ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

আত্মার ভেতর সোনার মোহর | মোহিত কামাল

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩১ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৪
আত্মার ভেতর সোনার মোহর  | মোহিত কামাল

মেঘনা নদীর এপারে মেসিদের বাড়ি। সকালে ঠেলাজাল দিয়ে খালে কিংবা জমে থাকা খেতের পানিতে চিংড়ি মাছ ধরে মেসি।

একদিন মাছ ধরার সময় জালে আটকা পড়ল একটা ছোট্ট সিলগালা সিন্ধুক। সিন্ধুক খুলে পাওয়া গেল একটা তাজা বই। বইটির মোড়ক খুলে পৃষ্ঠা ওল্টাতে গিয়ে চমকে ওঠল মেসি। লেখকের আত্মার স্বর বর্ণমালার বুক চিরে বেরিয়ে এল- বিয়ে বাড়িতে সাজানো মরিচাবাতির মতো লাল, নীল, আর হলুদ রঙের ঝিলমিল আলো জানান দিতে লাগল বর্ণমালার মধ্যে আত্মার প্রকাশ্য অবস্থান।

গ্রামের স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়–য়া মেসি আর্জেন্টিনার ফুটবল তারকা মেসি নয়, বাংলাদেশের দরিদ্র পল্লীর এক কিশোর। মেসির মতো খেলার সুযোগ নেই তার। প্রতিদিন ভোরে জীবন সংগ্রামে নামতে হয় তাকে। মাছ ধরে দিনে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে ছুটে যায় সে স্কুলে। মেঘনার কুলে তার বাড়ি। মাঝে মাঝে সাগর-আর মেঘনা নদীর মোহনার জলে তৈরি হয় ঘূর্ণি। ঢল আসে। সাগরের পানি দাবিয়ে দেয় নদীর পানির স্রোতে, প্লাবিত হয় ঘর-বাড়ি, খেত-খামার। সেই জলে ভেসে এসেছে এক ফুট বাই দেড় ফুট ছোট্ট পিতলের সিন্ধুকটি।

