ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

দুধ-দইয়ে ক্ষতির মাত্রা নিরূপণে কমিটি গঠনে নির্দেশ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৯
দুধ-দইয়ে ক্ষতির মাত্রা নিরূপণে কমিটি গঠনে নির্দেশ

ঢাকা: গাভীর দুধ (প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া) ও বাজারের প্যাকেটজাত দুধ, দই এবং গো খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে তাতে কী পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক, সিসা, রাসায়নিক মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর তা নিরুপণে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে আসার পর সোমবার (১১ ফেব্রুয়ারি) বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ এ আদেশ দেন।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।

এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব।
 
এই কমিটিকে প্রতি ৬ মাস পরপর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। নিজেদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য মানুষ যাতে সঠিক তথ্য সম্পর্কে জানতে পারে সেজন্য কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।  

আদালতের এই আদেশ কার্যকর করতে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, খাদ্য, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস ও প্রাণিসম্পদ, পরিবেশ সচিবের কাছে আদেশের অনুলিপি সরবরাহ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।  
 
দুধ, দই এবং গো-খাদ্যে ভেজাল মেশানোর ঘটনা তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে দুধ, দই এবং গো-খাদ্যে ভেজাল মেশানোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে একটি কমিটি গঠন করতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ কমিটিকে তিনমাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
 
এছাড়া জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের কারিগরি ব্যবস্থাপক অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসের প্রতিবেদন ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আদালত বলেছেন, দুধ, দই এবং গো-খাদ্যে ভেজাল মেশানোর ঘটনা একটি মারাত্মক দুর্নীতি। এটা একটি অপরাধ। এই দুর্নীতি ও অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। আদালত উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, খাদ্যে ভেজালের ফলে মানুষের কিডনি, লিভার নষ্ট হচ্ছে। ক্যান্সার হচ্ছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আদালত বলেন, মানুষ শুধুই টাকার পেছনে ছুটছে। নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবছে না। স্বাস্থ্যই যদি ঠিক না থাকে, তাহলে এত টাকা-পয়সা দিয়ে হবেটা কী?
 
 
পরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, নিরাপদ দুধ, দই ও গো খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে ও ভেজাল প্রতিরোধে বিবাদীদের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি এবং অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।  

একই সঙ্গে ভেজাল দুধ, দই ও গো খাদ্য উৎপাদন, পরিবহন, প্যাকেট ও বাজারজাতকরণ এবং সংরক্ষন করা কেন বেআইনী ও অবৈধ ঘোষনা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন দোকান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও খোলাবাজার থেকে এসব ভেজাল দুধ, দই ও গো খাদ্য অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয় হবে না, তাও জানতে চেয়েছেন আদালত।
 
চার সপ্তাহের মধ্যে খাদ্য সচিব, স্বাস্থ্য সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, কেন্দ্রীয় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটি, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিএসটিআই চেয়ারম্যানকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
 
তিনি জানান, আদেশের আগে প্রথমেই আদালত এ বিষয়ে সরকার ও দুদকের বক্তব্য জানতে চান। পরে আদালত অন্তবর্তী নির্দেশনাসহ রুল জারি করেছেন। আগামী ৩ মার্চ পরবর্তী আদেশের জন্য রেখেছেন।
 
গত ১০ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘গাভির দুধ ও দইয়ে অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক, সিসা!' শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গাভির দুধে (প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া) সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক ও নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের উপাদান পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে বিভিন্ন অণুজীবও। একই সঙ্গে প্যাকেটজাত গাভির দুধেও অ্যান্টিবায়োটিক ও সিসা পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত। বাদ পড়েনি দইও। দুগ্ধজাত এই পণ্যেও মিলেছে সিসা।
 
সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির (এনএফএসএল) গবেষণায় এসব ফলাফল ওঠে এসেছে। সংস্থাটি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আর্থিক সহায়তায় গাভির খাবার, দুধ, দই ও প্যাকেটজাত দুধ নিয়ে এই জরিপের কাজ করেছে।
 
এনএফএসএল সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গাভির দুধের ৯৬টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ঢাকাসহ তিন জেলার ছয়টি উপজেলাসহ ১৮টি স্থান থেকে দুধের পাশাপাশি অন্যান্য নমুনাও সংগ্রহ করা হয়। গাভির দুধ ও গোখাদ্য সরাসরি খামার থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।  

দই ঢাকা শহরের বিভিন্ন ব্র্যান্ড দোকান ও আশপাশের উপজেলার দোকান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বিভিন্ন সুপার স্টোর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে বাজারে প্রচলিত প্রায় সব ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত তরল দুধ এবং আমদানি করা প্যাকেট দুধ। এগুলো নির্দিষ্ট নিয়মে ল্যাবরেটরিতে পৌঁছানোর পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে।
 
গবেষকেরা বলছেন, প্রায় সব গোখাদ্যে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কীটনাশকও মিলেছে কোনো কোনো খাবারে। সিসা ও ক্রোমিয়ামও আছে।
মানুষের রোগ প্রতিরোধ শক্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এগুলো। সিসা ও ক্রোমিয়াম ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে।
 
প্রতিবেদনে বলা হয়, গোখাদ্যের ৩০টি নমুনা গবেষণা শেষে দেখা গেছে, এর মধ্যে কীটনাশক (২ নমুনায়), ক্রোমিয়াম (১৬টি নমুনায়), টেট্রাসাইক্লিন (২২টি নমুনায়), এনরোফ্লোক্সাসিন (২৬টি নমুনায়), সিপ্রোসিন (৩০টি নমুনায়) এবং আফলাটক্সিন (৪টি নমুনায়) গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রা পাওয়া যায়।
 
গাভির দুধের ৯৬টি নমুনার মধ্যে ৯ শতাংশ দুধে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কীটনাশক, ১৩ শতাংশে টেট্রাসাইক্লিন, ১৫ শতাংশে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় সিসা পাওয়া যায়। ৯৬ শতাংশ দুধে মেলে বিভিন্ন অণুজীব।

প্যাকেটজাত দুধের ৩১টি নমুনায় ৩০ শতাংশে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি হারে আছে টেট্রাসাইক্লিন। একটি নমুনায় সিসা মিলেছে। একই সঙ্গে ৬৬ থেকে ৮০ শতাংশ দুধের নমুনায় বিভিন্ন অণুজীব পাওয়া গেছে।
 
দইয়ের ৩৩টি নমুনা পরীক্ষা করে একটিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি সিসা পাওয়া গেছে। আর ৫১ শতাংশ নমুনায় মিলেছে বিভিন্ন অণুজীব।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১,২০১৯/আপডেট: ২১১৬ ঘণ্টা
ইএস/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।