ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

আদালতের ভাষা

ব্রিটিশ আমলে বাংলা, বাংলাদেশ আমলে ইংরেজি

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬
ব্রিটিশ আমলে বাংলা, বাংলাদেশ আমলে ইংরেজি

‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। আমাদের সংবিধানে এভাবেই বাংলা এসেছে।

সংবিধানে প্রথম থেকেই অনুচ্ছেদটি অপরিবর্তিত আছে। সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার বিধান। এটি রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্কের পরিচায়ক। সংবিধান বলছে প্রজাতন্ত্রের ভাষা হচ্ছে বাংলা। তার মানে রাষ্ট্রের সব কার্যাবলী বাংলায় পরিচালিত হওয়‍ার কথা।  
 
রাষ্ট্রের কার্যাবলী বলতে রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্রের যাবতীয় বিষয় বাংলায় পরিচালিত হওয়ার কথা। সচিবালয় থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসন এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমও বাংলায় হওয়ার কথা।  
 
বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি প্রধান অঙ্গ। সংবিধানের অভিভাবক। আইন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ। রাষ্ট্রের কোনো আইন যদি সংবিধান বিরোধী হয় তা দেখার ও শোধরানোর দায়িত্ব বিচার বিভাগের। বিচ‍ার বিভাগ আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল। আমাদের কাণ্ডারি।    
 
কিন্তু খোদ বিচার বিভাগেই বাংলা সবচেয়ে অবহেলিত। আমরা ব্রিটিশ আইন দিয়ে এখনো চলছি। সেটি বড় সমস্যা নয়। প্রয়োজনের খাতিরে আইন সংশোধন হতে পারে।  
 
ব্রিটিশরাজ চলে গেছে তাও প্রায় সত্তর বছর। কিন্তু আদালতে চলছে এখনো ইংরেজি শাসন। মাতৃভাষা আজ নিজের অন্দর মহল পার হয়ে বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ২১’এর চেতনা আজ বিশ্ব স্বীকৃতি লাভ করেছে।    
 
২১’এর চেতনা মানে স্বকীয়তার চেতনা। নিজের যা আছে তাই নিয়ে এগিয়ে চলার প্রেরণা। নিজের মা, ভাষা, নদী, পাখি, ঐতিহ্য এমনকি সীমাহীন দারিদ্র্য নিয়ে এগিয়ে চলা। জাতিসংঘ সেই চেতনা থেকেই মাতৃভাষা দিবসের সূচনা করেছে। মাতৃভাষা দিবস মানে ইংরেজির বিশ্বায়ন নয়, নয় বাংলারও। সবার ভাষাকে সমান মর্যাদা দেয়াই ২১’র চেতনার আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ।  
 
দেশের আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ চলছে বাংলায়। এক সময় দেশের অধিকাংশ আইন প্রণয়ন করা হতো ইংরেজিতে। কোনো কোনো আইনের বাংলা অনুলিপি করা হতো। এখন অবশ্য দিন বদলেছে। এখন প্রায় সব আইনই প্রথমে বাংলায় লেখা হয়। পরে কোনো কোনো আইনের ইংরেজি করা হয়। তবে এক্ষেত্রে ’বাংলা’র অবস্থা তথৈবচ! বর্তমানে প্রণীত  আইনগুলোর ভাষাগত দুর্বলতা চোখে পড়ার মতো। বানানের কথাতো বলাই বাহুল্য। তবে, আইন প্রণয়নে ‍বাংলা গুরুত্ব পাচ্ছে সেটিই আশার কথা। সেটি বাংলার প্রতি ভালোবাসা নাকি ইংরেজির দুর্বলতা সে বিতর্কে যাবো না।  
 
আইনানুযায়ী আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু এখন আইন প্রণয়ন হয় সচিবালয়ে, মন্ত্রণালয়ে। সংসদে কেবল ’হ্যা’ বা ’না’র মাঝেই সীমাবদ্ধ আইন প্রণয়নের মহান কর্মযজ্ঞটি। অথচ ইতিহাস বলে, এক সময় আইন নিয়ে সংসদে যে জ্ঞানগর্ভ  বিতর্ক হতো তা ছিল সবার জন্য শিক্ষণীয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ‍আইন পড়ি, বিস্মিত হতাম সেসব সংসদীয় বিতর্ক  পড়ে।    
 