সিলগালা করা সিন্ধুকটি পাওয়ার পর তুলে দিয়েছিল তার বাবার হাতে। সবাই ভেবেছিল নিশ্চয় স্বর্ণমুদ্রায় ভরা রয়েছে ছোট্ট সিন্ধুকটি। লৌহ কাটার করাত কিনে সিন্ধুকের মুখ খুলে হতাশ হয়েছিলেন মেসির বাবা- সিন্ধুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে তাজা বইটি। পরিবারের কেউ খুশি না হলেও খুশি হয়েছিল মেসি। অক্ষত বইটি লেখা ফরাসি ভাষায়। বর্ণগুলো চেনা এবং শব্দগুলো পড়ার ক্ষমতা নেই মেসির কিন্তু এখন ঘরে বসে পরম মমতায় বইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল সে। আর তখনই আলোর ঝিলমিল ওঠল বর্ণ থেকে। তবে কি লেখকের আত্মা ধারণ করে জীবন্ত হয়ে আছে বর্ণগুলো? নাকি বইয়েরও আত্মা আছে? সেই আত্মাই কি জেগে উঠেছে আলোর তরঙ্গরূপে?
বর্ণগুলোর উদ্দেশে মেসি জিগ্যেস করল,‘তুমি কি জীবিত?’
‘হুম... হুম... হুম...’
তিনবার শব্দ হলো। শব্দের গুম গুম ধ্বনি শুনে ভয় পেল না, আরো সাহসী হয়ে সে প্রশ্ন করল, ‘কে তুমি? তোমার নাম কি?’
‘আমি একটা প্রবন্ধের বই, আমার নাম আত্মার নিয়তি। ’
‘নিজেকে পরিচয় দিচ্ছ বই হিসেবে, আবার কথাও বলছ, কী করে সম্ভব?’
‘আমার লেখকের নাম আর্সেন হুসো। হুসো বলেই তাকে ডাকতে পারো তুমি। হুসোর আত্মা মিশে আছে আবার বুকে লেখা প্রতিটি বর্ণমালায়। ’
‘আমি কি তার সঙ্গে কথা বলতে পারি?’
‘অবশ্যই পারবে। ’
‘কীভাবে?’
‘আগে তোমার নিজের আত্মাকে ধুয়ে নাও, পরিচ্ছন্ন হও। শুদ্ধ হও। তারপর পরানের ভেতর থেকে হুসো হলে ডাক দাও, হুসো জেগে উঠবে। তোমার সব প্রশ্নের জবাব দেবে। কথাও বলবে তোমার সঙ্গে। চাইলে বন্ধুত্বও করতে পারবে তার সঙ্গে। ’
‘বাহ্! মজা তো!’
‘মজা  পেতে হলে পরিশ্রম করতে হবে। নিজের আত্মাকে শুদ্ধ করে নিতে হবে। কাজটা সহজ নয়, কঠিন। ’
বর্ণমালার গুমগুম উচ্চারণে বাংলা ধ্বনি বেরিয়ে আসছে। তাই সাহস আরো বেড়ে গেল, ভীতও হলো। ভীতি নিয়ে মেসি আবার প্রশ্ন করল ‘আত্ম কী? যা চিনি না, দেখি না তা কীভাবে ধুয়ে নেব? কী ভাবে পরিশুদ্ধ করব?’
‘আত্মা হলো তোমার চালিকাশক্তি, তোমাকে শাসন করে, তোমার পুরো সত্তার কতৃত্ব তোমার আত্মারই হাতে। ’
mohit_01
‘বড় কঠিন লাগছে তোমার কথা। আরেকটু সহজ করে বুঝিয়ে বলো। বুঝতেই তো পারছ, মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ি আমি। এত কঠিন কথা বুঝব কীভাবে?’
“তোমাদের হাদিসে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় শরীরে গোশতের এমন এক টুকরা আছে যা সংশোধিত হলে; সমস্ত অঙ্গ সংশোধিত, আর নষ্ট হলে সমূহ অঙ্গ নষ্ট। সাবধান। সেই টুকরা হলো কলব বা অন্তর’। ”
‘এটা কি আমার চিন্তাশক্তি, মস্তিষ্ক?’
“নিঃসন্দেহে ‘আত্মা’ চিন্তাশক্তি ও মস্তিষ্কের ওপরও বিজয়ী। ”
‘না। এখনো বুঝতে পারছি না। নিজের আত্মটাকে ধরতে পারছি না, শুদ্ধ করার পথও খুঁজে পাচ্ছি না তোমার কথা থেকে। ’ বলল মেসি।
‘তোমার বিভিন্ন অবস্থা নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ করে তোমার আত্মা, তোমার অনুভূতিশীল অঙ্গসমূহ তখনই স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, যখন আত্মাই সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। ’

