ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

বাবা, ক্যান্সার এবং সবার ভালোবাসা : ইমা খান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১০

নানা আজম খান নাতনি ফোয়ারার (নানার দেওয়া নাম) সাথে খেলা করছিলেন টর্চ লাইট দিয়ে। ফোয়ারা আজম নানার মুখে টর্চ লাইট দিয়ে ডাক্তার ডাক্তার খেলছিল।

এমন সময় ফোয়ারা জিজ্ঞেস করে ‘নানা তোমার মুখের ভেতর ওটা কী?’ নানা উত্তর দেন, ওটা মুখের ঘা। ফোয়ারা নানার মুখে ফু দিয়ে দেয় আর বলে ‘আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করে দেবে’। নানা হাসেন... এভাবেই ভয়াবহ ব্যাধি ক্যান্সারের সাথে পরিবারের মানুষের দর্শন ঘটে। প্রথমত সাধারণ ইনফেকশন ভেবে সাধারণ কোনও ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ সেবন করেন তিনি, কিন্তু তাতে তেমন ফল পাওয়া যায়নি। সাংসারিক ও প্রফেশনাল কাজে ব্যস্ত থাকার ফলে পরে আর ডাক্তারও দেখানো হয়ে ওঠেনি।

সেটা ছিল জিভের নিচে বেড়ে ওঠা ওভাল শেপের টিউমার, যা দীর্ঘ ছয়-সাত মাস ধরে মুখগহ্বরে থেকে ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। প্রথমে সবাই মনে করেন যে ওটা সাধারণ টিউমার। পরিবার-পরিজনরা দ্রুত ডাক্তার দেখাতে অনুরোধ করেন। ২১ জুন প্রথম দেখানো হয় নাক, কান, গলার ডা. সজল আশফাককে। তিনি দেখে তৎণাৎ বায়োপসি টেস্ট করতে দেন। ২২ জুন আজম খানের সহযোগী মতিন বায়োপসি টেস্টের স্যাম্পল নিয়ে গিয়ে এ আই খান ল্যাবে টেস্ট করতে দেন। বায়োপসি টেস্ট করতে ও রিপোর্ট পেতে তিন দিন লাগে। ২৭ জুন রাত ৯টায় রিপোর্ট আনার পর প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খানের গবেষণা ও পর্যবেণে বায়োপসি টেস্টের রিপোর্টে ফলাফল পাওয়া যায় প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যানসারের অবস্থান, যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলে স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা।

এর মধ্যে মুখে ব্যথা থাকা সত্ত্বেও ২৪ জুন মিরপুর স্টেডিয়ামে জনসচেতনতামূলক কনসার্টে তিনটি গান পরিবেশন করেন বাবা এবং শারীরিকভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েন। ২৮ জুন পরিবার-সদস্যরা তাকে নাক, কান, গলার বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের সাথে সাাৎ করান । তিনি এবং অধ্যাপক বেলায়েত হোসেন সিদ্দিক মিলে নানাভাবে পর্যবেণ করেন এবং পরামর্শ দেন প্রফেসর ডা. কামরুজ্জামান চৌধুরীর কাছে পরামর্শ নিতে। ২৯ জুন ডা. কামরুজ্জামান তাকে গভীর পরীা-নিরীার পর নানা টেস্টের পরামর্শ দেন, যেমন- এমআরআই, সিটি স্ক্যান, বিভিন্ন ধরনের ব্লাড টেস্ট ইত্যাদি।

১ জুলাই টেস্টের রিপোর্ট দেখার পর ডা. কামরুজ্জামান পরামর্শ দেন যে তার অপারেশন করতে হবে। এরপর রেডিওথেরাপি দেওয়ার প্রয়োজন হবে, যাতে রেডিয়েশন দিয়ে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়। তবে যদি অপারেশনে যেতে বিশেষ দেরি হয় তবে প্রথমে কেমোথেরাপি দেওয়া যেতে পারে যাতে স্যালাইনের মাধ্যমে ওষুধ শরীরের ভেতর প্রবেশ করানো হয় এবং ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট দেওয়া যায়। উনি পরামর্শ দেন যত দ্রুত সম্ভব দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে ভালো কোনো সার্জনকে দিয়ে অপারেশন করিয়ে আসার জন্যে। কারণ এটা অত্যন্ত জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন আর যেহেতু বাবা গান করেন তাই তিনি এখানে অপারেশন করিয়ে তাকে আশঙ্কার মধ্যে রাখতে চান না। তবে তিনি এও জানান, স্কয়ারে তাকে বেস্ট কেমো বা রেডিওথেরাপি দেওয়া সম্ভব হবে কারণ এখানে আন্তর্জাতিকমানের মেশিনারিজ আছে এবং ডাক্তাররাও উন্নত দেশের চিকিৎসকদের মতো ট্রিটমেন্ট দিতে সম। ডাক্তার আরও বললেন, বাবার পিইটি স্ক্যান করা দরকার যার ব্যবস্থা এ দেশে নেই।