আমরা আজ জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা চালুর দাবি করছি। কিন্তু নিজেরা কতটুকু ‘বাংলা’য় আছি। সর্বোচ্চ আদালত তো বটেই নিম্ন আদালতেও চলছে ইংরেজির  প্রভুত্ব। কোনো আদালতেই বাংলার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনা। বিচারক বাংলাকে ভালোবেসে রায় দিতে চাননা। আইনজীবীরাও ইংরেজির পেছনেই ছুটছেন। যদিও কিছু ব্যতিক্রম আছে বৈকি!  
 
একজন অশিক্ষিত বা ইংরেজি না জানা আসামি জানতে পারবেনা কেন তার ফাঁসি হলো। অপরাধতো তিনি করছেন বুঝলাম, মানলাম। কিন্তু পুরো রায়টি কি তার একবার পড়‍ার অধিকার নেই। বোঝার কি অধিকার নেই রায়ে কি লিখেছেন মহামান্য?  
 
এগিয়ে এসেছে ভারত। মাদ্রাজ হাইকোর্টে তামিল ভাষা প্রচলনের দাবিতে যেখানে অনশন পর্যন্ত হয়েছে। ভারতে আদালতে এখনো ইংরেজিই চলছে। কারণ ভারত বহুভাষার দেশ।  
 
তবুও মাদ্রাজ এগিয়ে এসেছে এর বিরুদ্ধে। ওদিকে ইতোমধ্যে আফ্রিকা, কানাডা, মালয়েশিয়া, সোভিয়েত রাশিয়া, জার্মানি, চীন, ফ্রান্স, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, জাপান এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালও তাদের নিজেদের ভাষায় বিচার করে। কিন্তু আমাদের দেশে চলে তলে-তলে ইংরেজি কোর্স করার মহড়া।  
 
ব্রিটিশদের আগে আদালতের ভাষা ছিল ফার্সি। ব্রিটিশরা আসার পরেও কিছুকাল ফার্সি প্রচলিত ছিল। এরপর ইংরেজি হয় সরকারি ভাষা। কিন্তু আদালতে ‍বাংলাই চালু থাকে। অর্থাৎ ইংরেজ আমলেও বাংলা ভাষা চালু ছিল আর এখন বাংলা আমলে ইংরেজি বহাল আছে!
 
আশ্চর্যজনক হলো যে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরই আদালতে বাংলার চেয়ে ইংরেজির প্রচলন আচমকা বেড়ে গেল অবিভক্ত ভারতে। যেন, বাপ-দাদার উত্তরাধিকারের ঋণ শোধ করতেই ইংরেজির হাল ধরা!  
 
বিচার পাওয়ার অধিকার মানুষের চিরন্তন অধিকার। অপরাধীরও ন্যায়বিচার বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। অধিকার আছে নিজের ভাষায় রায় পাওয়ার।    
 
১৯৬৬ সালের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিতে বিচারপ্রার্থীদের এ অধিকার দেয়া হয়েছে। এটি তার মানবাধিকার। বাংলাদেশ ওই চুক্তিতে সই করেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য বাধ্যতামূলক একটি চুক্তি। চুক্তির ১৪(৩) অনুচ্ছেদ বলছে, In the determination of any criminal charge against him, everyone shall be entitled to the following minimum guarantees, in full equality: (a) To be informed promptly and in detail in a language which he understands of the nature and cause of the charge against him।
 
আদালতে বাংলা ভাষার চর্চা না করে স্পষ্টতই আমরা এ চুক্তির লঙ্ঘন করছি।  
 
তবে, আদালতে কেউ কেউ বাংলার চর্চা করছেন বটে। আছেন অনেক আইনজীবী ও বিচারক যারা বাংলাতেই আছেন। আমাদের উচ্চআদালত বাংলা ভাষার বিকৃতি ও দূষণ রোধে একটি রুল জারি করেছিল। আদালত বলেছেন, ‘পৃথিবীতে বাংলাই একমাত্র ভাষা যার জন্য মানুষ রক্ত দিয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম দৃষ্টান্ত আর দ্বিতীয়টি নেই। সুতরাং এ ভাষার পবিত্রতা আমাদের রক্ষা করতে হবে। ’ কিন্তু সেবা কার্যক্রম ঘর থেকে শুরু কর‍াই ভালো (charity begins at home)। যদিও আমাদের হাতে সে রকম খুব বেশি রেফারেন্স নেই।  
 