‘আমার অনুভূতিশীল অঙ্গসমূহ কি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়? আমি কি দেখতে পাচ্ছি না? তোমাকে অনুভব করতে পারছি না?’
“পারছ। ‘কারণ চোখ অন্ধ হয় না, বুকের খাঁচায় লুকানো অন্তরই অন্ধ হয়’। ”
‘তো, কীভাবে দূর করব অন্তরের অন্ধত্ব?’
‘সত্যকে দেখো, দেখার মতো করে দেখো, সত্যের অনুভূতি জাগাও নিজের ভেতর, সত্যের চাহিদা পূরণ করতে শেখো, চারিত্রিক পতন ঠেকাও, আধ্যাতিœক অধঃপতন দূর করো, মন-মস্তিস্কের কুপ্রবৃত্তি শাসন করে আলোর দিকে তাকাও, শুদ্ধ হয়ে যাবে মন। ’
‘কাজটা তো সহজ নয়। কঠিন মনে হচ্ছে। কিছু কিছু কুপ্রবৃত্তিতে তো, কু কিনা জানি না, নিজে নিজে জেগে ওঠে দেহের ভেতর। ভীষণ কষ্ট হয়, নিজেকে অপরাধী মনে হয় তখন । ’
বইয়ের ভেতর লুকিয়ে থাকা দৃশ্যমান ও অদৃশ্য অসংখ্য বর্ণমালা কিঁচিরমিচির শব্দ তুলে হেসে ওঠল। জোরালো ভাবে বলতে লাগল, ‘নিজেকে আবিষ্কার করতে পারছ, নিজের কুপ্রবৃত্তি ও দোষত্রুটি ধরতে পারছ, আত্মা সংশোধনের প্রথম ধাপই হচ্ছে নিজের ঘাটতি ও দোষ ধরা। তুমি শুদ্ধির পথে এগিয়ে গেছ, আরো এগোতে থাকবে নিশ্চয়। তোমার নিয়ন্ত্রণভার নিশ্চয়ই থাকবে তোমার হাতে। তুমি কথা বলো হুসোর সঙ্গে, জবাব পেয়ে যাবে। ’
বর্ণমালার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর শুনে আন্দোলিত হল বুক, ঢেউ ওঠল মনে। পাঁজরের হাড় প্রসারিত হলো প্রায় পাঁচ ইঞ্চি। সাহস নিয়ে বইটির লেখককে প্রশ্ন করল, ‘তোমার পুরো নাম কি, বলবে লেখকবন্ধু?’

‘হা হা হা। তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে পারছ। প্রথমে অভিনন্দন তোমাকে। তারপর শোনো আমার পুরো নাম আর্সেন হুসো। সবাই হুসো বলে ডাকে। ’
‘বর্ণমালার ভেতর তুমি ঢুকে গেলে কীভাবে? কীভাবে আশ্রয় নিলে বইয়ের পাতায়?’
‘অন্তর দিয়ে বইটি লিখেছি আমি। তাই আমার অন্তর লুফে নিয়েছে প্রতিটি বর্ণমালা। তারাই কথা বলেছে তোমার সঙ্গে। আমার মোড়ক খুলে দিয়েছে তারা। বর্ণের আঁচড়েই টের পাবে বইয়ের পাতায় আমার অস্তিত্ব। ’
আদর করে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিল মেসি বর্ণমালার শরীর। স্পর্শ করা যায় না কালির আঁচড়। তবুও স্পষ্টই অনুভবে ধরা পড়ছে বর্ণমালার úরশ। মুগ্ধ হয়ে মেসি প্রশ্ন করল, ‘তোমাকে তো কিশোরবয়সী মনে হচ্ছে। আমার বয়সী কেউ ছেলে কীভাবে এত বড় বইটা লিখল?’

লেখকেরা বুড়ো হয় না। তাদের মন থাকে কিশোর-তরুণের মতো। তুমি কিশোর মন দিয়ে ছুঁয়েছ। তাই আমাকে কিশোরবয়সী মনে হয়েছে।   কেউ বুড়ো বয়সে ছুঁলে বুড়োই ভাববে আমাকে। ’
‘তো, তোমার জন্ম কবে?’

‘জন্ম ১৮১৫ সালে। আর মৃত্যু ১৮৯৬ সালে। ’
‘তুমি মৃত্যুবরণ করেছ? তাহলে কথা বলছ কীভাবে?’
‘হ্যা। একাশি বছর বয়সে মরে গেছি আমি। তবে আমার আত্মা আটকে আছে বইয়ের প্রতিটি বর্ণমালায়। ’
মেসি বলল, ‘মজা তো। আমিও তাহলে তোমার মতো লেখক হবো। ’
‘লেখালেখির জগতে তোমাকে স্বাগত জানাই। ’
‘তোমাকে ধন্যবাদ, হুসো। এখন বলো, লেখক হওয়ার যোগ্যতা কী আছে আমার?’

