ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

লাল সবুজের অহংকার: ‘আমাদের পতাকা আমাদের মান’

আসাদুল হক খোকন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১১
লাল সবুজের অহংকার: ‘আমাদের পতাকা আমাদের মান’

ডিসেম্বর মানেই বিজয়ের মাস। আমাদের অহংকার ও স্বাধিকার অর্জনের মাস।

এ মাস এলেই মাসজুড়ে তাই আমাদের মনে এক ধরনের চাপা আনন্দ অনুভূতির ছোঁয়া লেগে থাকে। এক ধরনের আবেগ, ক্ষোভ, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে যায় আমাদের হৃদয় গহ্বর! শুধু মনেই নয়, দেশজুড়েই নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ঘটে এর বহিঃপ্রকাশ। হঠাৎ ডিসেম্বর শুরুর সাথে সাথে আমাদের চারপাশ খুব দ্রুত  লাল-সবুজে রঙিণ হয়ে উঠতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এর পরিমান ও পরিধি। আর ১৬ ডিসেম্বর মানেই তখন দাঁড়ায় লাল-সবুজের বন্যায় প্লাবিত বাংলাদেশ!
রাস্তা, শপিং কম্পেøক্স, গাড়িতে, বাড়ির ছাদে, স্কুল -কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, রিক্সাওয়ালার মাথায়, তরুণ-তরুণীর পোশাকে, শিশুদের গালে- হাতের কব্জিতে, কোথায় নেই লাল-সবুজের ছোঁয়া? কোথায় নেই আমাদের পতাকা? ডিসেম্বর মানেই তাই, লাল আর সবুজের সৌন্দর্যে  জড়ানো আমাদের প্রিয় জন্মভূমি- বাংলাদেশ।

