ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

জলপরি নীলাক্ষী | নাজিয়া ফেরদৌস

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৫
জলপরি নীলাক্ষী | নাজিয়া ফেরদৌস

লাল, সোনালি, হলুদ মাছে ঝকমক করছে অ্যাকুরিয়ামটা। প্রধান আকর্ষণ একটি নীল রঙের মাছ।

মিশুর খুব প্রিয় জিনিসটা। রাত বাড়লেই এটা থেকে অদ্ভুত আলো বের হয়, যা মিশু ছাড়া কেউ জানে না। মিশুদের বাড়িটা অনেক বড়, কিন্তু থাকার মানুষ খুব কম। এত্ত বড় বাড়িতে মিশু সারাদিন একাই থাকে।

স্কুল থেকে এসে কিছু খেয়েই সে অ্যাকুরিয়ামটা নিয়ে খেলতে বসে। বাড়ির বাইরে যাওয়া ওর নিষেধ। রাতে মা অফিস থেকে ফিরে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যান কিন্তু মিশুর ঘুম হয় না। শুধু মন ছুটে যায় অ্যাকুরিয়ামটার দিকে। রঙিন নীল মাছটা ওকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে।

একদিন বিকেলে গেলাম ওদের বাসায়। মিশু খেলছিল মাছগুলোর সঙ্গে। আমি যেতেই ও উঠে চলে গেলো। আমাকে ও কেন যেন মোটেই পছন্দ করে না। আসলে ও কাউকেই আজকাল পছন্দ করছে না। যাই হোক, সেদিন বাধ্য হয়েই ওকে আমার সঙ্গে ঘুমাতে হলো। রাত তখন অনেক। হঠাৎ দেখি মিশু নেই। একটু অবাক হলাম। পাশের ঘর থেকে একটা হালকা নীল আলো আসছিল। কী মনে করে আমি উঠে চলে এলাম দরজার কাছে। চুপি চুপি এগিয়ে গেলাম। যা দেখলাম তাতে নিজের চোখকেই বিশ্বাস হলো না।

মিশু অ্যাকুরিয়ামের ঢাকনা খুলে দিয়ে হাতটা পানিতে ডুবিয়ে রেখেছে। তার হাতে একটা ছোট্ট মেয়ে বসে আছে। মেয়েটার শরীরের নিচের অংশটা পুরো মাছের লেজের মতো। বুঝতে বাকি রইলো না ওটা জলপরি। পরিটার শরীর থেকেই নীল আলোটা বের হচ্ছিলো। মিশু আর পরিটা কিছু কথা বলছিলো আর কাঁদছিলো। আমি যে কোন সময় ওদের কাছে চলে এসেছি খেয়াল করেনি।

হঠাৎ আমাকে দেখে মিশু চমকে উঠলো, ওর চেয়ে বেশি ভয় পেল পরিটা। টুপ করে অ্যাকুরিয়ামে ডুব দিয়ে মাছগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে গেলো। আমি মিশুকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমি কাউকে কিছু বলবো না। কিন্তু ও আরও বেশি করে কাঁদতে শুরু করে দিলো। অনেকক্ষণ পরে বললো, ‘আর কয়েকদিন এখানে থাকলেই পরি মারা যাবে। ওকে এখান থেকে নদীতে নিয়ে যাওয়া খুব দরকার। ’
পরি এখানে কী করে এলো জানতে চাইলে মিশু বললো, আমার জন্মদিনে বাবা যে মাছগুলো এনেছিলো তার মধ্যে একটা নীল মাছও ছিলো। ওই মাছটাই আসলে পরি। জলপরি নীলাক্ষী। বাবা মায়ের কথা না শুনে একা একাই সে পানিতে ঘুরতে বেরিয়েছিলো। বাড়ি থেকে অনেক দূরে মানুষের এলাকায় চলে আসায় ওকে ধরে ফেললো জেলেরা। অনেক সুন্দর দেখে তারা পরিকে না মেরে বাজারে বিক্রি করে দিলো।

অনেক দিন হয়ে গেছে। বেশিদিন ওরা বদ্ধ পানিতে থাকতে পারে না, গায়ে পোকা হয়। এখানে থাকলে ও আর বড় হতে পারবে না, মরে যাবে।
বলেই মিশু কাঁদতে শুরু করলো। আমি ওকে কথা দিলাম কালই জলপরিকে নদীতে রেখে আসবো। আমার কথায় ও শান্ত হলো কিন্তু খুশি হতে পারলো না। পরদিন দুপুরে আমি একটা জারে করে নীল মাছটা নিয়ে চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীর কাছে গেলাম। ভেতর থেকে পরি আমাকে ইশারা করলো। আমি তাকে পানিতে ছেড়ে দিতেই সে বড় হয়ে গেলো আর সুন্দর একটা বড় জলপরিতে পরিণত হলো।

দেখলাম ওর চোখগুলো অনেক বড় বড় আর চোখের মনিটা গাঢ় নীল রঙের। সে আমাকে অনেক ধন্যবাদ জানালো। বললো, তুমি আমার জীবন বাঁচালে। আমি এখন অনেক কিছু বুঝেছি। আজ থেকে আমি কখনোই বাবা মায়ের অবাধ্য হবো না। চলো তোমাকে আমার দেশ ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। বলেই সে আমার হাত ধরে নদীতে ডুব দিলো।

কী যে সুন্দর জলপরির দেশ! কত্ত কত্ত রঙের যে মাছ! আর ওদের বাড়িগুলো ঝিনুকের খোলস দিয়ে তৈরি করা। খুবই সুন্দর! জলপরিকে দেখে তার দেশের সবাই খুব খুশি হলো। তারা আমাকে অনেক কিছু খাওয়ালো যা আমি কোনোদিনও খাইনি। যাওয়ার আগে জলপরি মিশুর জন্য অনেক উপহারও দিয়ে দিলো। বলে দিলো প্রতি মঙ্গলবার দুপুরে এই নদীর তীরে দাঁড়িয়ে জলপরি নীলাক্ষী বলে ডাকলেই সে চলে আসবে। আমিও খুশি হয়ে বাসায় এলাম। মিশুকে উপহারগুলো দিলাম। জলপরির জন্য ওর মন খারাপ ছিলো এবার ও খুশি হলো। আমাকে অনেক আদর করলো। বললো, তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।


সন্ধ্যায় মিশুর মা মানে আমার আন্টি বললেন, নীল একটা মাছ ছিলো না এখানে? কোথায় গেলো? মরে গেছে নাকি? আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। এমন ভাব যেন কিছুই জানি না। মিশু শুধু আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। আমি মনে মনে বললাম Ñ নিশ্চই জলপরি এখন তার বন্ধুদের সাথে মজা করে সাঁতার কাটছে। কারো উপকার করার মজাই আলাদা।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৫
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।