‘যোগ্যতা তৈরি করে নিতে হয়। লেখক ও লেখা রচনার প্রতি আগ্রহই তোমাকে গড়ে তুলবে শক্তিমান কথাশিল্পী হিসেবে, বুঝতে পারছি। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা সোনার মোহর বসিয়ে দেবে তোমার অন্তরেও। ’
‘কীভাবে আমার অন্তরে বসবে সেই সোনার মোহর? আর বাংলাই বা তুমি কথা বলছ কীভাবে? তোমার বাড়ি কোথায়?’
‘লেখকরা কাল অতিক্রম করে বেঁচে থাকতে পারেন, সময়কে জয় করতে পারেন। কাল আর সময় ডিঙ্গিয়ে তারা হয়ে যেতে পারেন পৃথিবীর সবার, সব ভাষাভাষি মানুষের। এই যে, এখন আমি হয়ে গেছি তোমার। অথচ দেখো, আমার বাড়ি ফরাসি দেশে। ’

‘তোমার কথা শুনতে ভালো লাগছে। ’ বলতে বলতে বইটা বন্ধ করল মেসি। আদর দিয়ে মুছতে লাগল বইয়ের কাভার। হঠাৎ আবিষ্কার করল  মোড়কে স্পর্শ পাচ্ছে ছোট ছোট ছিদ্র। মনোযোগ দিয়ে দেখতে গিয়ে মনে প্রশ্ন এলো মোড়কটি কি চামড়া দিয়ে তৈরি? কীসের চামড়া? ভেড়া, ছাগল, গরু, হরিণ কিংবা মহিষের চামড়া?

আকষ্মিক কথার স্ফূরণ ঘটল বইয়ের নামলিপি ‘আত্মার নিয়তি’ থেকে।
বুরবুর করে উত্তর বেরিয়ে এল, ‘তুমি যা ভাবচ্ছ তা সঠিক নয়। মানুষের চামড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই বইয়ের প্রচ্ছদ। ’
‘বলো কি, হুসো কি এত নিষ্ঠুর! মানুষের চামড়া দিয়ে তৈরি করতে পারল বইয়ের প্রচ্ছদ!’

“পেরেছেন। ফিঙ্গার প্রিন্ট খুঁজে পাবে। ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাসে দেখার চেষ্টা করলে দেখতে পাবে আসল সত্য। আর হুসো নিজেই বলেছিলেন, ’বইটি মানুষের আত্মা সম্পর্কে লেখা, তার মোড়ক মানুষের চামড়া দিয়েই তৈরি হওয়া উচিত’। ”

নামলিপি থেকে বেরোনো প্রতিটি শব্দকে তার আসল শব্দ মনে হলো না। ভয়ের কাঁপন উঠল বুকে। এদিক ওদিক  তাকিয়ে আরো ভীত হয়ে তাকাল খোলা জানালা দিয়ে বাইরে। সে বসে বসে দেখছিল কচি রোদ, কাঁচা সোনা রোদ মানেই তো ভোর। অথচ এখন মনে হচ্ছে ভোর নয় রাত হয়ে গেছে। বাইরে রাতের ঝিঁঝিঁ পোকারা নীরব ঘরের মধ্যে সহস্রকোটি ঝিঁঝিঁ শব্দ ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে রাত ঘনিয়ে আসার কথা। দুঃস্বপ্ন নয় তো? ভোর কীভাবে রাত হয়ে যায় মুহুর্তের মধ্যে! বইয়ের মধ্যে লুকোনো কোনো জাদুশক্তি বলে এমনটি ঘটছে না তো? হুসো এত নিষ্ঠুর মানব হলো কীভাবে? যে লিখে বর্ণের মধ্যে চালান করে দিতে পারে নিজের আত্মার স্বর সে কীভাবে ভূত হয়? পাষণ্ড হয়?
ঠাস ঠাস শব্দ হলো জানালায়। কে ধাক্কাচ্ছে? বাইরে তো বাতাস নেই। এ রকম অদ্ভুত আওয়াজ তো সে শোনেনি কখনো। অশরীরি ভূত-প্রেত নয় তো? হাতে কাঁপন ওঠল। বুকে চাপ বোধ হতে লাগল যেন আশি হাজার মন ওজনের বস্তা ঠেসে ধরেছে পাঁজরের হাড়।
mohit_02
বদ্ধ বইয়ের ভেতর থেকে আবার হুম হুম শব্দ বেরোতে লাগল- ‘ভয় পেয়ো না, মেসি। বইয়ের বর্ণমালাগুলো আমার আত্মার কোটি কোটি বিন্দুকণা, অনেকটা ঝিঁঝিঁর ডাকের মতো ছড়িয়ে পড়ছে তোমার চার পাশে। সেই দাপটে ভোরের কঁচা সোনা রোদের বদলায় তোমার চোখের আলো পালিয়ে গেছে, আঁধারে ঢেকে গেছে তোমার চারপাশ। ’
‘তো, এখন কি ভোরই। সূর্য উঠছে?’

