ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

বিল্টু (পর্ব-১) | গৌতম দাশ

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪২ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১৭
বিল্টু (পর্ব-১) | গৌতম দাশ   বিল্টু

আকাশটা কত বিশাল। তবু কোনো অহংকার-গরিমা নেই। ধনী-গরিব সব সমান। সবাইকে এক নজরে দেখে। যার কোনো ঠাঁই নেই তারও একটা ঠাঁই আছে, সেটা খোলা আসমান।

বিল্টু আকাশের দিকে তাকিয়ে এসব আকাশ-কুসুম ভাবছে। আজ তার মনে খুব দুঃখ।

তাই মনের অজান্তেই মনের মধ্যে এসব চিন্তার উদয় হচ্ছে। তার মা খুব মেরেছে। কাগজ কুড়োতে যায়নি। মকু, রহিম, খাজাদের সঙ্গে কাবাডি খেলতে গিয়েছিল। বিল্টু কাবাডি খেলতে খুব পারে। তাই যেখানেই কাবাডি ম্যাচ হয় বিল্টুকে ছাড়া তারা খেলে না।

বিল্টু তাদের দলের সেরা খিলাড়ি। কিন্তু আজ জিততে পারেনি। বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলে ব্যথা পেয়েছে বিল্টু। তাই ভালো করে খেলতে পারেনি। খুপড়িতে আসার পর মাও মারল তাকে কাগজ কুড়োতে না গিয়ে খেলতে যাওয়ার অপরাধে। বিল্টু ভাত খাওয়ার কথা বলেছিল। মা লাঠি নিয়ে তেড়ে এলো। বলল, আয়! ভাত খাবি আয়!

বিল্টু এক দৌড়ে এই জামগাছটার নিচে এসে বসে পড়ল। তারপর অনেকক্ষণ খুব কাঁদলো। খেলতে যাওয়ার কারণে মা মেরেছে, এতে তার বিন্দুমাত্র কষ্ট লাগেনি। কষ্ট লেগেছে ভাত না দেওয়ায়। বিল্টু আর যাই হোক ভাত না খেয়ে থাকতে পারে না। ভাতের সঙ্গে আর কিছু থাক বা না থাক ভাত তার চাই-ই।

প্রতিদিন সকালে কাঁচা মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেতে তার খুব ভালো লাগে। প্রতিদিনই খায় তবু এটাই তার প্রিয় খাবার। পেটের ভিতরটা বড্ড মিচ-মিচ করছে তার। জানে তার মা কোনো এক সময় আসবে এখানে। তাকে নিয়ে যাবে। তারপর খেতে দেবে। এই অপেক্ষায় সে বসে আছে। মা মারলে সে এখানেই চলে আসে। তাই তার মা অন্য কোথাও না খুঁজে বরাবর এখানেই চলে আসে। এই জামগাছের ছায়া তার বড্ড ভালো লাগে।

বিল্টুর বয়স বার কি তের হবে। একটু কালো। বস্তিতে থাকে। বস্তির কাছেই একটা পাঠশালায় সে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিল। স্যারেরা বলতেন বিল্টু খুব ভালো ছাত্র। সে একদিন উন্নতি করবে। বছরখানেক হলো বিল্টু স্কুলে যায় না। দু’বছর হলো তার বাবা একটি মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। তারপর আর বেশিদিন পড়তে পারেনি। তার মা দিন-মজুরি করে কোনো রকমে পেটের ভাত জোগাড় করে। একদিন তার মা তাকে খুব মেরেছিল বেশি বেশি ভাত খায় বলে। রাগের মাথায় বিল্টুর বইগুলোও ছিঁড়ে ফেলে দেয় তার মা।  

সেইদিনও মার খাওয়ার কারণে সে কষ্ট পায়নি। কষ্ট পেয়েছিল বই ছেঁড়ার কারণে। এই গাছতলায় এসে সেদিনও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছিল সে। তার আশ্রয়ের একমাত্র স্থান এই গাছতলা। দুঃখ ভোলার স্থান এই গাছতলা। ওইদিন সে তার জীবনে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিল। কারণ সে তার বইগুলোকে খুব ভালোবাসতো। পরম যত্ন করতো তার বইগুলোকে।

বই ছিঁড়ে ফেলার পর একটা জেদ তার মনে জন্ম নিল। সে আর স্কুলে যাবে না। আর স্কুলে যাওয়া হয়নি তার। সেই থেকে সে বস্তির ছেলেদের সঙ্গে কাগজ কুড়োয়। মকু, রহিম, খাজা হয়ে গেল তার বন্ধু। তবু পড়ার প্রতি তার আকর্ষণ আজও প্রবল। কাগজে কি লেখা আছে বানান করে পড়ে দেখে সে। এখনও মাঝে মধ্যে তার ইচ্ছা করে স্কুলে যাওয়ার। আবার পরক্ষণে ভাবে এত খরচ কি করে দেবে তার মা। মা যে দিন-মজুর।

বস্তিতে থাকে। দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগাতেই কত কষ্ট হয় তার মায়ের। পড়াবে কি করে। সেও কাগজ কুড়িয়ে তেমন একটা আয় করতে পারে না। ইচ্ছেটা নিজের মধ্যেই ঢেকে রাখে বিল্টু। কখন যে তার মা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়ালই করেনি। তার মা বলল, কিছু বললেই এখানে এসে বসে থাকবি। আয় খাবি। খেয়ে কাগজ কুড়াতে যাবি মকুদের সঙ্গে। ওরা তো অপেক্ষা করছে।

বিল্টু উঠে দাঁড়ালো। সে তার মায়ের উপর কখনই রাগ করতে পারে না যতই তার মা তাকে মারুক আর কাটুক। মাকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে মা-ই যে তার একমাত্র আপনজন। মা বকলে, মারলে অভিমান হয় কিন্তু যখন তার মা আদর করে বুকে টেনে নেয় সব অভিমান তখন বিলীন হয়ে যায়। মায়ের পিছু পিছু বস্তিতে, তাদের ছোট্ট খুপড়িতে ফিরে গেল সে। পেট পুরে পান্তাভাত খেয়ে খাজা-মকুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল বিল্টু।

চলবে....

বাংলাদেশ সময়: ১৫২১ ঘণ্টা, জুলাই ০১, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।