বছর সাতেক হলো অনেকের মতো এমনই লাল-সবুজের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মকবুল হোসেনও। ডিসেম্বর এলেই তিনি বেড়িয়ে পড়েন নগরের রাস্তায়। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, এক হাতে বাঁশের কাঠির মাথায় ছোট ছোট আনেকগুলো পতাকা আর এক হাতে লম্বা বাঁশের মধ্যে ছোটবড় নানা আকৃতির পতাকা সাজিয়ে হেঁটে চলেন ধীর লয়ে। বেশিরভাগ সময় থামেন স্কুল ও কলেজের সামনে। স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা সুযোগ বুঝে ছুঠে আসে তর কাছে।   উদ্দেশ্য একটাই- পতাকা কেনা। মকবুলের ভা-ারে থাকে ৫ টাকা থেকে শুরু করে রয়েছে ২৫০ টাকা দামের পতাকাও। টাকার অংক বুঝে দরদাম করে ছেলেমেয়েরা কিনে নেয় লাল-সবুজের পতাকা। কেউ পড়ার টেবিলে, কেউ ঘরের দেয়ালে আর কেউ ছাঁদে উড়িয়ে দেয় পতাকা। আবার কেউ কেউ মকবুলের ব্যাগে রাখা কাপড়ের ওপর মুদ্রিত রঙিন পতাকাসম্বলিত রিস্টব্যান্ডও কিনে নেয়। বিজয় দিবস আসার আগে রঙিন পতাকাসম্বলিত রিস্টব্যান্ড হাতে লাগিয়ে ঘুড়ে বেড়াতে তাদের বেশ লাগে!
এসব ক্রেতাদের নিয়েই চলে মকবুলের সারাদিনের কারবার। দিন শেষে লাল-সবুজের পতাকা বেঁচে আয় হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। পেশায় রিক্সাচালক মকবুলের প্রতিদিনের নিয়মিত আয় এর চেয়ে আরো বেশি। তারপরও তিনি খুব খুশি। দেশের স্বাধীনতা আর পতাকার রঙ তাকে খুব টানে। তাই ডিসম্বের এলে আর স্থির থাকতে পারেন না। ছুটে আসেন জাতীয় পতাকার কাছে, স্বাধীনতা আর মর্যাদার প্রতীক পতাকাকে সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ান আর মনে মনে শ্রদ্ধা জানান স্বাধীনতার বীর যোদ্ধাদের।
মকবুলের মতো এমন দেশপ্রেমিকের সংখ্যা একবারে কম নয়। শুধুমাত্র ঢাকাতেই রয়েছে শতাধিক। ডিসেম্বরে জাতীয় পতাকা বিক্রি তাদের কারো কারো পেশা হলেও অনেকে জাতীয় পাতাকার প্রতি এক অজানা টান আর শখের বশে বিক্রি করেন জাতীয় পতাকা। আর তাদের বিক্রিত পতাকাতেই মূলত বিজয় দিবসে সারাদেশ সজ্জিত হয় অপরুপ সাজে।
আমাদের পতাকা ও তার রঙ লাল-সবুজ কিভাবে এলো? ইতিহাস ঘেঁটে যতটা জানা যায়- সরকারিভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সর্বপ্রথম ব্যবহার শুরু হয় স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি। নক্সা ও রং হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত পতাকাটির  রং ও নক্সাটি প্রায় হুবহু অনুসরণ করা হয়। তবে সে সময় লাল বৃত্ত ও সবুজ জমিনের সঙ্গে বাংলাদেশের মানচিত্রও ব্যবহার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে নানাদিক বিবেচনা করে পতাকা থেকে বাংলাদেশের মানচিত্রটি বাদ দেওয়া হয়।
পতাকায় ব্যবহৃত রঙ লাল সবুজের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- জমিনের গাঢ় সবুজ রঙ, সমগ্র বাংলাদেশের বুকজুড়ে বিস্তৃত ফসলের মাঠ এবং লাল বৃত্ত, একই সাথে বাংলাদেশের বুকে উদীয়মান সূর্য্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা আত্মদান করেছেন তাদের পবিত্র তাজা লাল রক্তের প্রতীক।
পতাকার সর্বপ্রথম নক্সাবিদ হিসেবে আমাদের মধ্যে অনেকেই শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসানের নাম জানলেও মূলত তিনি জাতীয় পতাকার নক্সাবিদ নন। স্বাধীনতার পূর্বে সর্বপ্রথম পতাকাটির ডিজাইন করেন একজন ছাত্র। ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ওই ছাত্রের নাম শিব নারায়ণ দাস।
আবাক হলেও সত্যি যে, সে সময় ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ সংগঠনের ছাত্র নের্তৃবৃন্দের উদ্যোগে ঢাকার নিউ মার্কেটে অবস্থিত অ্যাপোলো টেইলার্সের মালিক বজলুর রহমান লস্করের কাছ থেকে পাওয়া কাপড় দিয়েই তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের সর্বপ্রথম পতাকা।
১৯৭১ সনের ২ মার্চ সে পতাকাটি সর্বপ্রথম উত্তোলন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্র নের্তৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন ডাকসু সহ-সভাপতি এএসএম আব্দুর রব।
এরপর ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ধানমন্ডির বাসভবনে সর্বপ্রথম পতাকা উত্তোলন করেন।
তবে জাতীয় পতাকার রঙ, আকার ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিধি নিষেধ রয়েছে। এসব নিয়ম মেনে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। তারপরও নানা সময়, নানা বেসরকারি অনুষ্ঠানে (এমনকি সরকারি অনুষ্টানেও এবং কখনো ব্যক্তিগতভাবে কোথাও কোথাও জাতীয় পতাকার যথেচ্ছ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। অনেকে আমাদের স্বাধীনতা ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক, জাতীয় পতাকার প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করতেও দ্বিধা প্রকাশ করেন। অনেকে আবার অতি উৎসাহী হয়ে যখন তখন, যেখানে সেখানে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দেন, যা একবারেই ঠিক নয়।
এর বিপরীতে, স্বাধীনতার এত বছর পরেও জাতীয় পতাকাকে এদেশেরই কোনও কোনও মহল বা কেউ কেউ এখনও একটুকরো রঙিন কাপড় বলে ঠাওরান। তাদের মত অকৃতজ্ঞ চতুষ্পদী স্বভাবের দু’পেয়েদের জন্যই বাঙাল কবি লিখেছেন- যেসবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সেসবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি (আব্দুল হাকিম, বঙ্গবাণী)।
যারা এদেশে বসবাস করে, এদেশের মাটি, আলো বাতাসে বেঁচে থেকে এখনও পাকি মগজে তেল দিচ্ছেন, তাদের বলছি- এই একটুকরো রঙিণ কাপড়কে অর্জণের জন্যই নিস্পাপ শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ অগণিত মুক্তিযোদ্ধার অমূল্য জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। এই একটুকরো কাপড়, আমার পতাকা, আমাদের কোটি মানুষের মাথা ঊঁচু করে বেঁচে থাকার প্রতীক, আমাদের জাতীয় পতাকা। সুতরাং এদেশে বাস করতে হলে, এদেশের আলো বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাইলে, এই একটুকরো কাপড় লাল-সবুজের পতাকা তলেই মাথা নত করে থাকতে হবে। একেই শ্রদ্ধায়, সম্মানে সবার উপরে তুলে রাখতে হবে। অন্যথায়, আপনাদের ভালোবাসার পতাকা তলে চলে যান, এদেশে আর এক মূহুর্ত নয়!
কারণ-
‘আমাদের পতাকা আমাদের মান
সত্য, সুন্দর, বিজয় নিশান’

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৭ ঘণ্টা, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।