ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

ঈদের জামা | হাসনা হেনা

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৩ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৮
ঈদের জামা | হাসনা হেনা প্রতীকী ছবি

এই তো ক'দিন পরেই ঈদ। সোহা আনন্দে আত্মহারা। এবারও দাদুবাড়ি যাবে ঈদ করতে। দাদুবাড়ির সবার জন্য নতুন জামা-কাপড় কেনা হয়েছে। মা ব্যাগ গোছাতে শুরু করেছেন। সোহা অধীর হয়ে দিন গুনছে। গ্রামে সবার সাথে ঈদ করতে সোহার খুব ভালো লাগে। দিদা-দাদুর কাছে গেলে তার শহরে ফিরতেই ইচ্ছে করে না। 

গ্রামের মুক্ত বাতাস, গাছপালা, নদী, সবুজ মাঠ সোহার খুব প্রিয়। চাঁদনী রাতে মাদুর পেতে উঠোনে বসে দিদা-দাদুর মুখে রূপকথার গল্প শুনতে দারুণ লাগে সোহার।

প্রতিবার গ্রামে এলেই চাচাতো-ফুফাতো ভাই-বোনেরা মিলে চড়ুইভাতির আয়োজন করে। দিদা অনেকগুলো হাঁস-মুরগি পোষেন। এই তো ক'দিন আগেই দিদা গ্রামের একজনকে দিয়ে বেশকিছু ডিম পাঠিয়েছেন সোহার জন্য।  

সোহার দাদুবাড়ির পাশের গ্রামেই সোহার নানুবাড়ি। ঈদের দু'দিন পর নানুবাড়ি যাবে সোহা। ওখানে নানু, মামা-মামি, মামাতো ভাই-বোনদের সাথে দু'দিন কাটাবে ওরা।  

ট্রেনের টিকেট নিয়ে এসেছেন বাবা। গ্রামে যাওয়ার আর দু'দিন বাকি। সোহার ঘুম উধাও। মামনিকে প্রশ্ন করে করে অস্থির করে ফেলছে কখন যাবো ...কখন যাবো? অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ভোরের ট্রেন ধরতে সেহরি খেয়ে বেরিয়ে পড়লো সোহা আর তার বাবা-মা। ট্রেন জার্নিটা খুব মজার। সোহা খুব ইনজয় করে। সোহার ট্রেনে উঠেই মনে পড়ে গেলো ট্রেন কবিতাটি- 

ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
          রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
         ট্রেনের বাড়ি কই?

মামনি এই কবিতাটি কার খেখা জানো তুমি?
আমার মনে নেই মা।
তোমার যা ভুলো মন! বাবা তুমি জানো ট্রেন কবিতাটি কার লেখা? 
বাবা চুপ করে আছেন হয়তো মনে নেই। তোমরা দুজনেই ভুলে বসে আছো দেখছি।
আমি বলি -
ট্রেন কবিতাটি লিখেছেন কবি শামসুর রাহমান।  
জেনেও প্রশ্ন করা সোহার একটা অদ্ভুত অভ্যাস।
বাবা খানিকক্ষণ হেসে বললেন তুমি তো গুড গার্ল তাই সব মনে রাখতে পারো মা।  

অনেকগুলো ছোট-বড় স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। দুপুর গড়িয়ে গেছে। একটি স্টেশনে এসে ট্রেনটা অদ্ভুতভাবে আওয়াজ করে কষে ব্রেক করলো। জানালার পাশেই একটা ছোট ছেলে মাথায় করে কলা বিক্রি করছে। সোহা খুব উৎসুক চোখে দেখছে। ছেলেটির জন্য মায়া হলো সোহার। আঙুল উঁচিয়ে বাবাকে দেখালো- বাবা দেখ দেখ কত ছোট্ট একটা ছেলে মাথায় করে কলা বিক্রি করছে! 

বাবা ছেলেটিকে কাছে ডাকলেন । ছেলেটি আসতেই শুরু হলো সোহার প্রশ্ন করা।  
তোমার নাম কী?
আমার নাম ফজলে রাব্বী, তয় সবাই ফজল বইলা ডাকে।  
তুমি তো অনেক ছোট, তাহলে কলা বিক্রি করছো যে?
কী করুম আফামণি ? বাবা নাই মা'র একার রোজগারে সংসার চলে না।  
আচ্ছা তুমি পড়াশোনা করো না?
ছেলেটি নিচু গলায় বললো না। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো সোহা। বাবা শুনছো ফজল না কি পড়াশোনা করে না। পড়াশোনা না করলে তো তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।  

ফজল তুমি ঈদের জন্য জামা কিনেছো ?
মৃদু হেসে ফজল বললো না। পেটের ভাত জোগাইতে পারি না আবার ঈদের জামা!

