে উঠলে পরানডা আমার ফাইটা যায়। কত দিন হইয়্যা গেল পোলাডার কোনো খবর পাইলাম না। আল্লাই জানে দুলাল আমার কেমন আছে।

সখিনা মেয়ে শানুকে কোলে টেনে নেয়। ছেলের কথা মনে করে অঝোরে কাঁদতে থাকে। হঠাৎ করে বাড়ির উঠানের মাথায় শানুর চোখ যায়। সে দেখে তার ভাই দাঁড়িয়ে আছে। ছোট্ট শানু প্রথমে মনে করল ভুল দেখল কি না। সে মাকে বলে—
 —কাইনদোনা মা। দ্যাখো, দ্যাখো। শহর থন তোমার পোলা আইয়্যা পড়ছে। কী সমাচার? ক্যান আইলো!
 —কী কস তুই? তাই তো আমার দুলাল শহর থন আইয়্যা পড়ছে। কিরে বাজান একলা ক্যামনে আইলি?
দুলাল এতক্ষণ নিশ্চুপ। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল সে। বেশ কিছুক্ষণ পর মা ও বোনের দিকে তাকিয়ে সে বলে—
 —ট্রেনে চইড়্যা পালাইয়্যা আইছি!
 —কী! পালাইয়্যা আইছস ক্যান?
 —না পালাইয়্যা কী করুম মা। আমি লেখাপড়া করতে চাই। কিন্তু ওরা কেউ আমারে লেখাপড়া করতে দেয় না। খালি কাম করায়। কাম না করলে হগলে খালি মারে। দ্যাখো মা, আমারে মাইর্যা ফাটাইয়্যা ফালাইছে! দুলাল আর কান্না চেপে রাখতে পারে না।
 —কী কস তুই। হ্যারা এমুন খারাপ লোক? চাচা আহুক, চাচারে আমি জিগামু আমার পোলা কী করছে যে ওরা এমুন কইর্যা মাইর মারছে!
 —মা, দাদারে বইলা কী অইবো। উনি তো আমাগো সুখের কথা ভাইবাই ঢাকায় নিছেন। তাঁর পোলার পরিবার তো তাঁর মতো ভালা না। তাঁরে দোষ দিয়া কাম নাই।
 —তাও চাচার লগে আমি কথা কমু।
 —মা, আমাগো কপালে সুখ নাই। এইডাই আসল কথা। আর দুষ্টামি করমু না মা। তোমার লগে কাম করমু। ফাঁকে ফাঁকে লেখাপড়াও করমু। তুমি শুধু দোয়া কইরো মা। দাদারে রাগ কইর না। আমারে পড়া শিখাইতে কইও।

দুলালের সব কথা দবির মিয়া শুনেছেন। তিনি দুলালের মায়ের সামনে এসে বলেন—বউমা, তোমারে আর কিছুই কইতে হইবো না। আমি সব শুনছি। আমার ছেলের বউ আর নাতনিরা যে এমন ব্যবহার করব—আগে জানলে দুলালেরে আমি তাগো কাছে দিয়্যা আইতাম না। থাক যা হওয়ার হইছে। আমারে আর লজ্জা দিও না। তুমি তো জান বউমা, দুলালের বাপ আমার কাছে জমি বন্দক রাইখ্যা টাকা নিছিল। সেই টাকা ফেরত দিতে না পাইরা আমারে জমি লেইখ্যা দিছিল। আমি তোমারে সেই জমি ফিরাইয়্যা দিলাম বউমা। আর দুলালেরে স্কুলে ভর্তি কইর্যা ওর লেখাপড়ার সব খরচ আমি চালামু। লেখাপড়া করার অধিকার সবারই আছে। তাই দুলাল আর শানু কাল থাইক্যা স্কুলে যাইব।

বাংলাদেশ সময়:  ১৬২৫ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।