দেশের উচ্চ আদালতে খুব কম সংখ্যক বিচারকই ছিলেন যারা বাংলায় রায় লিখেছেন। সে রায় প্রশংসিতও হয়েছে। আইনের ছাত্র হিসেবে উচ্চ আদালতের রায় পড়া প্রতিদিনের রুটিন কাজ। পুরনো সে রায়গুলো পড়ে এখনও মুগ্ধ হই। কি অসাধারণ সাহিত্য ও দার্শনিক চিন্তাপ্রসূত সে সব ‍রায়। সেই সাথে গভীর আইন দর্শনতো আছেই। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের রায় থেকে আমরা পাই সাহিত্যের অসাধারণ উপকরণ। বিচারপতি মোস্তফা কামাল, কামাল উদ্দিন, মাহবুব মোর্শেদ আরো কত বিচারক। সবাই আমাদের গর্ব‌। এরকম আরো অনেকেই আছেন যাদের রায় সমগ্র বিশ্বের কাছে রেফারেন্স।  
 
আদালত রুল জারি করেছে ঠিক। কিন্তু প্রদীপের নিচে অন্ধকার দূর করবে কে? আদালত আমাদের ভাষার বিকৃতি রোধ করার পরামর্শ দিয়েছেন। সে আদেশ শিরোধার্য। কিন্তু আমাদেরও যে বাংলায় আদেশ পেলে সুবিধা হয়।    
 
একথা সত্যি যে আমাদের অধিকাংশ আইনই ইংরেজিতে লেখা। আদালতের রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত অধিকাংশ রায়গুলোও ইংরেজিতে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজির প্রচলনটা বেশি। কিন্তু বর্তমানে আদালতে প্রচলিত অধিকাংশই আইনেরই বাংলা অনুলিপি আছে। প্রয়োজন শুধু রেফারেন্সের দোহাই না দিয়ে বাংলায় ‍রায় দিয়ে রেফারেন্স সৃষ্টি করা।    
 
বিচারকদের একেকটি রায় ‍‌আমাদের জন্য রেফারেন্স। বিচারপতি এবাদুল হক বাংলায় রায় লিখে আমাদের জন্য রেফারেন্স সৃষ্টি করেছেন। তেমনিভাবে উল্টো রেফারেন্সও আছে- যেমন, বিচারপতি হামিদুল হক চৌধুরী। বিচারপতি চৌধুরী ছিলেন বাংলা বিরোধী। তিনি হাইকোর্টে নিম্ন আদালতে বাংলা প্রচলনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন। ফলে, নিম্ন আদালতে ইংরেজি আবার চালু হয়। বিচারপতি এবাদুল হক আমাদের জন্য এক উজ্জ্বল রেফারেন্স। তার রায়গুলো অনেক ইংরেজি জানেওয়ালা বিচারকদের চেয়ে উচ্চমানসম্পন্ন।
 
বিচার অঙ্গনে তিনি শুধু ‍বাংলা রায়ের জন্যই নন, প্রজ্ঞা, মেধা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তিনি এক অগ্রণী সৈনিক।  
 
মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘উচ্চ আদালতের বিচারকাজ বাংলায় হওয়া উচিত। আমিও চিন্তা করছি, দু-একটি রায় বাংলায় দেওয়ার জন্য। ’ আসলে নাগরিকদের বিচারের অধিকার স্বীকার করলে আসামি বা ফরিয়াদির ভাষাতেই রায় প্রদান করতে হবে। ২০১২ সালে হাইকোর্ট একটি বিধিমালাও জারি করে দেশের সব জায়গা থেকে ইংরেজি মুছে বাংলা করার নিদের্শ দিয়েছেন। কিন্তু প্রদীপের নীচে অন্ধকার আর কতকাল?
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।