তখন শুরু হলো অনুসন্ধান। ভালো ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট কোথায় হবে সাধ্যের মধ্যে তা খুঁজে বের করা এবং অন্যান্য আয়োজন ও অর্থের জোগান। প্রথমত বাবা চিকিৎসায় যেতে রাজি হননি। কারণ তিনি মনে করতেন যে তার ৬০ বছর বয়স হয়ে গেছে। কিছুদিন পর তো এমনিই মরণ হবে। এত টাকা খরচ করে চিকিৎসা করে কী হবে। বরং পরবর্তীকালে টাকাগুলো ছেলেমেয়েদের কাজে আসবে। নানাজন নানা ধরনের চিকিৎসার পরামর্শ দিলেন। যেহেতু আর্টিস্ট সমাজে ও ফ্যামিলিতে সিঙ্গাপুর ফার্স্ট প্রায়োরিটি পেল তাই বাবা ট্রিটমেন্টের জন্য সিঙ্গাপুর যেতে রাজি হন। যেহেতু তিনি সাধারণ জীবনধারণে অভ্যস্ত মানুষ, তাই প্রশ্ন এল সাধ্যের। খোঁজখবর নিয়ে গুলশান পার্কওয়ে অফিসের মাধ্যমে জানা গেল, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল ক্যান্সার ট্রিটমেন্টের জন্য ভালো এবং সেখানে এ ট্রিটমেন্ট আনুমানিক ২৭ লাখ টাকার মধ্যে সম্ভব, যা আজম খানের ট্রিটমেন্টের উদ্দেশ্যে কুল এক্সপোজার, বাম্বা ও কার্নিভালের সদস্যদের মাধ্যমে গঠন করা ফান্ডের আওতার মধ্যে সম্ভব। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, বাবাকে সিঙ্গাপুর থেকেই ট্রিটমেন্ট করানো হবে। ১৪ জুলাই দুপুর ২টায় ছেলে হৃদয় খান এবং সহকর্মী এরশাদুল হক টিংকুর সাথে বাবা থাই এয়ারওয়েজের ফাইট ধরলেন সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে।

সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথে যাওয়ার পর আবার সব টেস্টের জন্য পরামর্শ দেন ডা. এনড্রিউ লয় হেং চিয়ান। ১৫ থেকে থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের টেস্ট চলতে থাকে। ১৯ জুলাই বিভিন্ন টেস্টের রিপোর্ট আসার পর কয়েকজন ডাক্তার মিলে ট্রিটমেন্টের প্লান করেন। তারা ২০ জুলাই মেডিকেলে ভর্তি হয়ে ২১ জুলাই তাকে অপারেশন করার নির্দেশ দেন। যখন আসে ট্রিটমেন্টের খরচের কথা তখন দেখা যায় সেটা আসে প্রায় ১ লাখ সিঙ্গাপুরি ডলার যা, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫৪ লাখ। আর ভর্তি করাতে হবে ৫০ হাজার সিং ডলার দিয়ে যা দেশি টাকায় প্রায় ২৭ লাখ। অর্থাৎ দেশে থাকা অবস্থায় সম্পূর্ণ ট্রিটমেন্টের যে হিসাব তারা পাঠিয়েছিল, তার দ্বিগুণ বাজেট উপস্থাপিত হলো। ইতিমধ্যে তাদের টিকেট কাটা হয় প্রায় দেড় লাখ টাকার এবং সাথে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টাকার ডলার (১৫হাজার সিং ডলার ও ৩ হাজার ইউএস ডলার) দিয়ে দেয়া হয়েছিল যা ওখানে তিনজনের থাকা, খাওয়া, যাতায়াত, যোগাযোগ, ভিজিট, টেস্ট ইত্যাদির জন্যে খরচ হয়ে যায়।

১৯ জুলাই ট্রিটমেন্ট প্লান ও খরচের বাজেট উপস্থাপিত হবার পর একটা অস্থিরতা শুরু হয়ে যায় ঢাকায়। ২০ জুলাই কার্নিভ্যাল, হানিফ সংকেত, আইয়ুব বাচ্চু ও কবির বকুল সবাই মিলে করা নাড়লেন উচ্চবিত্তের কাছে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে। এ অবস্থায় প্রথম থেকে যারা অর্থদান, যোগাযোগ, আয়োজন, ব্যবস্থাপনাসহ নানা বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণ করেছেন তারা হচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ঢাকা সিটি মেয়র সাদেক হোসেন খোকা,  চ্যানেল আই, এটিএন বাংলা, স্কয়ার গ্র“প, ওরিয়ন গ্র“প, ডেসটিনি গ্র“প, বাংলা ভিশন, এনটিভি, এমআইবি, অটবি, এনভয় গ্র“প, সামিট গ্র“প, বৈশাখী, আরটিভি, কর্পোরেট গ্র“প, ক্যাটস আই এবং শিল্পী সমাজের এন্ড্রু কিশোর, সাবিনা ইয়াসমিন, কুমার বিশ্বজিৎ, ফেরদৌস ওয়াহিদ, হাবিব, মিলিসহ অনেকে। তাদের সবাইকে আজম খানের পরিবারের সবার প থেকে জানানো হয়েছে আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভ কামনা। আল্লাহ তাদের সুখ, সমৃদ্ধি ও সফলতার সহায় হোন।


