ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

জাদুর তুলি | এহসান হায়দার

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৬
জাদুর তুলি | এহসান হায়দার

এক.
গ্রামটির  নাম গড়খালি। এই গ্রামের পাশ দিয়ে কলকল করে বয়ে যাচ্ছে শিবসা নদী।

নদীর বিশাল চর। যার কথা বলব বা বলা শুরু করেছি সে বাস করতো তার বাবা-মায়ের সঙ্গে। থাকতো এই চরেই। হঠাৎ একদিন বেচারির মা-টা  হারিয়ে গেলো চাঁদের দেশে। যখন এ গাঁয়ে মানুষের আনাগোনা ছিল এক্কেবারেই কম, দু’একজন জেলে আসতো মাছ ধরতে, আর বাড়ি ফেরার সময় নিয়ে যেত নানান ধরনের মাছে ভরা ঝুড়ি।

মেয়েটা সেই মাছ ধরা মানুষদের কাছ থেকে মাছ নিতো তার কৃষক বাবার জন্য। তারা ছিল খুব গরিব। একবেলার ভাত জুটলে আর একবেলা জুটতো না। এভাবেই বাবা মেয়ের সংসার চলে যাচ্ছিল। এই গাঁয়ে ছিল এক লোভী আর  রাগী জমিদার। প্রচুর টাকা আর জমি থাকতেও তার শুধু চাই চাই আর চাই।

জমি বর্গা দিতো কৃষকদের আর ভাগের বেলায় তাদের ঠকাতো। সোনা সে খুব ভালোবাসতো। এই ছোট্ট মেয়ের বাবাও তার জমি চাষ করতো, কিন্তু ভাগের বেলায় এতটাই কম দিতো যে দু’জনের সংসারে সেই ধানে কুলাতো না। মেয়েটা স্কুলে যেতেও পারতো না। ভালো ছবি আঁকতে জানতো কিন্তু কোনো তুলি ছিল না। তুলি থাকবে কি করে! তার বাবার তো অত টাকা নেই যে মেয়েকে পড়াবে। তাই মেয়েটা রোজ চরে গিয়ে একা একা বালির মধ্যে পাখি আঁকতো, ফুল আঁকতো, মাছ আঁকতো আর আঁকতো আকাশ।

কিন্তু আকাশ-ফুল-পাখি আর মাছ আঁকলে কি হবে, সুন্দর এ ছবিগুলোর তো রং করা চাই। রং সে কোথায় পাবে? এই ভেবে সে আর আঁকতো না, আবার বাড়িতে ফিরে আসতো। বাবাকে কিচ্ছুটি বলতো না। এভাবে তার খুব কষ্ট হতো। কোনো খেলার জিনিসও ছিল না যে তা দিয়ে খেলবে। ভাবতো যদি তার তুলি থাকতো, রং থাকতো- তবে সে কেবলই আঁকতো। ছবির মতো সুন্দর এক গ্রাম আঁকতো। রুপালি রোদ আঁকতো, পরি আঁকতো, আঁকতে আঁকতে তার সব সময় বয়ে যেত।

দুই.
এক রাতে ছোট্ট মেয়েটির একটি অবাক করা ঘটনা ঘটালো। রাতে ঘুমিয়ে দেখলো একজন দরবেশ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। মিটিমিটি করে হাসছে আর তার হাতে ধরে আছে একটি ছোট্ট তুলি।
মেয়েটি বললো- কে তুমি?
দরবেশ হেসে বললেন- আমি দরবেশ ফকির মানুষ।
মেয়েটি বললো- তুমি এখানে কেন এসেছো?
দরবেশ হেসে উত্তর দিলেন, এই জাদুর তুলি তোমাকে দিতে এসেছি।
মেয়েটি বললো- আমি তো তোমার কাছে তুলি চাইনি। দরবেশ তখন হাসতে হাসতে বললেন, এটা চাইতে হয় না, যার দরকার তার কাছে আমি নিজেই দিয়ে যাই। তোমার দরকার ছিল তাই দিতে এলাম। এই তুলি এমন এক আজব জাদুর তুলি যে তুমি যা আঁকবে তা বাস্তব হয়ে যাবে। এই যেমন ধরো তুমি একটা হলদে পাখি আঁকলে ওমনি দেখবে পাখিটি উড়াল দিলো। আবার ধরো তোমার খুব ক্ষুধা লাগলো কিন্তু হাতের কাছে খাবার কিচ্ছু নেই, তখন তুমি টুপ করে এঁকে নিলে বড় এক টুকরো ভাজা মাছ আর এঁকে নিলে ধোঁয়া ওঠা আতপ চালের ভাত তারপর মন ভরে খেয়ে নাও।

তবে শোনো, এটা কখনও কোনো ভুল কাজে ব্যবহার কোরো না, তাহলে আর কখনো কাজ হবে না। জাদুও ফুরিয়ে যাবে। ছোট্ট মেয়েটি অবাক হয়ে গেলো দরবেশের এসব কথা শুনে। দরবেশ কথা শেষে জাদুর সেই আজব তুলি মেয়েটির হাতে দিলেন। তারপর মেয়েটি গেলো জেগে আর খুঁজতে লাগলো সেই লম্বা দাঁড়িওয়ালা ফকিরকে। কিন্তু তাকে কোথাও পেলো না।

