ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

ইনকাদের গুপ্তধন

মঈনুল হক চৌধুরী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১৪
ইনকাদের গুপ্তধন

ইনকা সভ্যতা। এ এক প্রাচীন সভ্যতা।

বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, এই ইনকা সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো পুরোদস্তুর সোনার ওপর। ধারণা করা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সোনা রয়েছে ইউনাইটেড স্টেটস্ ব্যাংক অব আমেরিকার  অর্থ ভান্ডারে। কিন্তু ইনকাদের সোনার পরিমাণের সাথে তার কোনো তুলনাই চলে না। ইনকাদের মন্দির, মন্দিরের অভ্যন্তরের মূর্তি, সবই ছিলো খাঁটি সোনার তৈরি। স্বর্ণ সমৃদ্ধ ইনকাদের নিত্য ব্যবহার্য্য তৈজসপত্রও সোনার তৈরি ছিলো। তাই ইনকাদের সোনা নিয়ে প্রচুর গল্পও প্রচলিত আছে।

বিগত চারশত বছর ধরে পুরোতত্ত্ববিদ এবং স্বর্ণ সন্ধানীরা ইনকাদের গুপ্তধন খুঁজে বের করার জন্য বহু প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু প্রত্যেকবারই পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন তারা। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, পেরু এবং বলিভিয়ার মাঝামাঝি আন্দিজ পর্বতের শীর্ষে অবস্থিত এক হ্রদের গভীরে ইনকারা ডুবিয়ে রেখেছিলো তাদের সমস্ত সোনা। এমন বিশ্বাস বহু বছর ধরে প্রচলিত ছিলো। তাই অনেক ডুবুরি বছরের পর বছর ধরে ছেকে ফেলেছেন সেই হ্রদের বরফ পানি। কিন্তু ফলাফল সেই শূন্য।

বছর কয়েক আগে কয়েকজন বিজ্ঞানী ও পুরোতত্ত্ববিদ ইনকাদের গুপ্তধন রহস্যের জাল খুলতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের ভাষ্য, দশ বছর আগে পেরুতে খোঁড়াখুঁড়ির সময় হঠাৎ করেই ইনকাদের হারিয়ে যাওয়া সম্পদ সম্পর্কে আগ্রহ জন্মে তাদের মনে। এই বিষয়ে প্রচুর ঐতিহাসিক বইপত্তর পড়াশুনা করতে গিয়ে তারা বুঝতে পারলেন, দড়ির গেরোর মাধ্যমে লেখা ইনকাদের মেসেজ এর অর্থ উদ্ধার করতে পারলেই হয়তো তাদের গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া যাবে। লিখিত সংবাদাদি আদান-প্রদান পদ্ধতি ইনকারা জানতো না। ‘গিট’ পদ্ধতির মাধ্যমেই তারা এ কাজটি রপ্ত করেছিলো, শত শত বছরের অভ্যাসে।

তাদের এই যোগাযোগ পদ্ধতি ছিলো বড়োই অদ্ভুত। দড়ির সাহায্যে কাজটা করতো তারা। এই দড়িগুলোর নাম ছিলো কুইপো। একেবারে সাধারণ দড়ি। তবে ধারণা করা যায় ইনকাদের মধ্যে এমন একজন ব্যক্তি ছিলো, যে দড়ির বদলে সোনার সুতো ব্যবহার করতো। সেই ব্যক্তিটি হলো ইনকাদের শেষ সম্রাট আতাহু আল্পা। জেনারেল ফ্রান্সিসকো পিজারোর বন্দী থাকাকালীন ইনকা সম্রাট আতাহু আল্পা এই সোনার সুতো তৈরি করেছিলেন। সুতোটিতে গিট ছিলো মাত্র তেরোটি। সম্রাটের একজন সহকারী সেটা লুকিয়ে নিয়ে পালিয়ে থাকা সম্রাট পরিবারের হাতে তুলে দেয়। বন্দী থাকাকালীন ইনকা সম্রাট আতাহু আল্পা বুঝে গিয়েছিলেন, স্পেনীয় দস্যুরা তাকে জীবিত ছাড়বে না, যদিও প্রাণে মারা হবে না- এমন আশ্বাস তাকে দেওয়া হয়েছিলো।

কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। স্পেনীয় দস্যুরা তাকে হত্যা করেছিলো মর্মান্তিকভাবে। তাই মৃত্যুর পূর্বেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন সম্রাট আতাহু আল্পা। কোনো মতেই ওই লোভী দস্যুদের হাতে তুলে দেবেন না, ইনকাদের পবিত্র ধন। তেরো গিটের সোনার সুতোটিতে সমগ্র ইনকাদের জন্য তার নির্দেশ ছিলো- সব সোনা একত্র করে যেনো এলসিঞ্জির পদতলে সোপর্দ করা হয়। উল্লেখ্য, এলসিঞ্জি ছিলো একটি বিশাল আগ্নেয় পর্বত। ইনকারা এই পর্বতকে তাদের অগ্নিদেবতা রূপে মানতো। এলসিঞ্জি তার বজ্র গর্জনে আগুন উদগীরণ শুরু করলেই ইনকারা মাটিতে শুয়ে পড়ে অনবরত প্রার্থণা করতে থাকতো এলসিঞ্জির উদ্দেশ্যে।

এদিকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো সম্রাটের নির্দেশ। লাখ লাখ ইনকা তাদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লো। উত্তর কুইটো থেকে দক্ষিণ কাজকো পর্যন্ত, যেখানে যতো সোনা, সোনার মন্দির ছিলো, সব ভেঙে নিয়ে তারা রওনা হলো অগ্নিদেবতা এলসিঞ্জির পথে। গন্তব্যে পৌঁছে তারা সব সোনা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো, আগ্নেয়গিরির কেন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত দীর্ঘ ও প্রশস্ত সুরঙ্গে।

অলাম্বিয়া থেকে অলিভিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল ইনকা সাম্রাজ্যের এক গুপ্ত বন-পথ দিয়েই, ইনকারা এই স্বর্ণবহর নিয়ে গিয়েছিলো। স্পেনীয় লুটেরা ফ্রাস্সিকো পিজারোর হাত থেকে তাদের স্বর্ণ সম্পদ রক্ষার জন্যই ইনকারা এমন বেপোরোয়া কাজটি করেছিলো। এসব সোনার মধ্যে ছিলো মন্দিরের সোনার ইট, মূর্তি, ইনকা সম্রাট পরিবারের ব্যবহৃত হাজার হাজার সোনার থালা বাসন। দস্যুদের ভয়ে তারা সবই ফেলে দিয়েছিলো এলসিঞ্জির অগ্নিগহবরে।

সময়ের স্রোতে লাখ লাখ টন ছাই আর শুকনো পাতার আস্তরে এক সময় চাপা পড়ে গেলো সেই মহামূল্যবান সম্পদ। ইনকাদের বিশ্বাস ছিলো স্পেনীয় লুটেরারা একদিন চলে যাবে। ছাই আবর্জনার স্তুপ থেকে তারা আবার তুলে আনবে তাদের সমস্ত সোনা। আবার নতুন করে গড়ে তুলবে তাদের সভ্যতা। উল্লেখ না করলেই নয়, ইনকাদের গুপ্তধনের রহস্য উদঘাটনের জন্য বিশেষ অবদান ছিলো পেরুর একজন পুরোতত্ত্ববিদ ড. কাটওয়ার রাইটারের। যিনি চারশত বছরের পুরোনো ইনকাদের খোঁজে দীর্ঘ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। এতটুকু উপলব্ধি করেছিলেন, এক সাংঘাতিক বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়েছিলেন তিনি। দানবাকার কুমিরে ভরা অসংখ্য নদী তাকে পেরুতে হয়েছিলো। গহীন সব জঙ্গল পেরুবার সময় মানুষ খেকো মানুষের খপ্পরেও পড়েছিলেন তিনি।

ভয়ঙ্কর, অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক এই অভিযানে বহুবার তিনি মৃত্যুর একেবারে দ্বারগোড়া থেকে ফিরে এসেছিলেন। ইনকাদের গুপ্তধনের একেবারে দ্বারগোড়ায় এসেও সমস্ত আশা ত্যাগ করে ফিরতে হয়েছিলো ডা. কাটওয়ান রাইটারকে, কেননা যেখানে তিনি পৌঁছেছিলেন, সেটি ছিলো ইনকাদের অগ্নিদেবতা এলসিঞ্জির জ্বালামুখ। ওটার দিকে তার তাকিয়ে মনে হয়েছিলো যেনো বিশাল জলন্ত এক কড়াই ওত পেতে বসে আছে। কেউ কাছে যাবার সাহস দেখালেই পুড়িয়ে মারবে তাকে। তাই ইনকাদের গুপ্তধনের সন্ধানে এলসিঞ্জির  কাছে যেতে কেউ উদ্যোগ নিলেও পর মুহূর্তে পিছপা হয়ে যান তারা। কেননা অগ্নিদেবতা এলসিঞ্জি যেনো পরম যত্নে পাহারা দিয়ে রেখেছেন ইনকাদের গুপ্তধন। হয়তো চিরকালই তা পাহারা দিয়ে যাবেন।

লেখক: মঈনুল হক চৌধুরী / সম্পাদক, কিশোর সাময়িকী, ছড়া সাময়িকী ও ঢাকা সাময়িকী



বাংলাদেশ সময়: ১৭০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।