‘হ্যা। ভোরই। চোখ খুলে তাকাও বইয়ের  মোড়কের দিকে। হাত রাখো আমার শরীরে। আসল আমাকে উপলব্ধি করো, আর আমাকে নিয়ে যে ভুল ধারণা করেছ- পাষন্ড আর নির্মম ভেবেছ, ভাবনাগুলো ছুড়ে দাও জানালা দিয়ে বাইরে। ম্যাজিক দেখতে পাবে তখন। ’

হ্যা। ম্যাজিকই। চোখের আলো আবার ফিরে এল। আবার চারপাশ দেখতে পেল। জানালা দিয়ে কাঁচা সোনা রোদের ঝিলিক দেখল সবুজ গাছ-গাছালিতে। আর ভাবতে লাগল হুসো পাষণ্ড নয়, নিষ্ঠুর নয়। নিশ্চয় সে ক্ষমতাধর মহান এক কিশোর।

হা। হা। হা। হঠাৎ হাসির শব্দ কালবোশাখের ঝড়ের মতো মাতম তুলল। হাসির দাপট কমে যাওয়ার পর এবার ভেসে এলো মিহি কন্ঠস্বর- ‘আমি কিশোর নয়, কিশোরী। ’

‘তাই! কিশোরী! আমার বান্ধবী হবে?’
‘হ্যা। হতে পারি। তবে গার্লফ্রেন্ড হতে পারব না। আগে থেকে জেনে রাখা ভালো। ’
‘চট করে মনটা খারাপ হয়ে গেল মেসির। আঁধার নেমে এল মুখে, কন্ঠস্বরও চাপা খেতে লাগল অচেনা কষ্টের খামছি খেয়ে। ’
‘মন বড় করে শোনো, আমার এক বয়ফ্রেন্ড আছে আমার সঙ্গে। তার নাম লুডো। আমি তাকে লুডু বলে ডাকি। সে আমাকে ডাকে হুলু বলে। লুডু আর হুলুর সম্পর্কটাকে সম্মান করবে না? অন্যের সম্পর্কটাকে সম্মান জানানো বড় মনের ব্যাপার। নিজের আবেগের চাহিদা সামাল দিয়ে অন্যকে অভিবাদন জানাতে পারলে মানুষের কষ্ট কমে যায়। সুখী হয় মানুষ। ’
‘না। আমি লুডুকে সম্মান করব না। ’

কর্কশ শব্দের বাজ ফাটল এবার, কঠিন কঠিন শব্দ বেরোতে লাগল বইয়ের কাভার থেকে- ‘আমাকে সম্মান না করে উপায় আছে তোমার? আমি হচ্ছি হুসোর বয়ফ্রেন্ড ডা. লুডোভিক বুল্যান্ড। মানুষের ত্বক দিয়ে বইটির প্রচ্ছদ তৈরি করে দিয়েছি আমি। বইটা হুসো উপহার হিসেবে দিয়েছিল আমাকে । তাই তো এত বছর পরও সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে বইটি পৌছেছে তোমার হাতে। আমার প্রতি কি তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত নয়? আমাকে সম্মান না করলে লোকে তোমাকে অকৃজ্ঞ ভাববে না?’