হঠাৎ তার মনে পড়লো তার সেই তুলির কথা। তাকিয়ে দেখলো তার সেই স্বপ্নে পাওয়া তুলিটি আছে। এরপর তুলি হাতে নিয়ে মেয়েটি আঁকতে লাগলো, দরবেশের কথা মতো প্রথমেই আঁকলো সে হলদে পাখি- তারপর কি হলো পাখিটা আঁকা শেষ অমনি ছোট্ট পাখিটা ডানা ঝাপটে ফুড়–ত করে উড়ে পালালো। আনন্দের সীমা রইলো না তার। না খেয়ে ঘুমিয়েছিল মেয়েটি। তার বাবা জমিদারের বাড়িতে কাজ করছিল বলে রাতে বাড়িতে ফেরেনি। আর মেয়েটির এতক্ষণ মনেও ছিল না যে  তাকে খেতে হবে। তবু খাবারের কথা যখন মনে  হলো তখন তার মনে হলো সে কি খাবে বাবা তো কিছুই আনেনি। তখন সে দরবেশের দেওয়া তুলি হাতে নিয়ে আঁকলো গরম ভাজা ইলিশ, শিবসা নদীর গভীর পানিতে যে ইলিশ বেড়ায় আর থালা ভরা গরম ভাত। পরম আনন্দে ভাত-মাছ খেয়ে নিলো মেয়েটি। পাড়ার এক বউ ওর এই ছবি আঁকার দৃশ্য দেখলো তারপর গাঁয়ে মেয়েটিকে নিয়ে পড়ে গেলো উল্লাসের বন্যা।

সবাই দল বেঁধে আসছে ছবি আঁকা দেখতে। মেয়েটি সবাইকে ফল এঁকে এঁকে দেখায় আর ফলগুলো ছবি থেকে বাস্তব হয়ে যায়। মজা করে সবাই তা আবার খায়। এই খবর পৌঁছে গেলো জমিদারের কানে। জমিদার তার লাঠিয়াল বাহিনী আর লোক লস্কর দিয়ে ডেকে পাঠালো মেয়েটির বাবা ও মেয়েটিকে। অগত্যা কী আর করা! তারা জমিদার বাড়িতে গেলো।

জমিদার তাদের দেখে বললো- কৃষক তোমার মেয়ে যে ছবি আঁকে তা সব শুনলাম বাস্তব হয়ে যায়। দেখি তুমি কেমন আঁকো। এরপর কৃষকের ছোট্ট মেয়েটি একটা আপেল এঁকে জমিদারকে ছবিটা দিলো। আর জমিদার হাতে নিতেই তা বাস্তবের আপেল হয়ে গেল। ছবি বাস্তব হতে দেখে জমিদারের চোখ রীতিমতো ছানাবড়া!

জমিদার খুশি হয়ে কৃষককে বললো, ভরদুপুর হয়ে গেছে এখন থেকে যাও। দুপুরে খেয়ে দেয়ে তবেই তোমরা যেও। জমিদারের একথা শুনে গরিব কৃষক রীতিমতো অবাক হলো। লোভী জমিদারে কথায় মেয়েটি ভাবনায় পড়ে গেলো। এদিকে জমিদার ভেতরে দুষ্টবুদ্ধি আঁটতে থাকলো। কীভাবে অনেক সোনার ছবি এঁকে নেওয়া যায়। মেয়েটা ছবি আঁকবে আর সোনা হয়ে যাবে। শত শত মণ সোনার মালিক হবে। লোভী জমিদারতো লোভ সামলাতে পারে না।


তিন.
দুপুরে খাওয়া শেষে যখন কৃষক আর তার মেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলো জমিদার তখন তার নায়েবকে নিয়ে হাজির হলো সেখানে। বললো- কৃষক তোমার মেয়েকে সোনার ছবি আঁকতে বলো। আমার প্রচুর সোনা দরকার। সোনা আমি খুব পছন্দ করি। মেয়েটি তখন বুঝতে পারলো, লোভী জমিদার দুপুরে খাওয়ার কথা আসলে এ জন্যই বলেছিল।

জমিদারের কথা শুনে মেয়েটি বললো, অন্যায় কাজ আমি করবো না। আমি ছবি এঁকে কেবল মানুষের উপকার করতে চাই। আপনাকে যদি আমি সোনার ছবি এঁকে দিই তবে আমার পাপ হবে। আমি এই ছবি আঁকবো না। ছোট্ট মেয়েটির কথা শুনে জমিদার গেলো রেগে। সে বললো, এত বড় কথা আমার হুকুম মানবে না। তবে থাকো আমার বন্দি হয়ে।

লেঠেল বাহিনীকে ডেকে বললো, এদের বাপ-মেয়ে দু’জনকেই আটকে রাখ। যেদিন ওই মেয়ে ছবি আঁকতে রাজি হবে সেদিন ওরা ছাড়া পাবে। এরপর মেয়ে আর বাবাকে জমিদারের বিশাল পাঁচিল ঘেরা কয়েদখানায় আটকে রাখা হলো। দিনের আলো আস্তে আস্তে কমে আসতে থাকলো। রাত হয়ে গেলো। কিন্তু জমিদারের কেউ এসে খাবার দিলো না। ক্ষুধার জন্যে ছোট্ট মেয়েটি কাঁদতে লাগলো। রাতও বেশ গভীর। তখন মেয়েটির হঠাৎ মনে হলো তাইতো আমি কাঁদবো কেন? আমার তো তুলি আছে। ব্যাগ থেকে তুলি নিয়ে মেয়েটি রুটি আর ভাজি আঁকলো তারপর খেয়ে নিলো বাবা আর মেয়েতে। এবার মেয়েটি আঁকলো একটা চাবি তারপর সেই চাবি দিয়ে খুলে ফেললো তালা। এরপর সে আর তার বাবা বের হয়ে এলো। জমিদারের বাড়ির বাইরে এসে মেয়েটি তারপর আঁকলো একটা বড় নৌকা। সেই নৌকায় করে মেয়েটি আর তার বাবা চলে গেলো অনেক দূরে। সেখানে গিয়ে সুখে বসবাস করতে লাগলো।


বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৬
এএ


বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।