ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

ছোট্ট মুক্তিযোদ্ধা | বিএম বরকতউল্লাহ্

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৯
ছোট্ট মুক্তিযোদ্ধা | বিএম বরকতউল্লাহ্

বারো বছরের মেয়ে অপরাজিতা। তার মনে একটা দুঃখ বারবার জেগে ওঠে, সে এখনও কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেনি। সে তার বাবার কাছে আফসোস করে প্রায়ই তার এই দুঃখের কথাটা বলে।

একদিন তার বাবা তাকে বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তোমাকে মুক্তিযোদ্ধা দেখাবো মা। ’ পরেরদিন অপরাজিতার বাবা তাকে তার স্কুলের গেটে নিয়ে গেলেন।

তার বাবা সেখানে জবুথবু দাঁড়িয়ে থাকা এক ভিক্ষুককে দেখিয়ে বললেন, ‘ইনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ’ অপরাজিতা থ হয়ে গেলো। সে তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বাবা কী বলছ তুমি! ইনি তো ভিক্ষুক। ভিক্ষুক আবার মুক্তিযোদ্ধা হয় কীভাবে?’ 

বাবা বললেন, ‘কোনো ভিক্ষুক মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিল কিনা জানি না, তবে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষুক হয়ে গেছেন। আমাদের দেশে এমন অনেকেই আছেন যারা নানা কষ্ট করে জীবন সংগ্রামে পরাজিত হয়ে মারা গেছেন। আমরা তাদের জন্যে তেমন কিছুই করতে পারিনি। আমরা বড়ো অকৃতজ্ঞ। ’ 

অপরাজিতা কৌতূহলী দৃষ্টিতে ভিক্ষুকটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কীভাবে শত্রুর দৃষ্টি এড়িয়ে শত্রুদের হত্যা করেছিলেন এসব ঘটনা অপরাজিতার মনে খেলা করতে লাগলো। এ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি কেন জানি তার অসম্ভব দরদ আর শ্রদ্ধা জেগে উঠেছে।  

অপরাজিতা তার বাবাকে আবদার করে বললো, ‘বাবা আমি এখন এই মুক্তিযোদ্ধাকে পা ছুঁয়ে সেলাম করবো। ’ বাবা তাকে একটা হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? ভিক্ষুকের পা ছুঁয়ে সেলাম করবে তুমি? লোকজন দেখলে কী বলবে, শুনি?’ একথা বলেই তার বাবা আর বিলম্ব না করে অপরাজিতাকে টেনে নিয়ে সোজা বাসায় চলে গেলেন।  

অপরাজিতা চিৎকার করে বলছে, ‘তুমি না বললে, ইনি মুক্তিযোদ্ধা! তাহলে আমাকে এভাবে টেনে নিয়ে এলে কেন?’ বাবা বললেন, ‘তিনি মুক্তিযোদ্ধা তা ঠিক আছে। কিন্তু যিনি ভিক্ষা করেন তার আর কোনো পরিচয় থাকে না, সব মুছে যায়। এ পেশার মানুষকে কেউ মানুষ বলেই তো স্বীকার করে না; সেলাম করবে কোন সাহসে!’ 

পরেরদিন স্কুলে গেলো অপরাজিতা। স্কুলগেটে ছাত্র-ছাত্রী আর অভিভাবকদের ভিড়। সে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সোজা ভিক্ষুকের পায়ের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ে সেলাম করতে লাগলো। ভিক্ষুক বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে কৃতজ্ঞতার হাত বুলিয়ে দিল অপরাজিতার মাথায়। এ অপূর্ব দৃশ্য দেখে মুহূর্তে ভিড় জমে গেলো। সবাই হতবাক! 

‘মেয়েটি এমন করলো কেন? কী হয়েছে তার? ভিক্ষুকের পায়ে পড়ে সেলাম! মাথা ঠিক আছে তো মেয়েটির!’

তার চারপাশে কৌতূহলী লোকের ভিড় জমে গেলো। সবাই অবাক হয়ে তাকে দেখছে। ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের অজস্র প্রশ্নবাণে জর্জরিত অপরাজিতা কার প্রশ্নের কী জবাব দেবে এর কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে চোখ বন্ধ করে কান্নায় ভেঙে পড়লো।  

কে একজন ফোন করে অপরাজিতার বাবাকে বলছে, ‘হ্যালো, আপনি কি অপরাজিতার বাবা বলছেন? আপনার মেয়ে স্কুল গেটে অ্যাবনরমাল আচরণ করছে, তাড়াতাড়ি চলে আসুন। ’

অপরাজিতার কান্না থামছে না। তার বাবা-মা অস্থিরভাবে তাকে নিয়ে সোজা বাসায় চলে গেলো। অপরাজিতার বাবা আদর করে বললেন, ‘এমন নিসপিস করছ কেন, মা। খারাপ লাগছে তোমার?’