সেদিন একটা তাড়াহুড়া লেগে যায় ডলার বানিয়ে সিঙ্গাপুরে পাঠাতে। কারণ ওখানে তারা মেডিকেলে বসে আছেন ডলারের অপোয়। বাবাকে ভর্তি করতে হবে। সিঙ্গাপুরের সময় বাংলাদেশ থেকে ২ ঘণ্টা এগিয়ে, বাংলাদেশে ৪টা বাজলে সিঙ্গাপুরে ৬টা। সিঙ্গাপুরে ৫টা অবধি অফিস খোলা থাকে। ব্যাংকে পৌঁছাতে এবং ডলার প্রসেস করতে ৫টা বেজে যায়। ফলে আর ডলার পাঠানো সম্ভব হয় না সেদিন। এ অবস্থায় সিঙ্গাপুরে ২৫ বছর যাবৎ স্থায়ী এবং কম্পিউটার ব্যবসায়ী বাংলাদেশী আবুল কালাম আজাদ কন্ট্রাক্ট সাইনের মাধ্যমে তার একাউন্ট থেকে ডলার দিয়ে বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। পরদিন সকালে বাংলাদেশি ফান্ডের যৌথ একাউন্ট থেকে তাকে টাকা ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়। সেদিন পাঠানো হয় ২৪ লাখ টাকা। মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল থেকে এ ট্রিটমেন্টের জন্য তারা ১০ হাজার সিং ডলার ডিসকাউন্ট দেবে বলে জানায়।

অবশেষে ২১ জুলাই ১২ ঘণ্টা এনেস্তেশিয়ায় রেখে বাবার মুখগহব্বরে জিভের নিচে ১০ ঘণ্টার সফল অপারেশন হয় বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৭টা  থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত। অপারেশনে অংশগ্রহণকারী ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞ যারা ছিলেন তারা হচ্ছেন ইএনটি স্পেশালিস্ট ডা. এনড্রিউ লয় হেং চিয়ান, প্লাস্টিক সার্জন ডা. এরিক এং, এনেস্থেটিক ডা. টেরেন্স কোয়া এবং অন্যরা। অপারেশন সমাপ্ত করে ওটি হতে বের হয়ে তারা ঘোষণা দেন ‘অপারেশন সাক্সেসফুল’।

এরপর তাকে আইসিইউতে রাখা হয় তিন দিন। প্রথম দিন তিনি কিছু অসুবিধার সম্মুখীন হন। ডাক্তাররা তাকে হাতে এলার্মের সুইচ ধরতে বলেন, যাতে কোনও অসুবিধা হলে এলার্ম বাজিয়ে তাদের ডাকতে পারেন। কিন্তু ইংরেজি কম বোঝেন বলে ডাক্তারদের কথোপকথন তিনি বুঝতে পারছিলেন না। পরে হৃদয় খান ও টিংকুকে ডেকে তাকে ইন্সট্রাকশন বোঝানো হয়। অপারেশনের পর তার সাথে প্রথম সাাতে তারা মুষড়ে পড়েন এবং ল করেন তার চোখের কোণে পানি। প্রথম কিছুদিন তাকে নলের মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণ ও শ্বাসক্রিয়া চলতে হবে এবং কথোপকথন কিছুদিন বন্ধ রাখতে হবে।

দ্বিতীয় দিন থেকে তিনি হাতেকলমে লিখে ভাব প্রকাশ করছেন। দু-একদিন পর আইসিইউ থেকে তাকে জেনারেল ওয়ার্ডে পাঠানো হবে এবং সেখানে তাকে সপ্তাহখানেক থাকতে হবে। অপারেশনের এক মাস অন্তর তাকে ছয়-সাত সপ্তাহব্যাপী রেডিওথেরাপি দেওয়া হবে। অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন যাতে রেডিওথেরাপি তাকে আমাদের দেশে এনে দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনেকটা সেরকমই গড়াচ্ছে। শারীরিকভাবে দেশে ফেরার যোগ্য হলেই তাকে দেশে ফেরত আনা হবে এবং বাকি ট্রিটমেন্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

তার পরিবারের সব সদস্যের প থেকে দেশ-বিদেশের সব বাংলাদেশির কাছে আজম খানের জন্য আন্তরিক শুভ কামনা ও দোয়া চাই। সবাই যেভাবে ভালোবাসা, শুভেচ্ছা ও দোয়া করেছেন আমার প্রিয় বাবার জন্য, এটি আমাদের এই দুঃসময়ে অনেক বেশি শক্তি, সাহস ও প্রেরণা দিয়েছে।    আল্লাহ সবার মঙ্গল করুন।

ছবি : অপারেশনের পর আইসিইউতে শিল্পী আজম খান
 
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২১৪০, জুলাই ২৪, ২০১০


বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।