এবার আরও অবাক হলো সোহা । বাবাকে বললো বাবা ঈদের জামা কেনার জন্য ফজলকে কিছু টাকা দাও না। মেয়ের কাণ্ড দেখে বাবা একগাল হাসলেন আর পকেট থেকে দুশো টাকা বের করে ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন এ টাকা দিয়ে একটা জামা কিনে নিস। ফজল মাথা নেড়ে বলল.... আইচ্ছা। ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে । যতদূর দেখা যায় অদ্ভুত মায়া ভরা দৃষ্টি নিয়ে ছেলেটি তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে।

বিকেলের দিকে ট্রেন এসে থামলো দাদুবাড়ির কাছের স্টেশনে। ছোটচাচু ভ্যান নিয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করছিলো।

ট্রেন থেকে নেমে দৌড়ে চাচুর কাছে চলে গেলো সোহা। চাচুকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলো। মেঠোপথ ধরে ভ্যানগাড়ি যাচ্ছে । ছোটচাচুর সাথে জমে উঠেছে গল্প। সোহার উজ্জ্বল চকচকে মুখে আনন্দের বন্যা বইছে। ভ্যানচালক প্রচণ্ড গরমে ভ্যান চালাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে। সোহার খুব মায়া হলো ভ্যানচালককে এ'অবস্থায় দেখে ।  
ভ্যানচাচু আপনি রোজা রেখেছেন?
হ মা আমি রোজা রাখছি।  
রোজা রেখে ভ্যান চালাতে আপনার কষ্ট হয় না? 
তা একটু কষ্ট তো হইবোই।  
তাহলে ভ্যান চালান ক্যান ? 
মা আমরা তো খুব গরিব মানুষ, ভ্যান না চালালি খামু কী? 
সোহা এবার নির্বাক। আলোকিত মুখটা মুহূর্তেই ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। কী যেন ভাবনায় পড়ে গেলো সে। সোহার চুপ থাকা মানে অনেক নতুন প্রশ্নের জন্ম নেওয়া ।  

ভ্যানগাড়িটা সোহার দাদুবাড়ির দোরগোঁড়ায় এসে থামলো। বাবা ভাড়া মিটাতে ভ্যানওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন তোমাকে কত টাকা দিতে হবে?

ভ্যানওয়ালা একগাল হেসে বললেন দেন না ভাইজান আমি আর কী কমু। ভাড়া যদিও পঞ্চাশ টাকার বেশি হবে না, সোহার বাবা একশো টাকার একটা নোট ভ্যানওয়ালার হাতে ধরিয়ে দিলেন। মাঝখান থেকে সোহা বলে উঠলো বাবা ও বাবা ভ্যানচাচুকে আর একশো টাকা দিয়ে দাও না, উনার অনেক কষ্ট হয়েছে রোজা রেখে ভ্যান চালাতে। ভ্যানচালক সোহার উদারতা দেখে খুব খুশি হলেন। সোহার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ভাইজান দেইখেন আপনের এই মাইয়া একদিন অনেক বড় হইবো।  

দাদুবাড়ি এসে খুব খুশি সোহা। ইফতার সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সোহার মামনির ব্যাগ থেকে এক এক করে সবার জামা-কাপড়গুলো বের করে হাতে হাতে দিয়ে দিলেন। সবার জন্য নতুন জামা-কাপড় কেনা হয়েছে শুধু একজন বাকি। সোহার দাদুবাড়ির কাজের বুয়ার নাতনি। কিছুদিন আগেই ওর মা মারা গেছে তাই ওর নানুর কাছে নিয়ে এসেছে। সোহার মা-বাবা জানতেন না মেয়েটি এখানে থাকে। মেয়েটি কাঁদছিলো সবার নতুন জামা কাপড় দেখে। সোহার খুব মায়া হলো।  

সোহা ভয়ে ভয়ে মামণির কাছে গিয়ে বললো- মামনি আমি তো ঈদের জন্য চারটি জামা কিনেছি ওখান থেকে ঐ মেয়েকে একটা জামা দিয়ে দিই?
তুমি বকা দেবে না তো?
মামনি মেয়ের উদারতায় খুব খুশি হয়ে বললেন, বকা দেবো কেন! এটা তো খুব ভালো কাজ। তোমার চারটে জামা থেকে যে জামাটি দিতে ইচ্ছে হয় সেটাই দিতে পারো। মেয়েটি জামা পেয়ে খুব খুশি হলো।

সোহার উদারতা দেখে কাজের বুয়ার চোখ ভিজে উঠলো। ভেজা কণ্ঠে সোহার মাকে বললো- আফা আপনের মাইয়ার মনটা সত্যিই অনেক বড়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৮
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।