অপরাজিতা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘খুবই খারাপ লাগছে বাবা। আমি এখন কাঁদবো। মন খুলে কাঁদবো। কাঁদলে আমার ভালো লাগবে। তোমরা এখন রুম থেকে বেরিয়ে যাও, প্লিজ। ’
 
কিছুদিন পরে অপরাজিতা স্কুলে যাওয়া শুরু করে দিল। স্কুলগেটে গিয়েই তার বুকটা ধক্ করে উঠলো। সেই ভিক্ষুকটি আর সেখানে নেই। তার বুক ভেঙে কান্না আসে।

অপরাজিতা এক নারী ভিক্ষুককে বলে, ‘আপনি কি দয়া করে বলবেন, এখানে দাঁড়িয়ে যে লোকটি ভিক্ষা করতেন তিনি এখন কোথায়?’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অভিমানের সুরে বললেন, ‘কোথায় আবার, গত পরশু না হ্যায় মারা গেছে। বড় বালা মানুষ আছিল গো, অভাবের জ্বালায় তার বউ-পোলা-মাইয়ারা হেরে ছাইড়া কই জানি চইলা গেছে। দেশের জন্যি যুদ্ধ করিছে বেটায়, গুল্লি খাইয়া তার এক পাও আর এক হাত অচল অইয়া গেছে। এহন হের কোনো দাম নাই। হেয় খাইছে ভিক্কা কইরা।  

আমি হেরে কইছিলাম, ‘তুমি না মুক্তিযোদ্ধা। সরহার ট্যাহা দেয়, যাওনা ক্যান?” হেয় কয় কি, ‘আমি যখন সব হারাইয়া পথের ভিক্ষুক অইয়া গেছি এহন আর কাউকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিমু না। ’ একটানে কথাগুলো বলে নারী ভিক্ষুকটি আঁচলে চোখ মুছতে লাগলেন। অপরাজিতার সারাটা শরীর মায়ায় ভরে গেছে। কষ্টগুলো তার গলায় গিঁট পাঁকিয়ে আছে। তার চোখভরা জল ছলছল করছে। অপরাজিতা তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওনাকে কবর দিয়েছে কোথায়?’ বললেন, ‘ফহিরগো আবার কব্বর। হেরে ওই সেতুডাঙ্গার ঢালে কোনোমতে কব্বর দিয়া সাইনবোট লাগাইয়া দিছে। ’ 

অপরাজিতা তাকে নিয়ে ছুটে গেলো কবরের পাশে।  

সেতুডাঙ্গার ঢালুতে একটিমাত্র কবর। চারকোণে চারটা খেজুরের কাঁচা ডালা কোপানো। কবরের শিথানে কাঠিতে ঝুলানো আছে এবড়ে-থেবড়ো টিনপ্লেট। প্লেটে আনাড়ি হাতের লেখা। এতে আছে- ‘মৃতের শেষ ইচ্ছায় লেখা- “কেউ আমাকে না চিনলেও সেদিন স্কুলগেটে একটি ছোট্ট মেয়ে আমাকে চিনেছিল। সে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় আমার পা ছুঁয়ে সেলাম করেছিল, সেদিনই আমি আমার স্বীকৃতি পেয়ে গেছি। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত আমার সমস্ত কৃতিত্ব আর অহংকার সেই ছোট্ট মেয়েটিকে উৎসর্গ করলাম!”

লেখাটি পড়ে অপরাজিতার চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো কবরে। সে দু’হাত তুলে মোনাজাত করছে- ‘হে প্রভু! একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা তার অর্জিত সমস্ত কৃতিত্ব আর অহংকার আমাকে উৎসর্গ করে গেলেন, আমাকে তার পূর্ণ মর্যাদা রক্ষা করার শক্তি দাও। আমরা তাঁর কোনো মর্যাদা দিতে পারিনি। তুমি তার উপযুক্ত মর্যাদা দিও।

এতদিন তিনি যা গোপনে লালন করেছিলেন, আমি যেন তার চেতনা সবলে প্রকাশ করতে পারি। ” নারী ভিক্ষুকটি ‘আমিন!’ ‘আমিন!!’ বলে চিঁ চিঁ করে কেঁদে উঠলেন।  

অপরাজিতা চোখ মুছে কবরটা সামনে রেখে স্থির হয়ে শক্তপায়ে দাঁড়ালো এবং সে সামরিক কায়দায় সেল্যুট করলো। অতঃপর অপরাজিতা বীরমুক্তিযোদ্ধার সব কৃতিত্ব আর চেতনা বুকে ধারণ করে সগর্বে চলে গেলো বাসায়। সামনে তার অনেক কাজ!

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৯
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।