‘ওঃ! তাহলে আসল পাষন্ড তুমি, হুসো নয়। তুমিই জ্যান্ত মানুষের ত্বক খুলে বাঁধিয়েছ বইয়ের প্রচ্ছদ!’
‘না। না। ভুল বুঝছ তুমি। জ্যান্ড মানুষ নয়, আমার এক মৃত রোগীর ত্বক খুলে বানিয়েছিলাম...। ’

‘থামো। তোমার কথা শুনতে চাই না, নির্মম-নিষ্ঠুর-পাষন্ড মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাই না আমি। ’

“ত্বক পরীক্ষার কৌশল ‘পেপটাই মাস ফিঙ্গারপ্রিন্ট’ পদ্ধতিতে যাচাই করে দেখো, প্রমাণ পাবে জীবত নয়, মৃত মানুষের ত্বকই ব্যবহার করেছি আমি। ”
‘হোক মৃত। তবুও তুমি নিষ্ঠুর। তোমার সঙ্গে কোনো কথা নেই। ’
‘আমার দ্বারা বইটির সুরক্ষার কারণেই তো তুমি হাতে পেলে এটি, কৃতজ্ঞ না হয়ে অকৃতজ্ঞের মতো আমার সঙ্গেই কথা বন্ধ করতে চাও?’
‘শুধু কথা বন্ধ করতে চাই না, আমি চাই হুসো থেকে তিনশত মাইল দূরে সরে যাও। তুমি নির্মম অপরাধী। ’

‘তুমি কি জানো না ক্ষমা মহত্বের লক্ষণ? প্রশ্ন করলো লুডোভিক। ’
‘জানি। কিন্তু পাষ-কে ক্ষমা করা যায় না, সেটাও জানি। ’
‘আমি কেবল পাষ- নয়, হুসোর প্রেমিকও। ’  এবার কাতর হয়ে বলল লুডোভিক।
‘তোমার প্রেমের আড়ালে আছে নিষ্ঠুরতা, এমন নিষ্ঠুর অপরাধীকে ক্ষমা করতে পারি না আমি। ’

পুষ্পবৃষ্টি ঝরতে লাগল। হাজার হাজার লাল নীল পাপড়ি ঝরে পড়তে লাগল আকাশ থেকে। বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল মেসি। আর তখনই ঝমঝম বৃষ্টিপাতের মতো ছড়িয়ে যেতে লাগল হুসোর কথামালা- ‘তোমাকে অভিনন্দন, মেসি। ’

‘তোমার বয়ফ্রেন্ডকে মেনে  নেইনি, তবুও অভিভাদন জানাচ্ছ আমাকে?’
‘হ্যা। কারণ তুমি জয়ী হয়েছ তোমার বিবেকের কাছে। তোমার আত্মার মধ্যে বসে আছে সত্য আর সুন্দরের সোনা মোহর। নিষ্ঠুরতা আর অপরাধপ্রবণতা কোনো দিন স্থান পাবে না তোমার আত্মার কেন্দ্রে। এটাই সবচেয়ে বড় বিজয়। এই বিজয়কে অভিনন্দন না জানিয়ে কি পারি?’

‘তোমার লুডু ভেগে গেছে তো? তার কথা শুনছি না কেন?’
‘হ্যা। তোমার মনের জোর দেখে ভয়ে পালিয়েছে সে। এখন আমার আত্মার প্রতিটি ধ্বনি তোমার নিয়ন্ত্রণে। ‘
‘আমার বন্ধু হিসেবে তোমাকেও অভিনন্দন। ’

কোমল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আনন্দধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে মেসির অন্তর জুড়ে। বইয়ের পাতা ওলটাতে লাগল সে। মাথার ভেতর উড়তে লাগল নানা রঙের প্রজাপতি। আর তার ডানায় ভর করে মনে জমতে লাগল সাহস, আত্মবিশ্বাস। নিজের মস্তিস্ককে মনে হতে লাগল এক উর্বর ভূমি...।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।